দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৮:৩৯ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ঘোরলাগা চোখে হংকং বন্দরের নানা কার্যক্রম দেখলাম। দূর থেকে যতটুকু দেখা যাচ্ছিল তাতে বেশ বুঝতে পারছিলাম না বন্দরের ভিতরের মানুষগুলোর দম ফেলার সময় নেই। গ্যান্ট্রি ক্রেনের নড়াচড়া জাহাজে জাহাজে কন্টেনার হ্যান্ডলিং এর কার্যক্রম চলছে। এত বেশি কাজ চলছে যে, তারা মাত্র দশ ঘন্টায় একটি জাহাজের তিন চার হাজার কন্টেনার নামিয়ে আবার তিন চার হাজার কন্টেনার বোঝাই করে দেয়ার সক্ষমতা বন্দরটির রয়েছে। এক একটি বার্থে কয়টি ক্রেন লাগিয়ে কে জানে! একটি মাঝারী আকৃতির জাহাজে যদি চারটি ক্রেন লাগানো হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই কাজের গতি দুই তিনগুণ বেড়ে যাবে।

ড্রাইভারকে অফিসের দিকে যেতে বললাম। ইতোমধ্যে আমার বন্ধু বার দুয়েক ফোন করে খবর নিলেও তাড়াহুড়ো করতে না করেছেন। আমাকে বাসায় লাঞ্চ করার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সময় করে তাকে অফিস থেকে তুলে নিতে বলেন। ড্রাইভার গাড়ি পার্কিং এ রেখে আমাকে নিয়ে অফিসে পৌঁছালেন। আমি নিশ্চিত যে, ড্রাইভার সাথে না থাকলে এই বিল্ডিং এ আসলেও অফিসটি খুঁজে বের করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। একটি ভবনে শত শত অফিস। এক ফ্লোরেই কয়েকটি অফিস। শুধমাত্র ১০ফুট বাই ১২ ফুটের একটি কক্ষ নিয়েও অফিস রয়েছে ভবনটিতে। ভূমির প্রচন্ড আকালে থাকা হংকংয়ে অফিসের জন্য জায়গার বড় অভাব। এক টুকরো জায়গার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হংকং কতভাবেই যে ভবন বানিয়েছে তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আবার ভবনে ভবনে ফ্লোর স্পেসের সবটুকুই যাতে ব্যবহৃত হয় তা নিশ্চিত করতেও কম কসরত চলেনি। তিন ফুট বাই চার ফুট ওয়াশরুমের ভিতরে যখন কমোডের পাশাপাশি অভিনব বেসিন কিংবা ছোট্ট একটি শোকেজ দেখবেন তখন বুঝবেন যে, এরা ফ্লোর স্পেস নিয়ে কি ভয়ংকং অবস্থার মধ্যে রয়েছে। সুইচ টিপলে নানা জিনিস বের হয় দেয়ালের ভিতর থেকে! দেয়ালে খোপ খুপরি করে তাতেও নানা জিনিস ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। দুপুর কিছুটা গাড়িয়ে গেছে। ‘পড়ন্ত বেলা’ বলা না গেলেও বেলা যে চড়ে গেছে তা বলা চলে। গাড়ি ছুটছিল, রাজপথ ধরে। যথারীতি রাস্তায় প্রচুর ট্রাফিক। তবে যানজটে স্থবির নয়, সুশৃংখলভাবে চলছিল গাড়িগুলো। আমার অসুস্থ বন্ধুকে বেশ ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছিল। সেটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন তিনি। আমি তার কপালে হাত দিলাম। জানতে চাইলাম, ক্ষুধা লেগেছে? তিনি চোখ খুললেন, হাসলেন। বললেন, ‘ক্ষুধাতো লাগে না। তেমন কিছু খেতে পারি না। অল্পতেই টায়ার্ড হয়ে যাই। খুব টায়ার্ড লাগছে।’ আমি খুব অসহায়ভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, অসম্ভব ভালোমানুষ আমার বন্ধুটি ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সেরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েও তিনি রোগের সাথে পেরে উঠছেন না।

ভাবীর ফোন। আমার বন্ধু রিসিভ করে বেশ নরোম করে বললেন, পৌঁছাতে দশ মিনিট লাগবে। টেবিল লাগিয়ে দাও। ঠিক দশ এগারো মিনিটেই আমরা বাসায় পৌঁছে গেলাম। ড্রয়িংরুমের পাশেই ডাইনিং। বাসায় ঢুকে ড্রয়িংরুম হয়েই আমাদের রুমে যেতে হবে। আড়চোখে টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। অল্পক্ষণের মধ্যেই তিন তলা থেকে নেমে আসলাম। ক্ষুধা বেশ জানান দিচ্ছিল। তাই অহেতুক সময় নষ্ট না করে আমি টেবিলেই বসে গেলাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই যোগ দিলেন আমার বন্ধু। ভাবী এবং বাচ্চারাও টেবিলে যোগ দিল। স্কুল কলেজ থেকে ফিরে তারা আমাদের ফিরে আসার অপেক্ষা করছিল। ভাবী আমাদের পাতে খাবার তুলে দিলেন। রকমারি খাবার। দেশি বিদেশী। অচিন নানা খাবারও দেখা গেলো। ভাবী একেকটি খাবারের বর্ণনা এবং রেসিপি বলছিলেন। দেশীগুলোর ব্যাপারে না বললেও চাইনিজ, ভিয়েতনামি এবং হংকংয়ের যেসব খাবার রান্না করেছেন তার সবগুলো কি দিয়ে কি রেঁধেছেন তা যেনো ভাবী আমাকে শিখাচ্ছিলেন। প্রতিটি খাবারই দারুণ। এমন ভিনদেশে এসে অনায়াসে এমন সব খাবার পাওয়া কী যে ভাগ্যের ব্যাপার তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। অবশ্য একথা ঠিক যে, দেশে দেশে কত ঘরে যে পাত পেতেছি তার কোন ইয়ত্তা নেই। আহা, কতজন কতভাবে আদরে ভালোবাসায় আমার পাতে খাবার তুলে দিয়েছেন তার হিসেব কষতে গেলে আপ্লুত হই। আহা, মানুষ যে মানুষকে কী ভালোবাসে! প্রবাসী মানুষগুলো দেশ থেকে যাওয়া বন্ধু, আত্মীয় কিংবা পরিচিত একজন মানুষের জন্য যে কিভাবে পাগল হয়ে যায় তা খুব কাছ থেকে দেখেছি। দিনভর খাটাখাটুনির কাজ করেও রাতের দুইটা তিনটা পর্যন্ত নিজের গাড়ির তেল পুড়িয়ে কতজনকে কত কিছু দেখিয়েছেন তার ঋণ একজীবনে কোনদিনই শোধ করা হবে না।

খাবার টেবিলে আমার বন্ধু বললেন, বিকেলে কি কোথাও যাবেন? আমি বললাম, ঠিক বুঝতে পারছি না। আর কোথায় কোথায় যাওয়া যায় বা দেখার কি আছে তা তো আমি জানি না। বন্ধু হাসলেন, বললেন, পুরো হংকংই তো দেখার জায়গা। যেদিকে যাবেন সেদিকেই দেখার জায়গা আছে। তবে আজ আর কোথাও না গিয়ে আপনার ভাবীর সাথে শপিং এ যান। ভালো লাগবে। আপনার ভাবী বিকেলে শপিং এ যাবে। আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। মনে মনে খুশি হলাম যে, শপিংমলগুলোতে ঘুরতে ভালোই লাগবে। ভাবী বললেন, আপনি রুমে গিয়ে রেস্ট নিন। আমি ডেকে নেবো। মহিলা মানুষ। রেডি হতে একটু সময় লাগে! আমরা হেসে উঠলাম।

ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ভাতঘুম। কিন্তু ঘুমানোর কোন ইচ্ছে না থাকলেও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। টাইম গ্যাপের কারণে রাতে ঘুম হচ্ছে না। জেট ল্যাগের প্রভাবও রয়েছে। বন্ধুর ফোনে ঘুম ভাঙলো। নিচতলা থেকে তিন তলায় ফোন। প্রযুক্তি যে আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে! তড়িঘড়ি রেডি হয়ে নেমে আসলাম। ভাবী পুরো রেডি। ড্রাইভারও গাড়ি বের করে অপেক্ষা করছে।

আবারো রাস্তায়। পথটি অনেকটা চেনা হয়ে গেছে। পাহাড় টাহাড়ের ভিতর দিয়ে ছুটছে গাড়ি। আহা, প্রতিটি পাহাড়ই অক্ষত, সবুজে সবুজে একাকার। প্রচুর গাছগাছালী। গাছের ঢালে পাখির ওড়াওড়ি। রাস্তায়ও হেলে দুলে পোকামাকড় খুঁজছে পাখি। ভাবী গাড়িতে উঠেই কোথায় যেতে হবে সেটি ড্রাইভারকে বলে দিয়েছেন। ওপথেই ছুটছে গাড়ি। শহরের ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। রাস্তাজুড়ে বেড়েছে গাড়ির ছুটাছুটি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে মানুষের ঘরে ফেরার তাড়াও বেড়েছে। বেড়েছে বিনোদনপ্রিয়, শপিংপ্রিয় কিংবা কাজপাগল মানুষগুলোর পথচলাও।

ঝলমলে একটি মার্কেটের সামনে আমাদের নামিয়ে দেয়া হলো। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শপিংমল। রাস্তা ফুটপাত এবং মলের সামনের রাস্তায় ময়লা আবর্জনাতো দূরের কথা মনে হলো ধুলোবালিও নেই। অভিজাত শপিংমল বলতে যা বুঝায় এটিকে তেমনই মনে হলো। প্রথম দেখাতেই বেশ ভালো লেগে গেল আমার। বিশাল দরোজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেল। ভিতরে পণ্যের পসরা দেখে আমার চোখ ছানাবড়া। বিশাল মার্কেটটির যেদিকে চোখ যাচ্ছিল সেদিকেই থরে থরে সাজানো পণ্য। বেজায় বিকিকিনি। প্রচুর লোক কেনাকাটা করছে। চলন্ত সিঁড়ি এক ফ্লোর উপরে উঠে আসলাম আমরা। এই ফ্লোরেও পণ্যের পসরা। হংকংয়ের সর্বত্র বেজায় স্থানাভাব দেখলেও এখানে মনে হচ্ছে জায়গার কোন অভাব নেই। সুপারমল টাইপের মার্কেট। একই দোকানে কিংবা একই ছাদের নিচে সবকিছু। পৃথক পৃথক রো এবং গ্যালারিতে থরে থরে সাজানো হরেক পণ্য। কী অসাধারণ সব জিনিসপত্র! কত জিনিস যে সাজিয়ে রেখেছে!

নানা নান্দনিকতায় সাজিয়ে রাখা তৈরি পোশাকের সেকশনে গেলেন ভাবী। পেছনে পেছনে আমি। বিশাল জায়গা জুড়ে কেবল পোশাক, কাপড়চোপড়। কত ধরনের পোশাক যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে তার যেনো কোন ইয়ত্তা নেই! আলোকোজ্জ্বল চারদিক। কী যে রঙের বাহার! বর্ণিল করে রাখা ড্রেস কর্ণারটিতে নানা পোষাকে সজ্জিত করে রাখা হয়েছে বেশ কয়েকটি ম্যানিকুইন। পুতুলগুলো এক একটি যেনো জীবন্ত হয়ে তাকিয়ে আছে। কোনটি চ্যাপ্টা নাকের, আবার কোনটি নিখাদ পশ্চিমা। কী যে সুন্দর! দেয়ালে শোভা পাচ্ছে বেশ কিছু পোস্টার। যাতে মডেলেরা ড্রেস পরে পোজ দিয়েছে। মডেলের ড্রেসটি বেশি বিক্রি হয় কিনা কে জানে!! আমি ঠিক বুঝিনা, কোন একটি পোষাক একজন নায়ককে যেমন সুন্দর দেখাবে, আমার মতো বিশ্রি চেহারার কোন মানুষ পড়লেও কি ওরকমই লাগবে!! তাহলে কেন এমন সব তরতাজা মডেল দেখে বিভ্রান্ত হওয়া! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঙালির প্রাণের সঞ্চার বইমেলা
পরবর্তী নিবন্ধডিমভাজা ও একটি শ্রেণিকক্ষের স্বপ্ন