দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২২ মে, ২০২৪ at ১০:৫১ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ছায়া সুশীতল পার্কের ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটছিলাম। কী যে মনোরম এক পরিবেশ, চারপাশ। অসংখ্য নারী পুরুষ পার্কটিতে। তবে হংকংয়ের ব্যস্ততম এলাকাগুলোর মতো এখানে মানুষের গিজগিজ ভাব নেই। একেবারে শান্ত, সুনশান। পার্কের পাশ দিয়ে রাস্তা। প্রচুর গাড়ি চলছে। কিন্তু কোন হর্ণ নেই। অবশ্য, পৃথিবীতে হর্ণ বাজায় এমন চালকের সংখ্যা একেবারে নগণ্য। বাংলাদেশ এবং ভারতের কয়েকটি এলাকা ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও পারতপক্ষে গাড়িতে হর্ণ দেয়া হয় না। গাড়ির হর্ণ বাজানোকে অসভ্যতা এবং অপরাধ বলেও মনে করে কোটি কোটি মানুষ। যাক, আমরা হর্ণ বাজাতে ভালোবাসি, শুনতেও। আমাদের ড্রাইভারেরা কারণে অকারণে হর্ণ বাজায়, আমরা শুনি। আরো একটি জিনিস আমাদের দেশ এবং ভারতের কিছু অংশ ছাড়া অন্য কোথাও তেমন একটা দেখিনি। সেটা হচ্ছে গাড়ির বাম্পার। গাড়ির সামনে পেছনে লোহার বাম্পার লাগানোর চলও পৃথিবীতে খুব বেশি দেশে নেই। যাক, বাম্পার কিংবা হর্ণ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। ছায়া সুশীতল পার্কে ঘুরছি। নারী পুরুষ ও শিশু কিশোরের দল আনন্দ করে সময় পার করছে। আহা, আনন্দ! এমন আনন্দ আমার শহরে নেই কেন!!

এমন নিশ্চিন্তে শরীরে হাওয়া লাগিয়ে ঘোরার মতো একটি পার্কও আমাদের নেই। টুকটাক যা ছিল তাও নানাভাবে বেহাত হয়ে গেছে। শহরের ছায়া কেড়ে নেয়ার কী নির্মম চেষ্টা চলে!

শুধু পার্কেই নয়, হংকং শহরে সুউচ্চ সব ভবনের ফাঁকফোকরে প্রচুর গাছ। প্রচুর গাছ রাস্তার দুধারে। হংকং শহরে ছায়ার যেনো কোন অভাব নেই। ভূমির সংকট থাকলেও হাঁটা বা আয়েশ করার জায়গার কমতি নেই। ইট পাথরে প্রায় ঢেকে যাওয়া একটি শহরে এতো গাছগাছালী যে কিভাবে রক্ষা করা হলো কে জানে!

হাঁটছিলাম আমরা। পার্কটিকে প্রথম দেখায় যতটা ছোট মনে করেছিলাম এখন হাঁটতে গিয়ে মনে হচ্ছে খুব একটা ছোট নয়। জায়গার ভয়াবহ আকালের মাঝে এমন একটি পার্ক থাকা আসলে বেশ অস্বাভাবিক লাগছিল। গাছের ছায়ায় চমৎকার সব টুল পেতে রাখা। এক বয়ষ্ক দম্পতিকে দেখলাম বসে আছেন। তারা হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছিল। আমাদের দেখে হাসছে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। তবে আমরা কি হাসার মতো কিছু করেছি। স্বপনকে কথাটি বলতে সে বললো, দ্যুৎ, আমাদের নিয়ে তাদের ভাবার সময় কোথায়। এখানে কেউ কাউকে নিয়ে অনর্থক ভাবে না। নিজেরা নিজেদের মতো ব্যস্ত থাকে। তাদের হয়তো যৌবনের কোন কথা মনে পড়েছে।

আমি আড়চোখে বুড়োবুড়িকে দেখছিলাম। কী যে প্রেম! বুড়োর হাতের মুঠোয় বুড়ির হাত। দারুণ তো! সরাসরি তাকলে কিছু মনে করবেন বিধায় মন ভরে দেখতেও পারছিলাম না। চুরি করে দেখতেও ভালো লাগছিল। বুড়োবুড়ি হাসছিলেন, হাসির সাথে সাথে তাদের শরীর মন যেনো দুলছিল।

স্বপন বললো, চল, এবার ফেরা যাক। আমিও সায় দিলাম। আমরা একসাথে পার্ক থেকে বের হয়ে আসলাম। স্বপন মোবাইল টিপছিল। পার্কের গেটে পৌঁছানোর অল্পক্ষণের মধ্যেই একটি গাড়ি এসে দাঁড়ালো। স্বপন বললো, উঠ। আমি বললাম, বাসে বা মেট্রোতে গেলেই তো পারতি। শুধু শুধু গাড়ি ভাড়া করলি কেন? স্বপন কিছু না বলে হাসলো।

চকচকে গাড়ি। টয়োটা কোম্পানির। হংকংয়ের সাথে জাপানের সম্পর্ক ভালো। তাই জাপানি গাড়ির বেশ বড় বাজার হংকং। ইউরোপীয়ান কিছু গাড়িও চোখে পড়েছে। তবে হংকংয়ে বেশির ভাগ মানুষই বাস ট্রাম মেট্রোসহ গণপরিবহন ব্যবহার করে। এমন চমৎকার এবং আরামদায়ক গণপরিবহন পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও নেই। ব্যক্তিগত একাধিক গাড়ি আছে এমন বহু মানুষই বাসে ট্রামে বা ট্রেনে চলাচল করেন। আগেই বলেছি, হংকংয়ে ভূমি সংকট প্রকট। তাই পার্কিংয়ের মারাত্মক আকাল হংকংয়ে। রাস্তার যেখানে সেখানে গাড়ি রেখে চলে যাওয়ার মতো নানার বাড়ির আবদার হংকংয়ের কোথাও নেই।

আমাদের গাড়ি চলছিল। টেক্সি। এটি শহর এলাকার টেক্সি। তিন ধরণের টেঙি নাকি হংকংয়ে চলাচল করে। রঙ দ্বারা এগুলো চিহ্নিত। একটির এলাকায় অপরটির আসার কোন সুযোগ নেই। রাস্তায় পুলিশের আনাগোনা না থাকলেও হংকংয়ে আইন লংঘন করার সুযোগ নেই। কথাগুলো বলতে বলতে স্বপন আমাকে বুঝালো যে, হংকংয়ের আইন একেবারে অন্ধ। যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, ট্রাফিক আইন লংঘন করে পার পাওয়ার আশা নেই।

কোথায় থেকে কোথায় যাচ্ছি কিছুই জানি না। কোনপথ ধরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে। অবশ্য, স্বপন বহুবছর হংকংয়ে। সে সবই চিনে। নিশ্চয় ড্রাইভারকে সে যে ঠিকানা দিয়েছে সেই পথেই গাড়ি এগুচ্ছে। উল্টাপাল্টা করার সুযোগ নেই। আমার কোন কিছু চেনার উপায় নেই। সব রাস্তাই একই রকম লাগে। আমার বন্ধুর যেই বাড়িতে আমি উঠেছি, সেখান থেকে বেরুনোর একটু পরই আমি সব তালগোল পাকিয়ে ফেলি। আমি নিশ্চিত যে, একশ’ মিটার সামনে নিয়ে আমাকে ছেড়ে দেয়া হলে গুগুলের সাহায্য ছাড়া ফিরতি পথ আমি খুঁজে পাবো না।

আমাদের গাড়িটি বিশাল এবং সুউচ্চ একটি ভবনের সামনে এসে থামলো। এটি আবার কোথায় আসলি? আমার চোখে মুখে জিজ্ঞাসা। স্বপন বললো, আমার বাসা, চল। ৫৫ তলায় উঠতে হবে। বলিস কি, ৫৫ তলায় তোর বাসা? স্বপন হাসলো, বললো, ভয় নেই। লিফট আছে। আমি আমতা আমতা করে বললাম, এখানে আবার আসলি কেন? আমাকে ওই বাসাতে নামিয়ে দিলেই তো পারতি। স্বপন হাসলো। বললো, আমার বাসা না দেখে চলে যাবি? কথাটির যুক্তি আছে। তার বাসা না দেখে হংকং থেকে চলে যাওয়া শোভন হবে না। তবে কারো বাসায় যেতে হলে যেভাবে যেতে হয় তার কোন প্রস্তুতিই আমি নিইনি। আমি দোকানপাট খুঁজতে লাগলাম। স্বপন আমাকে থামিয়ে টানতে টানতে লিফটের দিকে নিয়ে গেলো।

স্বপনের বাসার ভবনটি আসলেই বিশাল। কত তলা উঁচু কে জানে। লিফট খোলার পর হু হু করে বহু লোক একসাথে বের হয়ে এলো। আবার উঠার জন্যও বহু লোককে ছুটতে দেখলাম। আমি কিছুটা ভিমড়ি খাওয়ার উপক্রম হলো। কত লোক থাকে এখানে! স্বপন বললো, এটা হংকং। এখানে এক একটি ভবনে যে কত লোক থাকে তা তুই আন্দাজও করতে পারবি না। তাদের ভবনটিতে নাকি কয়েকশ’ এ্যাপার্টমেন্ট! কি বলিস এসব! একটি ভবনে কয়েকশ’ এ্যাপার্টমেন্ট! স্বপন হাসতে হাসতে বললো, ইউরোপের কোন কোন দেশের পুরো একটি শহরের মানুষই আমাদের এখানে একটি এ্যাপার্টমেন্টে থাকে! স্বপন হিসেব কষে বললো যে, এখানের এ্যাপার্টমেন্টগুলোর অধিকাংশই ৬০/৭০ তলা। একটি ফ্লোরে চারটি থেকে দশটি পর্যন্ত ফ্ল্যাট থাকে। সুতরাং বুঝতে পারছিস! আমি কিছু না বুঝেও মাথা নাড়লাম। স্বপন বললো, শহরে আস্ত বাড়ি নিয়ে খুব মানুষই বসবাস করতে পারে। এক একটি বাড়ির দাম বিশ পঞ্চাশ কোটি টাকা!

লিফটে চড়ে আমরা স্বপনের ফ্ল্যাটে পৌঁছালাম। স্বপন কল বেল চাপলো, কয়েকবার। কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর স্বপন পকেট থেকে চাবি বের করে দরোজা খুললো। বললো, তোর ভাবী নেই। আসলে তোকে আনবো সেটা ফোন করে দিলে হতো। স্বপনের স্ত্রীও কি একটা চাকরি করেন। বাচ্চারা নিশ্চয় স্কুলে। নাকি বাচ্চাদের নিয়ে ভাবী কোথাও বেড়াতে গেছে কে জানে! স্বপন আমাকে বসতে বলে ফ্রেশ হতে গেলো। এসে বললো, ফ্রেশ হবি? সে আমাকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দিল। বললো, আমি কফি বানিয়ে আনছি। তুই ফ্রেশ হয়ে বোস। তোর ভাবী বাচ্চাদের নিয়ে শপিং এ গেছে। আসতে মনে হয় দেরি হবে।

ভাবীর আসতে দেরি হবে কি তাড়াতাড়ি হবে তা নিয়ে মোটেও ভাবছি না আমি। আমার আক্কেল গুড়ুম হচ্ছে স্বপনের ঘর দেখে। এতো ছোট ঘরেও মানুষ বসবাস করতে পারে! ছোট্ট একটি ড্রয়িং রুম, পাশে আবার ডাইনিং টেবিল। চারজনের। চেয়ারগুলো টেবিলের নিচে ঢুকানো। ওয়াশরুম দেখে আমার মাথা ঘোরাতে শুরু করলো। চারটি দেয়ালই যেনো গায়ে লেগে যাচ্ছে। কোনরকমে দায়সারাভাবে ওয়াশরুমের কাজ শেষে বের হলাম। হাত মুখ মুছতে মুছতে স্বপনকে বললাম, কী অবস্থারে দোস্ত! সবকিছু এতো টাইট ফিট কেন? স্বপন হাসলো। বললো, এটাতো অনেক বড়। তোকে এই এ্যাপাটমেন্টের অন্য টাইপের বাসাগুলো দেখালেও তো ভয় পাবি। তুই তো মনে হয় ঢুকতেও পারবি না। স্বপন দুই বেডরুমের ফ্ল্যাট। ৬শ’ স্কয়ারফিটের মতো। এরমধ্যে রান্নাঘর থেকে শুরু করে সবই রয়েছে। হংকংয়ে তিনশ’র কম স্কয়ার ফিটের বাসার ভাড়াও নাকি বাংলাদেশের লাখ টাকার উপরে। ওই তিনশ’ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটেও দিব্যি মানুষ বসবাস করে। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগুণী মানুষদের স্মরণে
পরবর্তী নিবন্ধবৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বুদ্ধ পূর্ণিমা