দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৪ জুলাই, ২০২৪ at ৩:২৮ অপরাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

চীনের গুয়াংজুমুখী ফ্লাইটে জানালার পাশে বসেছি। বিমানযাত্রায় এটিকেই আমার সবচেয়ে আরামের সিট মনে হয়। তাই যখনি চেকইন করি তখনি হাসি হাসি মুখ করে উইন্ডো সিটের অনুরোধ করি। কখনো পাই, কখনো পাইনা। না পেলে মাঝের সিটে পড়লে স্যান্ডউইস হয়ে যেতে হয়, আর ‘আইল’ সিটে বসলে সামলাতে হয় ধাক্কাধাক্কি। একাধিকবার বিমানবালা গায়ের উপর কফির কাপ উপড়ে দিয়ে ‘সরি’ বলেছেন। ইউরোপ আমেরিকার লংজার্নির ফ্লাইটগুলোতে এমন সিটে বসতে হলে এক একটি যাত্রায় কত ধাক্কা যে খেতে হয় তা ইয়ত্তা থাকে না। গুয়াংজুর ফ্লাইট তেমন লম্বা নয়, ঘন্টা পাঁচেকের। তবুও উইন্ডো সিট পেয়ে বর্তে গেলাম। বোর্ডিং কার্ড হাতে নিয়েই মেজাজটি ফুরফুরে হয়ে উঠেছিল। এখন সিটে বসার পর ফুরফুরে ভাবটি কিছুটা বেড়েছে বলে মনে হচ্ছিল।

বিমানের জানালা দিয়ে ঢাকা এয়ারপোর্টে দেখার মতো তেমন কিছু নেই। তাই বাইরে না দেখে এয়ারক্রাফটের ভিতরে যাত্রীদের কান্ডকারখানা এবং কেবিন ক্রুদের ব্যস্ততা দেখছিলাম। ফ্লাইটে যাত্রীদের বসানোর আগ দিয়ে কেবিন ক্রুদের ব্যস্ততা থাকে চোখে পড়ার মতো। কী যে ছোটাছুটি ! যাত্রীদের সিট বেল্ট বাঁধানো, সিট সোজা করা, সামনের ছোট্ট টিটেবিলটি ভাঁজ করে রাখাসহ নানা কাজ। প্রতিটি সিটে চোখ বুলান তারা, প্রতিজন যাত্রীর কোমরে চোখ রেখে হেঁটে যান, শাণিত দৃষ্টিতে কোন যাত্রীর সিট বেল্ট খোলা রয়েছে কিনা সেটি দেখেন। সিটে বসার সাথে সাথে আমি সিট বেল্ট লাগিয়ে ফেলি, যতক্ষণ বিমানে চড়ি ততক্ষণই আমার সিট বেল্ট লাগানো থাকে। কোন কারণে উঠতে হলেও ফিরে ফিরে এসে সিট বেল্ট লাগিয়ে নিই। নিজের নিরাপত্তার জন্যই ব্যাপারটি ভীষণ জরুরি বলে মনে করি। অনেক সময় আকাশে এয়ার পকেট কিংবা মেঘের ঘনঘটাসহ প্রাকৃতিক কারণে এয়ারক্রাফট প্রচুর ঝাকাঝাকি করে, অনেক সময় উপর থেকে নিচের দিকে কয়েকশ’ ফুট পর্যন্ত পড়ে যায়, ধাক্কা লাগে। ওই সময় সিট বেল্ট লাগানো থাকলে অনেকটা নিরাপদ থাকা যায়। অবশ্য বিমান যদি ৩৫ হাজার ফুট উপর থেকে নিচে পড়ে তাহলে এই সিট বেল্ট বাঁধায় শেষ রক্ষা হবে বলে মনে হয় না।

যাক, কোমরে সিট বেল্ট লাগিয়ে যাত্রী এবং কেবিন ক্রুদের দেখছিলাম। লায়ন ফজলে করিম ভাই ডালিয়া ভাবীকে (লায়ন মাহমুদা করিম) নিয়ে আমার সামনে সিটে বসেছেন। মুখ দেখাদেখি না হলেও আমরা টুকটাক কথাবার্তা বলছিলাম। আমাদের কথাগুলো ধারে কাছের যাত্রীদের কেউ বুঝতে পারছিলেন বলে মনে হচ্ছিল না। কারণ যাত্রীদের সিংহভাগই চীনের মানুষ। আমার পাশের দুইটি সিটের দুইজনও চীনা, তরুণতরুণী। সিটে বসার পর থেকে তারা হাতে হাত রেখে কী যে গল্প করছিলেন। সাত রাজ্যের সব কথা যেনো তারা বিমানে বসে বলার জন্য জমিয়ে রেখেছিলেন। চীনা ভাষার কিছু না বুঝলেও তাদের হাসি আর আনন্দ দেখে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না যে, সময়টাকে দারুণ উপভোগ করছেন তারা। তরুণের এক একটি কথায় তরুণী হেসে কুটি কুটি হচ্ছিলেন। আড়চোখে সেই হাসি দেখে আমার মুখেও আনন্দ ছড়িয়ে পড়ছিল। আনন্দ বা সুখ বুঝি এমনই, সুযোগ পেলেই সংক্রমিত হয়।

আমাদের রো’তে দশজন যাত্রী বসেছেন। তিনটি ভাগে বিভক্ত এক একটি রো’তে দশজনের বসার ব্যবস্থা। দুই পাশে তিনজন করে ছয় জন, মাঝের রো’তে চারজন। মাঝের রো’র দুই পাশে চলাচলের পথ। খেয়াল করে দেখলাম যে, আমার ধারে কাছের সবগুলো সিটেই বসে আছেন চীনের মানুষ, ঘরমুখি মানুষ। তাদের চোখে মুখে কী আনন্দ খেলা করছে? হঠাৎ আমার মনে প্রশ্ন জাগলো যে, চীনের এতো মানুষ কী আমাদের দেশে বসবাস করেন! নাকি এরা বেড়াতে এসেছেন? চীনা কোন পর্যটক কি বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন? মনে হয়না।

আমাদের বোয়িংটি চলতে শুরু করেছে। টার্মাক থেকে রানওয়ের দিকে যাচ্ছে এয়ারক্রাফট। অনেকটা বাসের মতো করে ধীরলয়ে চলছে। ডানাগুলো হালকা নড়ছে, যেনো এখনি উড়াল দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম যে, বিমানটিকে উড়াল দিতে আরো কিছু পথ পাড়ি দিয়ে রানওয়ে ধরতে হবে। তারপর তীব্র বেগে ছুটে আকাশে গা ভাসাবে।

বিমানের ডিজিটাল স্কিনে নিরাপত্তা সংক্রান্ত কথামালা প্রচার হচ্ছিল। প্রতিটি ফ্লাইটের শুরুতেই কথাগুলো নিয়মমাফিক বলা হয়। যাত্রীরা এসব শুনেন বলে আমার মনে হয়না। সিট বেল্ট কেমনে বাঁধতে বা খুলতে হয়, এয়ারক্রাফটে অক্সিজেনের অভাব হলে কি করতে হবে, জরুরি অবতরণকালে কিভাবে থাকতে হবে, কোনপথে ইমারজেন্সি এক্সিটের দিকে এগুতে হবেতোতা পাখীর মতো এসব বলে যাওয়া হয়। আগে কেবিন ক্রুরা বিষয়গুলো হাত নেড়ে নেড়ে ডামি করে দেখাতেন, এখন দেখছি বিজ্ঞাপনচিত্রের মতো মডেল দিয়ে টিভিতে দেখানো হচ্ছে।

রানওয়ে ধরে ছুটছে আমাদের বোয়িং। দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ কিলোমিটার গতিবেগ এখন এয়ারক্রাফটির। অল্পক্ষণের মধ্যে বিমানের সামনের অংশ উপরের দিকে উঠতে শুরু করলো, পেছনের দিকে সিট হওয়ায় আমার মনে হচ্ছিল বিমানের লেজ বুঝি রাণওয়েতে লেগে যাবে! কিন্তু কোন সমস্যা হলো না। ভালোয় ভালোয় ডানা মেললো চায়না সাউদার্নের বোয়িং।

আকাশে উঠার পর বিমানের গতি আরো বাড়লেও তা আর বুঝা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল বিমানটি আকাশে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। এটি একটি আজব কারবার, রানওয়েতে থাকাকালে মনে হয় ঝড়ের চেয়ে বেশি বেগে ছুটছি, আর উপরে উঠার সাথে সাথে মনে হয় বিমানটি ভাসছে, ছুটতে ভুলে গেছে!

আকাশে উঠে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ফ্লাইটের আলো একেবারে কমিয়ে দেয়া হলো। আমি চোখ বন্ধ করলাম, সিট হালকা হেলিয়ে দিলাম। যদি নিদ্রাদেবীর সাক্ষাৎ ঘটে! এখন সিট হেলিয়ে দিলে কোন সমস্যা নেই। তবে ইকোনমি ক্লাসের সিটগুলোতে খুব বেশি হেলান দেয়ার সুযোগ থাকে না। লায়ন ফজলে করিম ভাই ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে গেছেন বলে মনে হলো। বেচারা সন্ধ্যার পর পরই ডিনার সেরে ঘুমিয়ে যান, খুব সকালে বিছানা ছাড়েন। ভাবীর অবস্থাও একই। আমি কথাবার্তা বলে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালাম না। তবে আমার পাশের সিটের দু’জন কথা মেশিন চালিয়ে রেখেছেন। তাদের একজনের হাত অপরজনের মুঠোয়। আড়চোখে দেখতে খুব একটা খারাপ লাগছিল না। আহা, ঘরে ঘরে যদি এমন প্রেম বিরাজ করতো তাহলে পৃথিবীটা এতোটা ভয়ংকর হতো না!

মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আমার ঘুম আসছিল না। সিটের সাথে সেঁটে থাকা টিভিতে একটি সিনেমা দেখার চেষ্টা করলাম। বিভিন্ন ধরনের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানসহ সিনেমার বিশাল ভান্ডার রয়েছে ফ্লাইটে। ইচ্ছে করলে বাছাই করে ভালো সিনেমা দেখা যায়। আমি একটি এ্যাকশন মুভি চালিয়ে দিলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ দেখার পর আর ভালো লাগছিল না। চ্যানেল ঘুরানোর মতো করে আরো কয়েকটিতে চোখ বুললাম। না, সিনেমায় মন বসছে না। আমি ফ্লাইট ইনফোতে গিয়ে বিমানটি কোনপথে যাচ্ছে তা দেখতে লাগলাম। এটি একটি দারুণ ব্যাপার। ফ্লাইট কত মাইল গতিতে, কত ফুট উচ্চতায় কোন পথে যাচ্ছে তা দিব্যি স্কিনে দেখা যায়। কতক্ষণে পৌঁছাবে, লোকাল টাইম কত, গন্তব্যস্থলের সময় কত, বাইরের তাপমাত্রা কত, গন্তব্যস্থলের তাপমাত্রা কত তার সবই একে একে দেখানো হয়। বিমানে চড়ার সময় সিনেমা ভালো না লাগলে ফ্লাইট ইনফো দেখে ভালোই সময় কাটানো যায়। বিভিন্ন দেশের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় আমার দারুণ একটি অনুভূতি হয়। ব্যাপারটি আসলেই ভালো লাগে, রোমাঞ্চিত হই।

কফি খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল। বললেই দেবে। কিন্তু বলতে ইচ্ছে করছিল না। বিমানের আলো জ্বলে উঠায় আমি বুঝতে পারছিলাম যে, অল্পক্ষণের মধ্যেই হয়তো খাবার এবং পানীয় সার্ভ করা হবে। কেবিনক্রুদের হালকা তোড়জোড় দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার কোন ক্ষুধা নেই, তাই খাবারের ব্যাপারে তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে একজন কেবিন ক্রু আমার কাছে এলেন, সিট নম্বর নিশ্চিত হলেন। খাবারের প্যাকেটের উপর সেঁটে দেয়া একটি কাগজে ইংরেজীতে হাতে লেখা আমার নাম, নিচে টাইপ করে লেখা ‘এমএমএল’। বুঝতে পারলাম যে, এটা মুসলিম মিল। টিকেট করানোর সময় খাবারের ব্যাপারে বলে দিতে হয়। চীনা ফ্লাইট, খাবার দাবারের ব্যাপারে একটু সতর্ক না থাকলে ঝামেলা হওয়ার শংকা থাকে। লায়ন ফজলে করিম এবং মাহমুদা করিম ভাইকেও আলাদা প্যাকেট এনে দেয়া হলো। আমাদের টিমের সকলের পাশাপাশি আরো কয়েকজন যাত্রীকে দেখলাম একইভাবে খাবারের প্যাকেট দেয়া হলো। আমি প্যাকেটটি টেবিলের উপরে রেখে দিলাম। ভিতরে কি দিয়েছে কে জানে! তবে মনে মনে করিম ভাইকে ধন্যবাদ দিলাম যে, টিকেট করানোর সময় বিষয়টি বলে দেয়া না হলে চীনা ফ্লাইটে এমন নিঃসংকোচে খাবার খাওয়া হয়তো সম্ভব হতো না।

ট্রলি ঠেলে ঠেলে সব যাত্রীকে খাবার দেয়া হচ্ছিল। খাবার পর্ব সাঙ্গ হওয়ার পর চা, কফি এবং বিভিন্ন ধরনের মদ সার্ভ হচ্ছিল। কেউ কফি নিচ্ছিলেন, কেউবা হার্ড ড্রিংকস। আমার পাশের দুই তরুণ তরুণী কয়েক প্যাক চালিয়ে দিলেন। তরুণী রেড ওয়াইন গ্লাস ভরে ভরে নিচ্ছিলেন। লায়ন করিম ভাই দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে আমাকে দেখলেন। খাবার ঠিকঠাক আছে কিনা খবর নিলেন, আড়চোখে গ্লাসের দিকেও চোখ দিলেন। সেখানে ধুমায়িত কফি দেখে তিনি মনে হয় কিছুটা হতাশ হলেন। অবশ্য উনিও গ্রিনটি নিয়ে চুক চুক করছিলেন। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রফেসর ড. আবদুল করিম স্মরণে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ