দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৪ মে, ২০২৩ at ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

চীনের বেইজিং শহরের ইউনিভার্সেল স্টুডিওতে ঘুরতে গিয়ে মনে হচ্ছিল আমেরিকার লসএঞ্জেলসের হলিউডের বহুকিছুই এখানে নকল করে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। হুবহু একই। এমনকি ডরবি থিয়েটারের সামনের রাস্তায় বসানো ‘স্টার’ পর্যন্ত। পৃথিবীর সেরা সেরা মানুষের নাম লিখা স্টার আকৃতির পাথরগুলো কেন যে এভাবে রাস্তায় স্থাপন করা হয় কে জানে! পা দিতে খারাপ লাগে! কিন্তু আমার মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে যে, কি করে এত নিখুঁত নকল সম্ভব! একই লোগো, একই আদল। অবশ্য ইউনিভার্সেল স্টুডিও পৃথিবীর দেশে দেশে প্রায় একই আদলেই গড়ে উঠেছে। সবগুলো স্টুডিওই মনে হয় একই কোম্পানির। বিশ্বের দেশে দেশে একইনামে তারা নানা আয়োজন করে রেখেছে। বিনোদন জগতে তাক লাগাতে হাজারো আয়োজন এই স্টুডিওর পরতে পরতে! পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত এমন নিখুঁত আয়োজন সত্যিই বিস্ময় জাগে!

থ্রি ডি মুভির হলে ঢুকে পড়লাম আমরা। অন্ধকার ঘর। চোখে বিশেষ ধরনের চশমা এবং কানে এয়ারফোন লাগিয়ে একটি মুভি দেখতে দেয়া হলো। হ্যাভি এ্যাকশন। এ্যাকশন মানে এ্যাকশন। এমন এ্যাকশন যে মনে হচ্ছে এক একটি গুলী কানের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। বোমা পড়ছে, ফাটছে। যেনো পায়ের কাছেই বোমাটি ফাটলো। পায়ের তলার মাটি বুঝি কেঁপে উঠলো। পানির ঝাপ্টা বুঝি কাপড় ভিজিয়ে দিল!! একটু পানি বুঝি শরীরও ছুঁয়ে গেলো! কি করে যে এমন নিখুঁতভাবে এমন আয়োজন করা হয় কে জানে! শরীর হিম হয়ে যায়, ভয় একদম মগজের ভিতরে গিয়ে কড়া নাড়ে! একটুর জন্য বুঝি বেঁচে গেলাম!!

হল থেকে বেরুনোর পরও স্বাভাবিক হতে বেশ সময় লাগে। ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে দিনের আলোতে আসায় তীব্র আলো চোখে লাগছিল। চোখ জ্বালা করতে থাকে। একটু সয়ে নিয়ে চোখ কচলে আশপাশটা দেখে নিলাম। আমাদের দলের প্রায় সকলেই রয়েছে। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে সামনে হাঁটলাম। আমাদেরকে এবার জুরাসিক ওয়ার্ল্ডে নিয়ে যাওয়া হলো। এটির পুরোটাই কল্পনার রাজ্য। জুরাসিক ওয়ার্ল্ডে ডাইনোসরের সাথে দেখা হয়ে গেলো। কী ভয়ংকর!! ডাইনোসরের মতো বিশালদেহী প্রাণী পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে!! আসলে কী ডাইনোসর বলে কিছু ছিল? কে জানে! কোন এক সময় পৃথিবী বুঝি আরো ভয়ংকর ছিল! নাকি অনেক উন্নত ছিল! যখন ডাইনোসর ছিল, এলিয়ন ছিল! যখন পিরামিড তৈরি হয়েছিল!! আচ্ছা পিরামিড কি আসলেই মানুষে বানিয়েছে! এটি কী মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল? মেক্সিকো এবং মিসরে স্বচক্ষে পিরামিড দেখার পর আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে যে এটি মানুষের সৃষ্টি! তাহলে কী মানুষের হাতে এমন কোন প্রযুক্তি ছিল, কিংবা ডাইনোসর বশ করার মন্ত্র! এখন যেমন মানুষ হাতি পোষে, তখন কি ডাইনোসর পোষা হতো! যারা শত শত টন ওজনের পাথর শত শত ফুট উঁচুতে তুলে স্থাপন করেছিল! বিশ ত্রিশ তলা উচ্চতার এক একটি পিরামিডের শীর্ষে পাথর তোলা কী এতই সহজ ছিল!

আমাদেরকে হুড খোলা একটি ট্রেনে তোলা হলো। এটি জুরাসিক ওয়ার্ল্ডের ভিতরে চলাচল করে। ট্রেনটিতে চড়ে কত কিছুই যে দেখলাম!! ডাইনোসর মুখ হা করে আমাদের মুখ খাওয়ার জন্য তেড়ে আসছে। কিন্তু আমরা জানি যে, এটি ঠিক মুখের কাছে আসবে, তবে মুখ স্পর্শ করবে না! কী এক দুর্দান্ত প্রযুক্তি! ইতোপূর্বেও জুরাসিক ওয়ার্ল্ডে ঘুরেছি। বেশ কয়েক বছর আগে আমেরিকার হলিউডে দেখে আসা জুরাসিক পার্কের মতো এখানের আয়োজনও প্রায় একই। তবুও কাল্পনিক নানা আয়োজন দেখতে দেখতে সময় বেশ ভালোই কাটছিল।

আমরা হাঁটছিলাম। কোথাও ইচ্ছে করলে একটু দাঁড়াচ্ছিলাম। কোন কোন রাইড বেশ নজর কাড়ছিল। আমাদের অনেকেই নানা রাইডে চড়ছিলেন। আমরা সবাই মিলে সময়টাকে দারুণভাবে উপভোগ করছিলাম। ইউনিভার্সেল স্টুডিও খারাপ লাগবে বলে একটি আশংকা শুরুতে মনের উপর চাপ তৈরি করেছিল, এখন তা উবে গেছে। দারুণভাবে এনজয় করছি আমিও। পদে পদে চমকিত হচ্ছিলাম। আসলেই ইউনিভার্সেল স্টুডিও মানে চমকিত হওয়ার জায়গা। রঙিন দুনিয়ায় নিজেকে রাঙানোর এক অনন্য স্থান! আমাদেরকে ‘লাইট ক্যামেরা এ্যাকশন ’নামের একটি স্থানে নিয়ে গেলো। যেখানে লাইভ সিনেমা দেখানো হচ্ছিল। অভিনয় করছিলেন নায়ক নায়িকা। এখানেও দেখলাম বেশ এ্যাকশন। জ্বালাও পোড়াও এবং গোলাগুলির যথেচ্ছ ব্যবহার। কিছু বুঝতে পারছিলাম না, তবে নায়িকাকে নিয়েই যে মারামারির সূত্রপাত তা বেশ বুঝতে পারলাম। বাংলা সিনেমা স্টাইলের মারামারি, তবে প্রযুক্তির দারুণ ব্যবহার। ঝড়ের বেগে একটির পর একটি ঘটনা ঘটছিল। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছিল সবকিছু। চোখের সামনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। সবকিছু জ্বলে পুড়ে ছারখার হওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু একটু পরই সবই স্বাভাবিক। এতক্ষণ ধরে যে স্টেজে আগুন জ্বলছিল সেখানে একেবারে সুনসান অবস্থা! তাহলে এতক্ষণ যে আগুন জ্বললো! অলীক সবকিছু! আগুনও বুঝি অভিনয় করতে পারে!

কফির পোড়া পোড়া গন্ধ ভেসে আসছিল। কোত্থেকে আসছিল চোখ বুলিয়ে বের করার চেষ্টা করলাম। পেয়ে গেলাম। আমার খুব কফি খেতে ইচ্ছে করছিল। তাই কাউকে কিছু না বলে সেদিকে ছুটলাম। এক মগ কফি নিয়ে ফের সামিল হলাম দলে। ওয়ান টাইম মগে চুকচুক করে চুমুক দিতে দিতে এগিয়ে চলছিলাম।

প্রচুর মানুষ ঘুরছে স্টুডিওতে। নানা বয়সের, নানা জাতের। সাদা কালো বাদামী মিলেমিশে একাকার। দেড়শ’ কোটিরও বেশি মানুষের দেশটিতে বুঝি মানুষের অভাব নেই, অভাব নেই পর্যটকেরও। শুধু চীনা নয়, ধারে কাছের নানা দেশের পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বের বহু পর্যটককেও মনের সুখে ঘুরতে দেখলাম।

বলতে ভুলে গেছি যে, দুপুরে আমাদেরকে লাঞ্চ করানো হয়েছে ফাস্টফুড দিয়ে। দারুণ একটি বার্গার খাওয়ানো হয়েছে, সাথে কফি। আমি ফিশ বার্গার চেয়ে নিয়েছিলাম। দারুণ টেস্টি।

পড়ন্ত বিকেলে আমাদেরকে আবারো বাসে তোলা হলো। বলা হলো, আজকের মতো আমাদের ঘোরাঘুরি শেষ। কাল আবার দেখা হবে। এখন আমরা যে যার হোটেলে ফিরে যাবো। বাস চলতে শুরু করেছে। আমার হোটেল কতদূর কে জানে!

সন্ধ্যার দিকে বেইজিং শহরে প্রচুর ট্রাফিক। হাজার হাজার গাড়ি। এত বেশি গাড়ি যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। চীন এখন গাড়ি উৎপাদনে বেশ মনযোগ দিয়েছে। প্রচুর গাড়ি বানাচ্ছে। চীনা গাড়িতে রাস্তা সয়লাব। ‘চীনা গাড়ি’ শব্দটি শুনে আপনি যেভাবে নাক সিটকালেন আসলে ব্যাপারটি তেমন নয়। চীন নিজেদের জন্য প্রচুর মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করে। নিজেদের ব্যবহার্য সকল জিনিসই তারা ইউরোপীয়ান স্টাণ্ডার্ড মেইনটেইন করে। বিশ্বের নানা দেশ চীনা উৎপাদনকারীদের গিয়ে যাচ্ছেতাই মানের পণ্য বানাতে বলেই বলেই আমরা ‘চীনা মাল’ বলি। চীন এক হাজার টাকায় যে পণ্য নিজেদের জন্য বানায়, ঠিকই একই পণ্য একশ’ টাকায় বিদেশীদের বানিয়ে দেয়। দুইটির মানে আকাশ পাতাল ব্যবধান। চীনের যেসব নিম্নমানের পণ্য আমাদের দেশে পাওয়া যায় সেগুলোর জন্য আমাদের আমদানিকারকেরাই দায়ী, চীনা উৎপাদনকারী নয়। অল্পক্ষণের মধ্যে আমাদের গাইড মিজ শিন চেন চোখ ইশারায় আমাকে তৈরি হতে বললো। জানালেন যে, নেক্সট স্টপেজ আমার। কি বলে! মাত্র ১৫ মিনিটের দূরত্বে ছিলাম আমি। আমার হোটেল থেকে ইউনিভার্সেল স্টুডিও এত কাছে! আমার বিস্ময় টের পেয়ে মিজ শিন চেন বললেন, আগে যদি তোমাকে বিষয়টি বলতাম তাহলে হয়তো তুমি স্টুডিও না দেখে হোটেলে চলে আসতে। আমাদের এত সুন্দর একটি স্থাপনা তোমাকে না দেখালে আমার ভালো লাগতো না। মিজ শিন চেন হাসতে লাগলেন। গাড়ি বামে ইন্ডিকেটর দিয়ে দিয়েছে। আমি জানালায় চোখ দিয়ে আমার হোটেলে সাইনবোর্ড দেখতে পেলাম। অটোমেটিক দরোজা খুললে গাইড বললেন, আরাম করে ঘুমিও। কাল সকালে আবার দেখা হবে। কাল কিন্তু চীনের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা তোমাকে দেখাতে নিয়ে যাবো। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধযুগস্রষ্টা নজরুল
পরবর্তী নিবন্ধচ্যাটজিপিটি ও আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার ভবিষ্যৎ কী