(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চীনের সাংহাই শহরের আকাশ–বাতাস আমাকে বিমোহিত করছিল। দারুণ টেম্পারেচার। কনকনে শীতও নয়, আবার গরমের ভাবও নেই। স্বচ্ছ নীল আকাশ, ঝরঝরে চারদিক। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, রাস্তার পাশে ফুলের বাগান, অগুনতি গাছগাছালী অকাতরে বিলুচ্ছে ছায়া। এমন ব্যস্ততম এবং সুপার মেগাসিটিতে এতো এত্তো গাছ যে কী করে বাঁচিয়ে রাখা হলো কে জানে! সাজানো গোছানো একটি জনপদ, একটি শহর। অনেকটা ছবির মতো। কী যে দারুণ লাগছিল! চীনা কোম্পানির তৈরি চমৎকার একটি গাড়িতে ঘুরছি। সানরুফ খুলে দেয়ায় আকাশ দেখা যাচ্ছিল, দেখা যাচ্ছিল সুউচ্চ সব ভবনের চূড়াও। মেঘ ছুঁয়ে থাকা ভবনগুলোর শীর্ষদেশকেও কেমোন যেনো হাতের কাছে লাগছিল। আকাশছোঁয়া এসব ভবন আগেও দেখেছি। তাই নতুন করে আর টানছিল না। আমি শুধু চীনাদের গাড়ি নিয়েই ভাবছি।
আমার এক বড়লোক আত্মীয় চীনা কোম্পানির হাভালের একটি জীপ কিনেন গতবছর। সেভেন সিটার গাড়িটি দেখতে বিশাল, অনেকটা টয়োটা কোম্পানির ল্যান্ডক্রুজার মডেলের মতো। চীনা কোম্পানির গাড়ি বলে কিছুটা নাক সিটকালেও নাটোর বেড়াতে গিয়ে গাড়িটি চালানোর সুযোগ হয়েছিল। চালিয়ে বেশ মজা পেয়েছিলাম। স্টিয়ারিং যেন শূন্যের উপর ভাসছে। ব্রেক কষার সাথে সাথে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, আবার সামনে এগুতে চাইলে অটোস্টার্ট নিচ্ছিলো। কোন কিছুতে ধাক্কা খাওয়ার উপক্রম হলে গাড়ি নিজে নিজে ব্রেক কষছিল। অটোমোবাইল সেক্টরে এসব জিনিস পুরানো হয়ে গেছে। কিন্তু চীনা গাড়িতে অপশনগুলো দেখে আমি চমকিত হচ্ছিলাম। বেশ আয়েশ করে গাড়িটি চালালেও তার জন্য বিন্দুমাত্র ভালোবাসার জন্ম হয়নি গাড়িপ্রেমিক এই আমার বুকে। কারণ ‘চীনা মালের’ শেষ ভরসা বলেতো আর কিছু নেই! তাই আমি গাড়ি কিনতে বা চালাতে চাইলে কখনো চীনা গাড়ি যে কিনবো না সেটি নিশ্চিত ছিলাম।
কিন্তু চীনে ডিডিকারের এই গাড়িটিতে চড়ে এবং রাস্তায় হাজার হাজার চীনা গাড়ির দোর্দন্ড প্রতাপ দেখে আমারও মনে শখ জাগলো যে, যদি একটি দেশে নিয়ে যেতে পারতাম! চীনের গাড়িকে এতোদিন যতোটা ফেলনা ভেবে আমি হেলা করেছিলাম, আসলে কিন্তু তা নয়। দিব্যি রাস্তা দাবড়িয়ে বিশ্ব দাবড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে চীনের গাড়ি কোম্পানিগুলো।
কথায় কথায় জানলাম যে, চীনে ইলেক্ট্রিক গাড়ির জয়–জয়কার চলছে। ২০১৬ সালের পর থেকে চীনের এই ইলেক্ট্রিক কার সেক্টর শনৈ শনৈ উন্নতি করেছে। এজন্য সরকার ৫৭ বিলিয়ন ডলার ( আমাদের পুরো বছরের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি) খরচ করেছে। বিশ্বের ইলেক্ট্রিক কারের বাজার দখল করতে চীনা সরকারের এই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ‘বিনিয়োগ’ বলেও জানতে পারলাম। ২০০৯ সালে চীন এই গাড়ির ট্যাক্স কমিয়ে দেয়। ২০১৪ সালে ওই কমানো ট্যাক্স আবার পুরোপুরি তুলে নেয়। শুধু এখনই নয়, আগামী ২০২৭ সাল পর্যন্ত এই গাড়ি কিনতে কোনো ট্যাক্স দিতে হবে না ক্রেতাকে। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থের নিশ্চিত ট্যাঙ আয় থেকে সরকার বঞ্চিত হয়েছে, দিয়েছে সাবসিটি। এটাকেও ‘বিনিয়োগ’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। আর এই বিনিয়োগের সুফলও চীন ঘরে তুলতে শুরু করেছে।
২০২৩ সালে চীনে প্রায় ১ কোটি ইউনিট ইলেক্ট্রিক গাড়ি বিক্রি হয়েছে। যা ২০২২ সাল থেকে ৩৮ শতাংশ বেশি। শুধু নিজের দেশেই নয়, চীন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইলেক্ট্রিক গাড়ি রপ্তানি করছে। গত বছর প্রায় ১৭ লক্ষ গাড়ি বিভিন্ন দেশে বিক্রি করা হয়েছে। যা ২০২২ সাল থেকে ৫৭ শতাংশ বেশি। এই প্রবৃদ্ধির মানে হচ্ছে বিশ্বে ইলেক্ট্রিক গাড়ির চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে চীনা গাড়ির উপর আস্থাও বাড়তে শুরু করেছে।
যাক, চীনা গাড়ি নিয়ে অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে পথ চলা ফুরিয়ে এলো আমাদের। শহরের নানা অঞ্চল ঘুরে আমরা বেটির বাসাটি যেই আবাসিক এলাকায় সেখানে এসে পৌঁছলাম। বিশাল গেটের সামনে আমাদের গাড়ি দাঁড়াতেই ছুটে এলো র্যাবের মতো কালো পোশাকধারী সুঠামদেহী এক দারোয়ান। কোন বাসায় যাবো তা নিশ্চিত হতে কি কি সব জানতে চাইলেন। ব্যাপারটি ডিল করছিল লায়ন ফজলে করিমের বড় ছেলে ধ্রুব। চীনা ভাষায়। করিম ভাই ফোন করলেন বেটিকে। বাসার ব্যাপারে ডিটেইলস বলার পর বিশাল গেটটি স্বয়ংক্রীয়ভাবে খুলতে শুরু করলো। রিমোট কন্ট্রোলড। আমরা ভিতরে ঢুকে গাড়ি ছেড়ে দিলাম। বেটি করিম ভাইকে ফোন করে বললেন যে, আপনারা গেটের কাছে দাঁড়ান। আমি আসছি।’
একটু পরই হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে আমাদের কাছে এসে দাঁড়ালো বেটি, চীনা তরুণী। এক সন্তানের জননী বলে আগেই শুনেছিলাম। তবে অতিমাত্রায় সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে বুঝার উপায় নেই যে তার বিয়ে হয়েছে। বয়স অনুমান করাও কঠিন। মনে হচ্ছিল বিশ–বাইশ। কিন্তু আমি ইতোমধ্যে চীনা নারীদের সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি তাতে তাদের বিশ–বাইশ বছরের মনে হলেও ভিতরে ভিতরে যে চল্লিশ ছুঁয়ে যায় তা বুঝার উপায় থাকে না। আশি বছরের বুড়িও এমনভাবে শরীর ধরে রাখেন যে মনে হয় এই কদিন আগে পঞ্চাশ পেরোলেন! তাই বেটির বয়স–টয়স নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমি তার কথা শুনছিলাম। দারুণ কণ্ঠ মেয়েটির, বাচন ভঙ্গিও নজর কাড়ে। ইংরেজিতে দক্ষতাও অসাধারণ। সচরাচর চীনে ইংরেজির তেমন প্রচলন নেই বলেই জানতাম। এখন বেটির মুখে ইংরেজি শুনে মনে হলো, চীন ‘আগেকার দিন’কে বহু পেছনে ফেলে এসেছে।
বেটি আমাদেরকে নিয়ে তার এ্যাপার্টমেন্টের পথ ধরলো। অতি সুরক্ষিত ছোট্ট একটি আবাসিক এলাকা। আট–দশটি প্লট। সবগুলো প্লটেই সুউচ্চ সব টাওয়ার। টাওয়ারগুলোতে কয়েকশ’ এ্যাপার্টমেন্ট। সবগুলো টাওয়ারের সামনে দিয়ে চমৎকার চওড়া রাস্তা, রাস্তার পাশে শত সহস্র গাছ। নানা ধরনের ফলমূলের গাছও রয়েছে। সবই এজমালি। এই আবাসিক এলাকার বাসিন্দাদের যার ইচ্ছে তুলে নিয়ে যেতে পারে। আমার চোখে পড়লো বরই টাইপের লাল রঙের একটি ফলে ছেয়ে আছে অনেকগুলো গাছ। রঙের গোলমাল না হলে বরই বলেই ভুল করতাম। অনেকটা চেরি ফলের মতো, কিন্তু চেরি নয়। গাছগুলোর তলাতেও ঝরে পড়ে আছে অনেক ফল, অনেকটা ইউরোপে আপেল গাছের নিচে যেমোন বিছিয়ে থাকে আপেলের চাদর। আমি বেটির দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। বেটি কি যেনো একটি নাম বললো ফলটির। কিন্তু সে ছোট্ট খুকির মতো টুফ করে লাফ মেরে একটি ডাল নামিয়ে আনলো। যাতে অনেকগুলো পাকা ফল ভরে আছে। একটি একটি করে মুঠোভর্তি করে সে ফল পাড়লো। তারপর একটিকে হাতের তালুতে মুছে নিয়ে মুখে পুরে দিল। বাকি ফলগুলো আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো। আমিও তার মতো হাতের তালুতে মুছে নিয়ে মুখে পুরলাম। বাহ, দারুণ তো। টক–মিষ্টি টাইপের একটি অনুভূতিতে মুখ ভরে গেলো। আমার দেখাদেখি লায়ন ফজলে করিম ভাই, ডালিয়া ভাবী এবং ধ্রুবও গাছ থেকে ফল নিয়ে মুখে পুরলো।
একটু এগুতেই বেটি বললো, এটি তাদের আবাসিক এলাকার অফিস, পাশেই জিম। আমি কয়েক সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে জিমে ঢুঁ মারলাম। একতলা একটি ভবন। ডিজাইনটি নান্দনিক। দারুণ গোছানো। সবগুলো টাওয়ারের ভিড়ে এমন ভবনটি বেমানান হলেও কী যে সুন্দর লাগছিল। আরেকটু এগুতে পাশে একটি লেকের মতো। বেটি বললো, আবাসিক এলাকার সুইমিং পুল। নানা বয়সী মানুষ সুইম করছিল। শিশু কিশোরের দলও রয়েছে। নারী পুরুষের ভেদাভেদ নেই, শরীর চর্চার অংশ হিসেবেই মনে হয় সবাই মিলে পুলটি মাতিয়ে রেখেছে।
আমরা এগুলাম। বিশাল টাওয়ারের প্রবেশমুখে বড়সড় একটি গেট। আমাদের দেশের বড়লোকদের বাড়ির দরোজার মতো। দরোজার পাশেই মনিটর। তাতে আঙ্গুল ছোঁয়ানোর পাশাপাশি আগন্তকের মুখের স্কেনিং করা হচ্ছে। বুঝতে পারলাম যে, অনুমোদিত মানুষ ছাড়া অন্য কারো দরোজা খোলার সাধ্যি নেই। বেটি দরোজা খুলে আমাদেরকে লিফটে চড়িয়ে নিজের বাসায় নিয়ে এলো। বাসার সামনেও ডিজিটাল লক। বেটি কয়েকটি নম্বর ডিজিট করে দেয়ার সাথে সাথে দরোজা খুলে গেল। এগুলো পুরানো প্রযুক্তি। তবে চীনে এই প্রযুক্তি অনেকটা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, আমাদের দেশে তা এখনো দূর অস্ত! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।