(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
শহর–বন্দর, নদী এবং সাগরের উপর দিয়ে চক্কর মারতে মারতে আমাদের চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্সের বোয়িংটি বেশ নিচ দিয়ে চলছিল। বিমানে চড়ে বিশ্বের অন্যতম মেগাসিটি সাংহাই দেখতে খুব একটা খারাপ লাগছিল না। জানালার পাশে সিট হওয়ায় সবকিছু এতো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল হেলিকপ্টার রাইড দিচ্ছি! অবশ্য, হেলিকপ্টার রাইড এতো স্বস্তির হয় না। ভয়ংকর আওয়াজে কান ঝালাপালা করে দেয়। এখানে কোন আওয়াজ নেই, বিকট কোন শব্দ নেই। মেঘের রাজ্যে আলতো করে ভেসে থাকা। আগেও আমি সাংহাই শহরে ঘুরেছি। তাই সাংহাই নদী, সাংহাই টাওয়ার কিংবা শহরের আকাশছোঁয়া ভবনগুলো বেশ চেনা চেনা লাগছিল। কী জৌলুশ সাংহাই’র! কী দারুণ চাকচিক্য! অথচ বিশ বছর আগেও এমনটি ছিল না। পেছনের সারির একটি শহরকে কী করে যে বিশ্বের অন্যতম মেগাসিটিতে পরিণত করা যায়, সেই শিক্ষা চীনের কাছ থেকে নেয়া যায়!
শুধু কী শহর, সাংহাই বন্দরেরও যে কী এলাহী কাজ–কারবার! কত জাহাজ যে ভাসছে সাগরে! সারি সারি গ্যান্ট্রি ক্রেন যেন তাকিয়ে আছে সাগরের দিকে। ক্রেনগুলো জেটিতে বার্থিং নেয়া জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানো–নামানোর কাজ সারছে। যেনো আরো দাও, আরো দাও। সব নামিয়ে ফেলবো, কিংবা সব তুলে দেবো জাহাজে। সাংহাই বন্দর থেকে নোঙর তোলা শত শত মাদার ভ্যাসেল পৃথিবীর দেশে দেশে কী পরিমাণ পণ্য যে পরিবহন করে তা ভাবলেই মাথা চক্কর মারে। বছরে প্রায় ৫ কোটি, জ্বী এক বছরে ৫ কোটি কন্টেনার হ্যান্ডলিং করে এই বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত এই সাংহাই বন্দর। বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যস্ততম বন্দর সিংগাপুর করে বছরে ৪ কোটি কন্টেনারের কাছাকাছি। বিশ্বের প্রথম এবং দ্বিতীয় ব্যস্ততম বন্দরের মধ্যে এক কোটি কন্টেনারের ফারাক আমার কাছে বেশ আশ্চর্য লাগে। আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর বছরে ৩০ লাখের কিছু বেশি কন্টেনার হ্যান্ডলিং করে। সাংহাই এবং সিংগাপুর হওয়া তো দূরের কথা, তাদের যে ব্যবধান সেটি অর্জন করতেই আমাদেরকে আরো বহু বহু বছর নয়, বহু যুগ অপেক্ষা করতে হবে। দৈনিক আজাদীতে শিপিং নিউজ কাভার করার সুবাদে সাংহাই কিংবা সিংগাপুর বন্দরের ব্যাপারে টুকটাক তথ্য কিংবা খোঁজ খবর আমাকে রাখতে হয়। তাই এই বন্দরগুলো নিয়ে কিছু লেখাপড়াও করেছিলাম। এখন সেই বন্দরের উপর দিয়ে চক্কর দিতে গিয়ে বেশ রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম। এখানে আরো একটি তথ্য হয়তো দেয়া যেতে পারে যে, ২০১০ সাল পর্যন্ত সিংগাপুর ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম বন্দর। কিন্তু তারপর থেকে সাংহাই কেবলই এগুচ্ছে। সিংগাপুর আর কখনো সাংহাইর নাগাল পায়নি। সাংহাই কেবলই টপকে টপকে যাচ্ছে। বিশ্বের কারখানা খ্যাত চীনের আরো বেশ কয়েকটি বন্দর দুনিয়ার ব্যস্ততম কন্টেনার পোর্টের তালিকায় প্রথম দশটিতে রয়েছে। এমন একটি বন্দরের শান–শওকত তো আলীশান হবেই!
কখন যে আমাদের বোয়িংটি রানওয়ের কাছাকাছিতে চলে এসেছে খেয়াল করতে পারিনি। আচমকা ধাক্কা খেয়ে বুঝতে পারলাম যে, বিমান রানওয়ে ধরে ছুটছে। আড়াইশ’ কিলোমিটার বেগের একটি বাহনকে মাত্র চার কিলোমিটার দৈর্ঘের একটি রানওয়েতে বশ করা সহজ কথা নয়। শুরুতে কোন ব্রেক কষা যায় না। মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় ব্রেক কষা। রানওয়ের শেষ দিকে এসে বিমানটি থেমে যায়। কী আশ্চর্য এক কৌশলে যে এতো বড় একটি বাহনকে বশ করা হয় কে জানে! জানালা দিয়ে খেয়াল করে দেখলাম যে, আমাদের প্রায় সমান্তরালে আরো একটি বিমান ল্যান্ড করছে এবং অপর একটি রানওয়ে থেকে একটি বিমান উল্টো দিকে ছুটছে। মনে হলো সেটি আকাশে ওড়বে। অবশ্য পরবর্তীতে আমি জেনেছিলাম যে, সাংহাই এয়ারপোর্টে একইসাথে চারটি বিমান ওঠানামা করতে পারে। তাদের চারটি প্রায় সমান দৈর্ঘ্যের সমান্তরাল রানওয়ে রয়েছে। আহা, বুকের ভিতরটায় কেমন যেনো করে!
সাংহাই বিমানবন্দরে আমাদের তেমন কোন কাজ নেই। বিমান থেকে নামার পর লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। ইমিগ্রেশনের কোন ঝামেলা নেই। ‘চেক টেকে’রও কোন ব্যাপার নেই। ডোমেস্টিকের যাত্রী হিসেবে একজন চীনা নাগরিক যেভাবে বের হবেন আমরাও একইভাবে বেরিয়ে যাবো।
আমাদের বোয়িংটি রয়ে সয়ে বোর্ডিং ব্রিজের দিকে যাচ্ছিল। বিমানের এই হেঁটে হেঁটে সামনে এগিয়ে যাওয়াটা দারুণ লাগে আমার। ঝড়ের গতি তোলা একটি বাহনকে ‘লুলা’ মানুষের মতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে দেখলে কার না মজা লাগে। অবশ্য বিমানের এমন পথ চলা থেকে জীবনের জন্য কঠিন একটি শিক্ষাও নেয়া যায়। যদিও বিমানে যারা চড়েন তারা কিংবা আমি কখনো সেই শিক্ষাটা নিই বলে মনে হয় না। ক্ষমতা সবসময় থাকে না। সবসময় আকাশেও উড়া যায় না, গতিও সবসময় একইরকম থাকে না। সময় যে একসময় অন্যরকম হয়ে যায় সেটি মনে রাখলে পৃথিবীতে বহু অশান্তি থাকতো না।
বিমানের দরোজা খুলে দেয়া হয়েছে। যাত্রীরা নামছে। সবাই সভ্য–ভব্য। হুড়োহুড়ি নেই। চিৎকার চেঁচামেচিও নেই। বিমান থামার আগে ওভারহেড কেবিন খুলে ফেলার মতো ঘটনাও চোখে পড়েনি। আমাদের দেশে কর্মরত চীনারা কিছু উল্টা–পাল্টা করলেও নিজের দেশে যে চীনারা বেশ সভ্য তা বুঝতে পারছিলাম। দেশের উন্নতির সাথে সাথে ব্যক্তি জীবনের সবকিছুতেও যে তারা বেশ ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে তাও যেনো দেখা যাচ্ছিলো খোলা চোখে।
সাংহাই বিমানবন্দরের কথা আলাদাভাবে কী আর বলবো! চোখ ধাঁধানো আয়োজন চারদিকে। হাজার হাজার মানুষ ডোমেস্টিক টার্মিনালে। আমরা যেখানে অবস্থান করছি সেখানে সবই ‘এ্যারাইভাল’ যাত্রী। চীনের নানা অঞ্চল থেকে তারা সাংহাই এসেছেন। এ্যারাইভালে এই অবস্থা! ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালের অবস্থা কেমন কে জানে!!
লাগেজ নিতে হবে। আমরা বেল্ট এরিয়ার দিকে গেলাম। এতো বেশি বেল্টে লাগেজ ঘুরছিল যে, আমার মাথা ঘুরতে শুরু করলো। কত নম্বর বেল্টে আমাদের লাগেজ দেয়া হবে দেখে নিয়ে সামনে এগুলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওই বেল্টে পৌঁছে দেখি সেখানে তখন অন্য ফ্লাইটের লাগেজ ঘুরছে। এটি শেষ হলে আমাদেরগুলো দেয়া হবে। কী সুন্দর করে ওখানে ঘোষণাটি ডিসপ্লে করা হচ্ছে! আহারে বিমানবন্দর, আহারে আয়োজন! হিংসে লাগে, বুক জ্বলে!!
লায়ন ফজলে করিম লিটন ভাই আগে আগে, ভাবী মাঝে আর আমি পেছনে পেছনে পথ চলছি। করিম ভাই সব পথঘাট চিনেন, তাই আমি আগে গিয়ে আর হারিয়ে যাওয়ার রিস্ক নিচ্ছিলাম না। বিমানবন্দরে আমাদের জন্য করিম ভাইয়ের বড় সন্তান ধ্রুব অপেক্ষা করার কথা। করিম ভাইয়ের দুই ছেলেই চীনে লেখাপড়া করে। একজন সাংহাইতে, অপরজন গুয়াংজুতে। দু’জনের সাথেই আমার পরিচয় রয়েছে। গতবারও দুজনের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। দুই তরুণই দারুণ দক্ষ চীনা এবং ইংরেজী ভাষায়। তারা সাথে থাকলে আমাদের আর কথা বলতে হয় না, সবকিছু তারাই করে। এবারও সাংহাইতে আমাদের সবকিছু বড়পুত্রই দেখভাল করবে বলে করিম ভাই দেশেই আমাকে জানিয়েছেন।
বিদেশে নিজের সন্তান থাকা কিংবা একজন পরিচিত লোক পাওয়া যে কী পরিমান স্বস্তির তা বলে বুঝানো সম্ভব নয়। বিশেষ করে চীনে গিয়ে যেখানে ভাষাগত সংকট প্রকট সেখানে একজন চীনাভাষী স্বজন থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। পুত্রটি করিম দম্পতির হলেও ‘আংকেল’ হিসেবে আমারও কিছুটা হক রয়েছে। তাই বেশ নির্ভার আমি।
বিমানবন্দরের এক্সিট ডোরের সামনে কোন জটলা নেই। আমাদের বিমানবন্দরের মতো ড্রাইভার কিংবা স্বজনদের ভিড় নেই। দরোজার সামনে বেশ বড়সড় একটি জায়গা ঘেরা দিয়ে রাখা। পুলিশ যেমন ঘটনাস্থল ঘিরে রাখে এখানেও ফিতা দিয়ে তেমন করে ঘিরে রাখা হয়েছে। ওই ঘেরের ভিতরে কোন মানুষ নেই, কোন জটলা নেই। একেবারে ফাঁকা। যাত্রীরা টার্মিনাল থেকে বের হয়ে খালি জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে যেনো স্বস্তিতে অপেক্ষমাণ মানুষদের দেখে নিজের স্বজনকে খুঁজে নিতে পারেন সেজন্য বিশেষ এই ঘেরের আয়োজন। দরোজা থেকে বের হতেই আমার চোখ গিয়ে পড়লো ধ্রুব’র উপর। সে তার বাবা মায়ের দিকে চরম এক আকুতি নিয়ে তাকিয়ে আছে। কতদিন পর দেখা!
আহা, সন্তান! পিতামাতার প্রতি কী মমত্ব আর আকুতি ধ্রুব’র চোখে!! আমি মুগ্ধ হয়ে ধ্রুব’র চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।