দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৮:৫০ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

জ্যোৎন্সায় ভেসে যাচ্ছিল চারদিক। চাঁদের আলো যেনো থৈ থৈ করছিল। চাঁদের এমন উজ্জ্বল আলো বহুদিন দেখিনি। গ্রাম থেকে শহরে আসার পর এমন মোহনীয় জ্যোৎস্না আর দেখেছি কিনা মনে করতে পারছিলাম না। বাঁধভাঙা জ্যোৎস্না মনে হয় একেই বলে। আজ কী পূর্ণিমা! হতে পারে। দূর আকাশের চাঁদকে বেশ বড়ও লাগছিল। আমার বন্ধুর বাড়িটি সুবিন্যস্ত একটি আবাসিক এলাকায়। সবগুলো বাড়িই ট্রিপ্লেক্স। তিন তলার উপরে কোন স্থাপনা নেই। নেই কোন আড়ও। এতে করে চাঁদের আলো অনেকটা অবারিত। কয়েকশ’ একরের আবাসিক এলাকায় গাছগাছালি প্রচুর। গাছগাছালীর ভিতর দিয়ে আসা জ্যোৎস্না রাস্তায় আলপনার মতো অদ্ভুত সুন্দর একটি ছায়া তৈরি করেছে। আবাসিক এলাকার চমৎকার রাস্তা জুড়ে আলো আঁধারীর দারুণ সখ্যতা। সেই রাস্তা ধরে হাঁটছি আমরা। আমার বন্ধুর শরীর খুব একটা ভালো নয়। অনেকদিন ধরে অসুস্থ। তাই হাঁটার গতি একেবারে শ্লথ। আমিও অনেকটা জামাইহাঁটা স্টাইলে হাঁটছি। এমন হাঁটাকে শরীর চর্চার অংশ ভাবার কোন কারণ নেই। তবুও একটু হাতপা নড়াছড়া করা আর কি!

নানা বিষয় নিয়ে গল্প করছিলাম আমরা। অধিকাংশই হংকং বিষয়ক। গল্প মানে হংকং সম্পর্কে নানা কিছু জানতে চাওয়া। আমি থেকে যাবো কিনা জানতে চাইলেন আমার বন্ধু। বললেন, থাকলে থেকে যান, সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেবো। আমি হাসলাম। বললাম, চট্টগ্রাম ছাড়া দুনিয়ার কোন জায়গা আমাকে টানে না। কোনদিন টানেনি। ঢাকায় কাজ করার সুযোগ ছিল। যাইনি। আমার জেসি ভাবী আমাকে আমেরিকায় থেকে যেতে বলেছিলেন। থাকি নি। ইউরোপের অনেক বন্ধুও একই প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু বিনীতভাবে না বলেছি। জাপানে থাকার প্রস্তাব ছিল অনেক আগে। সেটাও আমার দ্বারা হয়নি। কোথাও বেড়ানো ছাড়া অন্যভাবে থাকার কথা ভুলেও চিন্তা করিনি। এমনকি ঢাকায়ও কোনদিন স্থায়ী হওয়ার কথা চিন্তা করিনি। অনেক সুযোগ এলেও চুপিসারে না করে দিয়েছি। আমার বন্ধু হাসলেন। বললেন, আপনি ঠিকই করেছেন। আমরা বিদেশে রয়ে গেছি, কিন্তু প্রাণটা পড়ে থাকে দেশে। একটি দিনের জন্যও দেশকে ভুলতে পারিনি। দেশ ছেড়ে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে থাকা অনেক কষ্টকর বলেও তিনি মন্তব্য করলেন।

উল্টো পথ ধরে ফিরে আসছিলাম আমরা। যেপথে গিয়েছিলাম সেই একই পথ ধরে বাসায় ফিরে আসলাম। কফি খাবো কিনা জানতে চাইলেন ভাবী। মাথা নেড়ে উপরে উঠে গেলাম। ট্রিপ্লেক্স বাড়ির তিন তলার রুমটিতে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দারুণভাবে পরিপাটি একটি রুম, সামনে খোলা ছাদ। আমি ফ্রেশ হয়ে রুমের বাইরে উন্মুক্ত ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিচে কফি খাবো না বলে উপরে উঠে আসলেও এখন এই নিশুতি রাতে এক মগ কফি হাতে নিয়ে ছাদের দোলনায় দোল খেতে ইচ্ছে করছিল। ভর জ্যোৎস্নায় এমন জায়গায় বসে কফি খেতে দারুণ লাগবে বলেও আমার মনে হচ্ছিল। আস্তে আস্তে নিচে নেমে এলাম। দেখি ভিয়েতনামী মহিলাটিকে ভাবী কি কি সব বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। কফির কথা বলতে ভাবী হাসলেন। বললেন, দুই মিনিট। আপনি টিভি দেখেন, আমি দিচ্ছি।

কফির মগটি নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে লাগলাম। ভাবীকে বললাম ছাদে দোলনায় বসে খাবো। ভাবী হাসলেন, বললেন, পরের বার আসতে ভাবীকে নিয়ে আসিয়েন। দুজনে দোল খেতে খেতে কফি খাবেন! আমি হেসে সায় দিলাম।

ছাদ থেকে বহু দূর অব্দি দেখা যাচ্ছিল। দেখা যাচ্ছিল হংকং এর সুউচ্চ সব টাওয়ার। প্রতিটি টাওয়ারই আলোকোজ্জ্বল। দূরের পাহাড়গুলোও বেশ হাতছানি দিচ্ছিল। মাথার উপরে চাঁদের উজ্জ্বলতা যেনো অনেক বেড়েছে। দোলনায় দোল খেতে খেতে আমি কফি খাচ্ছিলাম। গাছগাছালি ছুঁয়ে আসা হাওয়া গা জুড়িয়ে দিচ্ছিল। অন্যরকমের মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করছিল আমাকে। বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙ্গলো। তেমন কোন কাজ না থাকায় তাড়াহুড়াও ছিল না। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসলাম। দেখি বন্ধু যথারীতি টিভি দেখছেন। বাংলাদেশের নিউজ চ্যানেলে নানা খবর দেখানো হচ্ছে। আমরা নাস্তা সারলাম। বন্ধু বললেন, রেডি হয়ে আসেন। বাইরে যাবো।

মিনিট কয়েকের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেলাম। আমরা বেরিয়ে গেলাম। ভাবী বললেন, দুপুরে বাসায় চলে আসবেন। লাঞ্চ বাসায় করবেন। আমি রান্না করবো। হেসে গাড়িতে উঠলাম।

হংকং এর রাস্তা ধরে গাড়ি ছুটছিল। বন্ধু বললেন, আমি অফিসে নেমে যাবো। ড্রাইভার আপনাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে। ও সব চিনে, আপনাকে ঘুরিয়ে আনবে। ফেরার সময় আমাকে তুলে নেবেন।

আবারো ড্রাইভারের জিম্মায় যাত্রা করলাম আমি। শহর থেকে দূরে কোন গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য বললাম। শহরের ইট পাথরের বাইরে হংকং এর গ্রামাঞ্চল কেমন তা দেখার আগ্রহ দেখালাম। ড্রাইভার মাথা নাড়লো।

আমাদের গ্রামের মতো গ্রাম হংকংয়ে নেই বলে জানিয়ে ড্রাইভার বললো, সাগরের পাড়ে গেলে ভালো লাগবে। শহরের বাইরে কোথাও যেতে বললাম। ড্রাইভার গাড়ির স্পিড বাড়ালো। বড় বড় সব ভবনের পাশ দিয়ে ছুটছিল আমাদের গাড়ি। হংকংয়ের রাস্তা ধরে ছুটছি আমরা। রাস্তাগুলো চওড়া আমাদের মতোই, কিন্তু কোথাও খানাখন্দ নেই। থালার পিঠের মতো রাস্তা। সাঁই সাঁই করে ছুটছে গাড়ি। চওড়া না হলেও রাস্তার কোথাও যানজট নেই। আমি খেয়াল করে দেখলাম যে, রাস্তা দখল করে কোন গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকছে না। মোড়ে মোড়ে রিক্সা টেক্সির জটলা নেই, অবৈধ পার্কিং নেই। তাই রাস্তায় গতি থমকে যাচ্ছে না। আমার মনে হলো, আমাদের রাস্তার মোড়ে মোড়ে যে অবৈধ জটলা তা ঠেকানো এবং রাস্তাজুড়ে যে অবৈধ পার্কিং তা বন্ধ করা গেলে বিদ্যমান সড়ক দিয়েই গাড়ি চলাচলে প্রত্যাশিত গতি আনা সম্ভব। অবশ্য আমাদের মতো রিক্সা, ভ্যান কিংবা স্লো কোন গাড়িও তাদের নেই। এতো অভাবী মানুষের দোকানপাটও নেই রাস্তার উপর!

আধা ঘন্টার মতো গাড়ি চলার পর আমরা একেবারে শহরের বাইরে চলে আসলাম। ড্রাইভার বললো, আমরা গ্রামে চলে এসেছি। কিন্তু আমার চোখ ছানাবড়া হলো এটা দেখে যে, এটা আবার গ্রাম হয় কি করে। চারদিকে চমৎকার সব বাড়িঘর। পরিপাটি, গুছানো এবং সুন্দর। কিছু মাঠও দেখলাম। ফসলের মাঠ। তবে সেখানে আমাদের মতো ধান টানের ব্যাপার নেই। লেটুস পাতায় পুরো জমি সবুজ হয়ে রয়েছে, রয়েছে গাজরের ক্ষেতও। বেশ কিছু কলাবাগানও দেখলাম। দারুণ সব সারি ক্ষেতে, একেবারে গোছানো। ক্ষেতের পাশ দিয়ে চলছিল আমাদের গাড়ি। পাকা রাস্তা, রাস্তার পাশেই জমি। তবে একটিও কাঁচা রাস্তা দেখলাম না। পাহাড়গুলোও বেশ কাছে মনে হচ্ছিল।

ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললাম। নেমে আসলাম। জমির পাড়ে দাঁড়িয়ে চোখ ভরে সবুজ দেখলাম। হঠাৎ আমার চোখ পড়লো একটি খালে। জমির মাঝ দিয়ে চলে গেছে খালটি। খালের দুই পাড়ই শান বাঁধানো। পরিষ্কার পানির প্রবাহ খালজুড়ে। খালের কোথাও কোন ময়লার ভাগাড় চোখে পড়লো না। ড্রাইভার বললো, খালগুলো নদীতে গিয়ে পড়েছে।

আমি একটি জমিতে নামলাম। আইল ধরে হাঁটলাম। মাটির রঙ আমাদের মতোই, তবে লেটুসের ফলন দেখে খুবই উর্বর মনে হচ্ছিল। আমি লেটুস পাতার উপর হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। কী যে মোলায়েম!

মাঠে এবং রাস্তায় অনেকক্ষণ ধরে হাঁটাহাঁটি করলাম। আমাদের পাশ দিয়ে গ্রামের বাসিন্দাদের অনেকেই পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। কেউবা সাইকেল চালিয়ে। গাড়িও যাচ্ছিল দুয়েকটি। তবে সংখ্যায় খুবই কম। কিন্তু এত মানুষের মধ্যে কারোরই আমাদের দিকে কোন খেয়াল আছে বলে মনে হলো না। সকলেই ব্যস্ত নিজেদের কাজে। ধারে কাছের কে কি করছে তা দেখার সময় যেনো কারোরই নেই। ব্যস্ত জীবনের ব্যস্ততা সবাইকে কেবলই ছুটিয়ে চলছিল। (চলবে)

লেখক: চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

(চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকিশোরকবিতার রঙিন জগতে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ