দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৩১ জুলাই, ২০২৪ at ১১:০৫ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বিমানে বা গাড়িতে আমার ঘুম আসেনা। নানাভাবে আকুতি জানিয়েও পটানো যায় না নিদ্রাদেবীকে। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ পড়ে থাকলেও রাণীর মন গলে না। তাই বাধ্য হয়ে এদিকওদিক তাকিয়ে কিংবা একে ওকে দেখে সময় পার করতে হয়। ছোটখাটো জার্ণিতে সমস্যা না হলেও লং জার্ণিগুলো মাঝে মাঝে আমার কাছে অসহ্য লাগে। কিন্তু নেশার কারণে এই ‘অসহ্য’কে হজম করি, ঘুরে বেড়াই। ঢাকাগুয়াংজুর দূরত্ব আড়াই হাজার কিলোমিটারের মতো। চার ঘন্টার কিছু বেশি সময়ের ফ্লাইট। এটাকে কোনভাবেই লংজার্ণি বলা যায় না। তাই নিদ্রাকন্যাকে পটানো নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাচ্ছিলাম না। তাছাড়া আমার পাশের চীনা তরুণ তরুণীর যে লীলা চলছিল, তাতে সেখানে অন্য কারো কাছঘেঁষার সুযোগ আছে বলেও আমার মনে হচ্ছিল না।

স্ক্রিনে চোখ রেখে ফ্লাইট ইনফো দেখে সময় পার করছিলাম। সরাসরি কিংবা আড়চোখে বিমানের ভিতরে চোখ বুলাচ্ছিলাম। সামনের টেবিলে পড়ে ছিল আমাকে দেয়া বিশেষ খাবারের প্যাকেট। মুসলিম মিল হিসেবে দেয়া প্যাকেটটিতে কি আছে কে জানে! চায়না সাউদার্ণ এয়ারলাইন্স কী খাবার যোগাড় করেছে তা দেখারও ইচ্ছে হচ্ছিল না। বিমানে চড়ার আগ দিয়ে লাউঞ্জে ফ্রি খাওয়া দাওয়া সেরে আসায় আমার ক্ষুধাও ছিল না। এয়ার ইনফোতে বুঝতে পারছিলাম যে, আমরা গুয়াংজুর আকাশসীমার কাছাকাছিতে পৌঁছে গেছি। বিমান ল্যান্ড করার সময় সামনের টেবিল বন্ধ করে ফেলতে হবে। তার আগে খাবারের প্যাকেটটির একটি সদগতি না করলে ঝামেলা হবে। তাই বিশেষ প্যাকেটটি খুলে কিছু খাওয়া যায় কিনা সেটা দেখার উদ্যোগ নিলাম। প্যাকেটের ভিতরে আতব চালের কিছু ভাতের পাশে ম্যাশড পটেটো এবং বরবটি, ঢেঁড়শ এবং লেটুস পাতা দিয়ে একটি সবজি। ডালের মতোও কিছু একটা দেয়া হয়েছে। চীনারা সব সবস্টিক দিয়ে খাওয়া দাওয়া করলেও এখানে চামুচ দেয়া হয়েছে। ম্যাশড পটেটো হচ্ছে আলু ভর্তার উন্নত বা অনুন্নত সংস্করণ। বাঙালীর আলুভর্তার স্বাদ বিদেশী ম্যাশড পটেটোতে থাকে না। আমি একটুখানি চেখে দেখলাম। অবশ্য সবজিটা পুরোই খেলাম। স্বাদও খারাপ না। খাবারের শেষে কল লাইট জ্বালিয়ে কেবিন ক্রুর নজর কাড়ার চেষ্টা করলাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই এক চীনা তরুণী হাজির হলেন। তিনি শুরুতেই শরীর বাঁকিয়ে আমার কল লাইন বন্ধ করলেন। জানতে চাইলেন কি সাহায্য করতে পারেন। আমি খাবারের প্যাকেটসহ টেবিলের সবকিছু গুছিয়ে ওনার হাতে দিয়ে কাতর কণ্ঠে বললাম, একটু গরম কফি হলে ভালো হতো। বেচারী দুহাতে প্যাকেট ধরে সুন্দর করে হাসলেন। ‘শিউর’ বলে হাসি বিলিয়ে চলে গেলেন।

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে মাথা উঁচিয়ে সামনের সিটে বসা বন্ধু লায়ন ফজলে করিম এবং ডালিয়া ভাবীকে একবার দেখলাম। বেঘোরে ঘুমুচ্ছেন দু’জন। ছোটখাটো স্লিম শরীরের করিম ভাই ইকোনমি ক্লাসের সিটে দিব্যি বিজনেস ক্লাসের আয়েশ করছিলেন। ভাবীর ঘাড়টি বাঁকা হয়ে আছে। সোজা করে দিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু পরের বউ! জানি মামলা মোকর্দমা হবে না, কিন্তু তাই বলে মাথায়তো আর হাত দেয়া যায় না! আবার ঘুম ভাঙিয়ে দিতেও ইচ্ছে করলো না।

পাইলট ফ্লাইট ল্যান্ডিংয়ের ঘোষণা দিলেন। সিট বেল্ট বাঁধার অনুরোধ জানিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে আমরা গুয়াংজুতে পৌঁছবো বলে জানালেন তিনি। গুয়াংজুর লোকাল সময় এবং তাপমাত্রাও জানিয়ে দিলেন। আমার সিট বেল্ট আগে থেকেই লাগানো। তাই নতুন করে বেল্টের দুই মাথা খোঁজাখুজি করতে হলো না। দিব্যি বসে থেকে আমি বত্রিশ হাজার ফুট উপর থেকে নিচের দিকে নামার সময়টা উপভোগ করতে লাগলাম। স্ক্রিনে কত ফুট থেকে কত ফুট করে নামছি তাও দেখা যাচ্ছিল। প্রতি মিনিটে গড়ে একশ’ ফুটের বেশি করে নিচের দিকে নামছিল আমাদের বাহন। শুধু স্ক্রিনে নয়, আমি শরীরেও টের পাচ্ছিলাম যে, বিমান নামছে।

উইন্ডো সিটে বসায় পাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাইরে তাকিয়ে কি হবে! এতো রাতেও তো আর সেখান থেকে কিছু দেখা যাবে না। তবুও বাইরে তাকিয়ে রাতের আকাশ দেখতে লাগলাম। কী বিচিত্র আকাশ, কী বিচিত্র প্রকৃতি, কত বিচিত্র মেঘমালা! আহা, কোন কারিগর এসব বানিয়েছেন? কোন ম্যানেজার এসব ম্যানেজ করছেন। একটি অফিস চালাতে মানুষ হিমশিম খায়, এতো বড় পৃথিবী কী করে ম্যানেজ হচ্ছে!

আকাশ থেকে নিচের দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পাহাড় নাকি সমুদ্র পার হচ্ছি তা বুঝার কোন সাধ্য নেই। দূরে দূরে কিছু কিছু আলোর ঝলক দেখা যাচ্ছিল। হয়তো কোন জনপদ, কিংবা শহর। তবে সবটা আমার নিকট একেবারেই অচিন। জীবনে বহুবার বিমানে চড়েছি, আকাশ থেকে রাতের শহরও কম দেখা হয়নি। তাই নিচের অচিন জনপদগুলোর আলো আমাকে খুব একটা টানছিল না। আমাদের বিমান ১০ হাজার ফুটের নিচে নেমে এসেছে। আকাশ থেকে নিচের আলোগুলো অনেক উজ্জ্বল মনে হচ্ছে। বিমান আরো নামলো। আলোর একটি ঝলকানি যেনো চোখে এসে ধাক্কা দিল। আমি বুঝতে পারলাম যে, ওটাই গুয়াংজু। চীনের অনেক সমৃদ্ধ একটি বন্দরশহর।

গতবারও আমি এই গুয়াংজুর বায়ুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেছিলাম। ঢাকা থেকে চীনের গুয়াংজু এবং কুনমিংয়ে সরাসরি ফ্লাইট চলাচল করে। এখান থেকে পরবর্তী গন্তব্যের বিমান বা দ্রুতগতির ট্রেন ধরে ছুটেন বাংলাদেশ থেকে আসা পর্যটক এবং ব্যবসায়ীরা। আমাদের বিমানটি আকাশে চক্কর মারছিল। বুঝতে পারছিলাম যে, নিচে নামার ক্লিয়ারেন্স পাচ্ছে না। গুয়াংজু বিমানবন্দরকে খুব সাধারণ একটি বিমানবন্দর বলে মনে করতাম আমি। কিন্তু গতবার চীন ভ্রমণের সময় আমার সেই ভুল ভেঙে গেছে। এই বিমানবন্দর থেকে প্রচুর ফ্লাইট বিশাল চীনের অভ্যন্তরীন নানা গন্তব্যে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাতে দিনে উড়ে, নামে। তাই এই বিমানবন্দরের রানওয়ের ক্লিয়ারেন্স পেতে কিছুটা বাড়তি সময় লাগে। গতবার বিষয়টি জানার পর আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম। তবে এবার আর আমি অবাক হচ্ছি না। আমি জানি যে, রানওয়ে ক্লিয়ারের জন্য আকাশে যে এয়ার ট্রাফিকের জটলা হয়েছে সেটা ক্লিয়ার হলেই আমাদের বিমান নামবে।

ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর বেশ দক্ষতার সাথে আমাদের বোয়িংটি নামালেন পাইলট। যেনো আলতো করে মায়ের বুকে আস্ত এয়ারক্রাফটি বসিয়ে দিলেন! রানওয়ে ধরে ছুটছে আমাদের বোয়িং। ক্রমে গতি কমিয়ে আনা হচ্ছে। এয়ারক্রাফটের ভিতরে ফোনগুলো টুংটাং করে বাজতে শুরু করেছে। টেক্সট আসারও শব্দ হচ্ছে। মোবাইল নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার সাথে সাথে দেশের সব বিমানবন্দরের সব ফ্লাইটে এমনটি ঘটে থাকে। বিশেষ করে স্থানীয়দের মোবাইলে কল আসতে থাকে। বিদেশী যাত্রীদের মধ্যে যারা নিজের ফোন রোমিং করে নিয়ে যান, তাদের ফোনগুলোও সচল হওয়া জানান দেয় এভাবে।

আমার দেশি ফোনটিও কয়েকবার শব্দ করলো। টেক্সট খুলে দেখলাম যে, চীনা একটি মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়ে গেছি আমি। যাওয়ার সময় ফোনটি রোমিং করে নিয়েছিলাম। দেশি ফোন রোমিং করে বিদেশে চালানোর খরচ অনেক। কল রিসিভ করলেও চড়া টাকা গুনতে হয়, কল করলে তো কথাই নেই। কড়কড় করে টাকা কাটে। তাই বিদেশ যাওয়ার সময় আমি কখনো ফোন রোমিং করতাম না। তবে এবার লায়ন ফজলে করিম ভাই আমাকে ফোনটি রোমিং করিয়ে নেয়ার পরামর্শ দেন। আমি কোন আউটগোয়িং কল না করা বা ইনকামিং কল রিসিভ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে শুধু ইন্টারনেট ডাটা ব্যবহারের জন্য ফোন রোমিং করি। ঢাকা এয়ারপোর্টে মোবাইল অপারেটরের ডেক্স থেকে একটি ডাটা প্যাকেজও কিনে নিই। এটা না করলে চীনে গিয়ে গুগল, হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুকের মতো জীবনসঙ্গী হয়ে উঠা ব্যাপারগুলো থেকে ছিটকে পড়তে হবে। চীনে ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপ নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ গুগলও। উইচ্যাট বা সিনা ওয়েইবো নামের নিজেদের সাইটে তারা তাদের কাজ চালায়। এগুলো বেশ জনপ্রিয়ও। সিনে ওয়েইবো বা উইচ্যাট বাণিজ্যিকভাবেও গগুল কিংবা ফেসবুককে টক্কর দিচ্ছে বহু বছর ধরে। চীনে জনপ্রিয় এবং বহুল ব্যবহৃত হলেও একজন পর্যটক ঠিকঠাকভাবে এগুলো ইউজ করতে পারেন না। গতবার আমি মোবাইলে উইচ্যাট ইনস্টল করে রেখেছিলাম। সেটি আছে। তবে সেটি দিয়ে দেশের সব যোগাযোগ সামলে নেয়া সম্ভব নয়। তাই হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক এবং গুগল চালানোর জন্যই মূলতঃ ফোনটি রোমিং করে দেশ ছেড়েছিলাম। আর রোমিং করানোর সুফল হিসেবে বিমান থেকে নামার আগেই আমার ফোন জানান দিচ্ছে যে, আমি ঠিকঠাকভাবে নেটওয়ার্কে আছি। এখন বুঝতে পারলাম যে, লায়ন ফজলে করিম জীবনে আরো অনেক বুদ্ধির মতো এই বুদ্ধিটিও আমাকে ভালোয় দিয়েছিলেন! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘বাঙালির ধ্রুবতারা বঙ্গবন্ধু’ : প্রশংসাযোগ্য আয়োজন
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ