(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চীনের ব্যস্ততম গুয়াংজু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডোমেস্টিক টার্মিনালের শান–শওকত দুনিয়ার বহু দেশের প্রধান বিমানবন্দরের চেয়ে বেশি। এই বিমানবন্দরে যাত্রীর সংখ্যার ধারে কাছে নেই পৃথিবীর বহু বিমানবন্দর। গুয়াংজু বায়ুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একদিনে যে পরিমাণ যাত্রী হ্যান্ডলিং করে পৃথিবীতে কোন কোনদেশে ওই পরিমাণ মানুষও বসবাস করে না। গুয়াংজু বিমানবন্দরে দৈনিক প্রায় ২০ লাখ যাত্রী হ্যান্ডলিং করে। বছরে এই সংখ্যা সাত কোটির কাছাকাছি। একটি বিমানবন্দরে দৈনিক যদি বিশ লাখ মানুষ আসা যাওয়া করেন সেখানে ভিড়ভাট্টা কেমন হবে তা কী লিখে বুঝানো সম্ভব!
লাউঞ্জের ভিতরে হাজার হাজার মানুষ। বিশাল লাউঞ্জটিও দেখার মতো। কত ফ্লাইটের সিডিউল যে মনিটরে দেখানো হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। খেয়াল করে দেখলাম যে অভ্যন্তরীণ নানা গন্তব্যে প্রতি ৫/৭ মিনিট পরপরই ফ্লাইট উঠানামার সিডিউল প্রদর্শিত হচ্ছে। এদের যাত্রীর অভাব নেই, অভাব নেই এয়ারলাইন্সের। প্রতিটি এয়ারলাইন্সেরই অসংখ্য এয়ারক্রাফট। লায়ন ফজলে করিম ভাই আমাকে ডিজিটাল মনিটরটি দেখিয়ে বললেন, একটা জিনিস খেয়াল করেছেন লিডার? এদের কত যাত্রী! ভাড়াও কিন্তু কম। আমি করিম ভাইকে বললাম যে, এদের ভাড়া কম বলে বেশি মানুষ বিমানে চড়ে, আবার বেশি মানুষ বিমানে চড়ে বলে এরা কম ভাড়ায় পরিবহন করতে পারে। এটা একটা চেইন। এই চেইনে যারা সফল হয়েছে তারাই এভিয়েশন ব্যবসায় সাফল্য পেয়েছে। আমাদের যাত্রী কম, এয়ারলাইন্স কম, ৩/৪টি এয়ারক্রাফট নিয়ে ব্যবসায় নামে। কিছুদিন পর লালবাতি জ্বালিয়ে চলে যায়। ভাড়া বেশির জন্য আমাদের মানুষ বিমানে চড়তে পারে না, আবার যাত্রী পায় না বলে এয়ারলাইন্স ভাড়া কমিয়ে রাখতে পারে না। দুষ্টু একটি চক্রের মধ্যে পড়ে আছি আমরা। এই চক্রের শেষ কোথায় কে জানে!
আমাদের সাংহাই যাওয়ার ফ্লাইটের আরো দেরি আছে। তবে বোর্ডিং ওপেন আছে। ইচ্ছে করলে আমরা লাগেজ দিয়ে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে নিতে পারি। লায়ন ফজলে করিম বললেন, বোর্ডিং করে ফেলি। তারপর বসে থাকলেও খারাপ লাগবে না। আমরা লাইনে দাঁড়ালাম। এখানে লাইনের কোন বিকল্প নেই। সর্বত্রই সবকিছু কিউ মেনে করতে হয়। আমাদের আগে আরো কয়েকজন যাত্রী রয়েছেন। চীনা নাগরিক বলে মনে হলো। অবশ্য লাউঞ্জে কত দেশের কত জাতের মানুষ যে রয়েছে তা গুনে শেষ করা অসম্ভব। আবার আমি যাদের চীনা ভাবছি, খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের অনেকেই হয়তো হংকং, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান বা কোরিয়ার। চীন এবং সন্নিহিত অঞ্চলের সবগুলো দেশের নাগরিকের চেহারাই প্রায় একই রকম। ফর্সা, স্লিম, নাক চ্যাপ্টা।
লাগেজ গছিয়ে বোর্ডিং কার্ড নিলাম। উইন্ডো সিট চেয়েছিলাম, চ্যাপ্টা নাকের সুন্দরী নিরাশ করেননি। আমাকে একটি এবং ভাবী এবং করিমভাইকে একটি উইন্ডো দেয়া হলো। তিন সিটের রো, লায়ন করিম ভাই যে স্যান্ডউইচ হবেন তা বুঝতে পারছিলাম। ঝাড়া হাত পা নিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসলাম। বসার ব্যবস্থাও ভালো। আলীশান লাউঞ্জের সাথে মিল রেখেই চেয়ার সোফা পাতা হয়েছে।
কফি পোড়া গন্ধে ভিতরটা নড়ছিল অনেকক্ষণ ধরে। করিম ভাইকে কথাটি বলতেই তিনি হাসলেন। ভাবী মাথা নাড়লেন, খাবেন না। ভাবীর কাছে কেবিন ব্যাগ রেখে আমরা কফিশপের দিকে হাঁটতে লাগলাম। ওখানেও কিউ। অতএব লাইনে দাঁড়াতে হলো। ক্রেডিট কার্ড থেকে যে টাকা কাটলো তাতে মনে হলো কফি বেশ সস্তা। আমাদের বিমানবন্দরের লাউঞ্জের মতো গলা কাটলো না। হাতে সময় আছে। তাই রয়ে সয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছিলাম।
নিরাপত্তা তল্লাশীর ধকল সয়ে আমরা যখন বিমানে চড়ে বসলাম আমার শরীরটি কেমন যেনো মরে আসছিল। ঘুমে চোখ খুলতে পারছিলাম না। কিন্তু বিমানে তো ঘুম হবে না। গুয়াংজু থেকে সাংহাই’র দূরত্ব দেড় হাজার কিলোমিটার। দুই ঘন্টারও বেশি সময় লাগবে। ঘন্টা দুয়েকের জন্য একটি ঘুম দিতে পারলে ভালো হতো। শরীরটা ঝরঝরে হয়ে যেতো। উইন্ডো সিট হওয়ায় হেলান দেয়ার বাড়তি সুবিধা থাকে। একপাশে এয়ারক্রাফটের বডির সাথে লাগিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলে কিছুটা সুবিধা পাবো বলে মনে হলো। কিন্তু নিদ্রার মহারাণীকে পটাতে পারবো কিনা বুঝতে পারছিলাম না। সিটের উপর থাকা হালকা কম্বলটা খুলে চোখের উপর দিয়ে কাৎ হলাম।
বুঝতে পারছিলাম বিমান চলতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে এগুচ্ছে রানওয়ের দিকে। চোখের উপর কম্বল থাকলেও আমি টের পাচ্ছিলাম যে, এয়ারক্রাফটটি বাসের মতো চলতে চলতে রানওয়েতে গিয়ে ঝড়ের গতি তুলবে। সবই ঠিকঠাকভাবে হচ্ছে। নিদ্রাদেবীর নড়াচড়াও বুঝতে পারছিলাম। আমি খুব করে চাচ্ছিলাম যেন মোলাকাতটা ঘটে।
কি কি স্বপ্ন দেখছিলাম মনে নেই। কিন্তু আলতো করে হাতের ছোঁয়া এবং ‘স্যার’ শব্দে সব স্বপ্ন উবে গেল। পালিয়ে গেলো নিদ্রার রানিও। চোখের উপর থেকে কম্বল সরিয়ে দেখি, রানি নেই, চ্যাপ্টা নাকের এক তরুণী নাস্তার প্যাকেট বাড়িয়ে ধরে আছেন। মেজাজ খারাপ হলেও বুঝতে দিলাম না। মুখে হাসি ঝুলিয়ে ‘থ্যাঙ্কু’ বলে সেটি সামনের ছোট্ট টেবিলটির উপর রেখে আবারো কম্বল টানলাম। কিন্তু একবার ধরা পড়া প্রেমিকা কী দ্বিতীয়বার আর অভিসারে আসে!
খিটখিটে মেজাজ নিয়ে আমার মনে হলো, কেবিন ক্রুদের বহু ধরনের ট্রেনিং দেয়ার পরই আকাশে পাঠানো হয়। ঘুমন্ত যাত্রীকে না জাগানোর ট্রেনিং কী তাদের দেয়া হয় না! বহু যাত্রীই বাসে বা বিমানে ঘুমাতে পারেন না। এরা বহু কসরত করে ঘুমের নাগাল পান। তাদেরকে নাস্তা বা অন্য কোন খাবারের জন্য এভাবে ঘুম থেকে ডেকে তোলার চেয়ে মাথার উপর কষে লাঠি মারাও ভালো। নাস্তা পরেও তিনি দিতে পারতেন, না দিলেও সমস্যা ছিল না। কিন্তু ঘুমের বারোটা বাজিয়ে তিনি আমার দিনটিই নষ্ট করে দিলেন।
না, ঘুম আর আসছে না। নাস্তার প্যাকেট খুললাম। বিমানের যতগুলো টিকেট করা হয়েছে সবগুলোতেই আমাকে ‘এমএমএল’ ট্যাগ লাগানো খাবার দেয়া হবে। সুতরাং অখাদ্য বা কুখাদ্য যে কিছু আমাকে দেবে না সেটা নিশ্চিত। স্যান্ডউইচ টাইপের একটি খাবার দিল। সাথে নুডলস টাইপের কিছু। আকাশের এতো উঁচুতে বসে নাস্তা করার কথা মনে হতেই ভালো একটি অনুভূতি হলো। নাস্তার স্বাদের চেয়ে এই অনুভূতি শানদার।
চা কফি দেয়া হচ্ছিল। কফিই নিলাম। কফিতে চুমুক দিতে দিতে জানালায় চোখ রাখলাম। কত ধরনের মেঘের খেলা যে বাইরে চলছিল। কোথায় থেকে কোথায় উড়ে উড়ে যাচ্ছে মেঘ। কত ধরনের মেঘ, সাদা সাদা, কালো কালো। অন্যান্য রঙের মেঘেরও দেখা মিললো। কোনটি পাহাড়ের মতো, কোনটি হাতির মতো, কোনটি বা ঘোড়ার। মানুষের মিছিলের মতো মেঘেরও মিছিল চোখে পড়লো। বিমান থেকে নিচে মেঘের জমিন। কত রকমারি আয়োজন আকাশ জুড়ে, কত ডিজাইন! আহা, কোন শিল্পীর এই অনন্য কারুকাজ!
আমাদের বিমান অবতরণের ঘোষণা দেয়া হলো। ককপিট থেকে পাইলট সাংহাইর আবহাওয়া এবং সময়সহ প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো জানিয়ে দিলেন। পরবর্তীতেও তাদের ফ্লাইটে চড়ার আগাম দাওয়াত দিতেও ভুললেন না। এটা সব পাইলটই করেন, তিনিও করলেন। বিশেষ কোন নতুনত্ব নেই, তোতাপাখীর মতো এগুলো বলা হয়। আমরা আকাশে চক্কর দিচ্ছিলাম। নিচের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সাংহাই শহরের উপর, সাগরের উপর ঘুরছিলাম আমরা। বুঝতে পারছিলাম যে, ফ্লাইট ল্যান্ডিং এর ক্লিয়ারেন্স না পাওয়ায় আমাদের চক্করে পড়তে হয়েছে।
সাংহাই পৃথিবীর ব্যস্ততম একটি বন্দর শহর। পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত একটি মেগাসিটি। এই শহরের যে বিমানবন্দর তাতে তো ফ্লাইটের আনাগোনা থাকবেই। এই বিমানবন্দরে বছরে প্রায় ৬ কোটি যাত্রী হ্যান্ডলিং করে। কার্গো বিমানে পরিবহন করা হয় বিপুল পরিমাণ পণ্য। যাত্রী এবং পণ্য পরিবহনের শত শত ফ্লাইট হরদম উঠানামা করে এই বিমানবন্দরে। চীনের ১২টি এয়ারলাইন্স কোম্পানি এই বিমানবন্দরকে তাদের হাব হিসেবে ব্যবহার করে। অতএব আকাশে চক্করে তো পড়তেই হবে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।