(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
অসাধারণ একটি স্থাপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি, আমরা। চোখ ধাঁধানো সব কাজ কারবারের ছড়াছড়ি চীনের বেইজিং এর বার্ড নেস্ট স্টেডিয়ামের পরতে পরতে। বিশাল চীনের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া স্থাপনাটিকে নান্দনিক করতে কোন কিছুরই কার্পণ্য করা হয়নি। দুই দশমিক তিন বিলিয়ন আরএমবি খরচ করে গড়ে তোলা স্টেডিয়ামটি চীনারা নিজেদের কারিগরি দক্ষতায় নির্মাণ করেছে। নিজেদের মেধা মননের সেরাটি দিয়ে নির্মিত স্টেডিয়ামটিতে সৌন্দর্যের এত বেশি আয়োজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যে তা কুড়িয়ে চোখ জুড়ানো যায়, লিখে কাউকে বুঝানো যায় না। কিংবা লিখে বুঝানোর যে সক্ষমতা তা আমার মতো অক্ষম লেখকের নেই। স্টেডিয়ামটির নির্মাণশৈলী দেখে চোখের পাশাপাশি মনও ভরিয়ে নিলাম। আমি প্রকৌশলী নই, নির্মাণের কলাকৌশল আমার বুঝার কথা নয়, বুঝিও না। শুধু চোখের দেখায় মনের যে তৃপ্তি সেটি পেলেই আমি সন্তুষ্ট। বার্ড নেস্ট স্টেডিয়ামের নির্মাতারা দর্শকদের সেই সন্তুষ্টির পুরোটা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে।
কোত্থেকে যেনো পোড়া পোড়া কফির গন্ধ ভেসে আসছিল। এই গন্ধ আমার মগজে গিয়ে আলোড়ন তোলে, আমি মাতোয়ারা হয়ে উঠি। চোখ বুলিয়ে স্ট্রিট ফুডের আধুনিক সংস্করণ দেখা গেলো। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি দোকান, অনেকটা আরব্য তাবুর আদল। চত্বরের পাশের দোকানগুলোতে নানা ধরণের খাবারের আয়োজন। লোকজনের ভিড়ও রয়েছে। স্টেডিয়ামে খেলাধুলার কোন আয়োজন নেই, তবুও পর্যটন স্পট হয়ে উঠা স্টেডিয়ামটির বাইরে প্রচুর লোক ঘোরাঘুরি করছেন, বেড়াচ্ছেন। আমি ধীরে সুস্থে একটি দোকানে উঁকি দিলাম। বাহ, কফি মেশিন দেখা যাচ্ছে। একটি ক্যাপাসিনো অর্ডার করলাম। বেশ চড়া দাম নিয়ে আমাকে এক মগ কড়া গরম কফি দেয়া হলো। ওয়ানটাইম মগে দেয়া কফিতে একটি চুমুক দিলাম। বাহ, দারুণ! হাতে কফি নিয়ে আমি মুল দলের কাছে ফিরে আসলাম। মিজ পিনং কফি খাবেন কিনা জানতে চাইলাম। তিনি তার হাতে থাকা ফ্ল্যাক্সের গ্রীন টি দেখিয়ে আমাকে থ্যাঙ্কু বললেন।
আরো কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম আমরা। স্টেডিয়ামের পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষের নানা কাজকারবারও দেখলাম। অনেকেই সাইকেলিং করছে, অনেকেই হালকা ব্যায়াম করছেন, অনেকেই বসে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। শিশু কিশোরদের ছোটাছুটি চলছিল সমানতালে। মিজ পিনং ফেরার তাড়া দিলেন। পড়ন্ত বিকেল, সূর্য ডুবু ডুবু করছে। দারুণ উপভোগ্য একটি সময়। প্রকৃতি ভেসে যাচ্ছে কনে দেখা আলোয়, মোহনীয় এক আভা চারদিকে। যেনো বসন্তের ছড়াছড়ি!
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে আমার চোখ ছানাবড়া হতে শুরু করলো। আলোর বান ডাকতে শুরু করেছে চারদিকে। কী পরিমান আলো যে এক একটি ভবন থেকে ঠিকরে ঠিকরে বেরুচ্ছে তা বলে বুঝানো কঠিন! এক রঙের আলো নয়, হরেক রকমের বর্ণিল ছটায় এক একটি ভবন যেনো এক একটি রঙধনু। আরে কী হচ্ছে এসব!! বার্ড নেস্ট স্টেডিয়ামের খোপ থেকে যেনো ঠিকরে ঠিকরে বের হচ্ছে লাল নীল বেগুনি গোলাপী আলো। সাত রঙের নাম মুখস্থ করেছিলাম ছোট বেলায়, এখন দেখছি হাজার রঙ। এত রঙের মাখামাখিতে বার্ড নেস্ট অন্যরকমের বর্ণিল হয়ে উঠলো। ক্ষণে ক্ষণে পাল্টে যাচ্ছিল রঙ। ঠিক যেনো দুবাইর বুর্জ আল খলিফা কিংবা গুয়াংজুর টাওয়ারের মতো! রঙের মাখামাখি আমার শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল, মনও।
চীনে একটি জিনিস খেয়াল করেছি, চীনে প্রচুর বিদ্যুতের ব্যবহার হয় আলোর খেলায়। সুউচ্চ ভবনগুলোর প্রায় প্রতিটিরই দেয়াল জুড়ে চলে হাজার রঙের মোহনীয় সব কাজকারবার! এক একটি দেয়াল হয়ে উঠে ঢাউশ সাইজের টিভি পর্দা, যাতে প্রজেক্টর দিয়ে বিজ্ঞাপন চলে! পণ্যের বিজ্ঞাপনের রমরমা অবস্থা চীনের প্রায় সব শহরে।
মিজ পিনং আমাদের তাড়া দিয়ে বললেন এবার ফিরতে হবে। রাস্তায় এখন প্রচুর ট্রাফিক। জ্যামে পড়তে হতে পারে। আরো আগে ফেরা উচিত ছিল। অনেক দেরি হয়ে গেল। তিনি বেশ চটপট করে আমাদেরকে দেরি হয়ে যাওয়ার ভয়াবহতা বুঝানোর চেষ্টা করছিলেন। আমি মনে মনে ‘দেরি হওয়া’কে ধন্যবাদ দিলাম। দেরি না হলে কি এমন রঙের মাখামাখি দেখতে পেতাম! দিনের বেলায় কী এমন অপরূপ বার্ড নেস্ট দেখা যেতো!!
বার্ড নেস্ট ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছিল না। আমার খুব ইচ্ছে করছিল খোলা চত্বরটিতে বসে রাতের একটি অংশ কাটিয়ে দিতে। কী অপরূপ চারদিক, কী যে মোহনীয়! কিন্তু আমি জানি না যে আমার হোটেল এখান থেকে কতদূরে, একা একা ফিরতে কি পরিমাণ বেগ পেতে হবে তাও বুঝতে পারছিলাম না। তাই অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও বাসে চড়ে বসলাম। আমাদের সবাই বাসে চড়ে ফিরতি যাত্রার জন্য তৈরি হয়ে গেলেন। মিজ পিনং আমাদের সকলের মাথা গুনলেন। আমাদেরকে সাথের জন উঠেছে কিনা দেখতে বললেন। সব ঠিকঠাক থাকার পর গাড়ি ছেড়ে দিল।
গাড়ি কিছু দূর আসার পর আমাদের গাইড মিজ পিনং হ্যান্ডমাইক হাতে নিলেন। তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, আমি একটু পরই নেমে যাবো। কাল আর আমার সাথে আপনাদের দেখা হবে না। অন্য গাইড আপনাদেরকে অন্য স্পটগুলো দেখাতে নিয়ে যাবে। তিনি বললেন, আমার বাসা একটু পরেই। ওখানে না নামলে আমার ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে। ড্রাইভার আপনাদের প্রত্যেককে প্রত্যেকের হোটেলে পৌঁছে দেবেন।
পিনং বললেন, দিনভর আপনাদের সাথে ছিলাম। আমি প্রতিটি স্পট সম্পর্কে আমার জানার সর্বোচ্চটা আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করেছি। তবুও যদি কোন ভুল হয়ে থাকে আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার নামার সময় হয়ে গেলো। আপনারা অনেক ভালো থাকবেন।
বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে হাত নেড়ে বিদায় নিলেন মিজ পিনং। বাসটি একটি স্থানে থামলে তিনি নেমে পড়েন। বাস থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তিনি আবারো হাসিমুখে হাত নাড়লেন। মনে মনে বললাম, মায়াবতী মেয়ে, জীবনে আর কোনদিন দেখা হবে না। তবুও আপনি অনেক ভালো থাকবেন!!
আমাদের বাস চলছিল। রাতের বেইজিং শহর, রাস্তায় আলোর বন্যা। এত বেশি আলো যে হেড লাইড না জ্বালিয়েও গাড়ি চালানো সম্ভব। উভয় পাশের সউচ্চ ভবনগুলো থেকে প্রচুর আলো ঠিকরে এসে পড়ছে রাস্তায়, স্ট্রিট লাইটের আলোরও রয়েছে আধিক্য। প্রচুর গাড়ি, প্রতিটি গাড়ির হেড লাইটের আলোও রাস্তায়। সবকিছু মিলে আলোয় আলোয় ভরে আছে সবকিছু।
ট্রাফিক জ্যামের দেখা মিললো। বেইজিং শহরের লাখ লাখ মানুষ ঘরে ফিরছেন। কেউবা যাচ্ছেন অফিসে। চীনের কারখানাগুলোতে রাতে দিনে কাজ চলে। শিফটিং ডিউটি। তাই ঘরে ফেরা মানুষের পাশাপাশি কাজে যাওয়া মানুষেরও বিশাল চাপ রাস্তায়। নিজেরা গাড়ি বানায় এবং দাম তুলনামুলকভাবে কম হওয়ায় ঘরে ঘরে জনে জনে গাড়ি। যার সরাসরি ধকল রাস্তায়!
একটি হোটেলের সামনে এসে বাসটি থামলো। বেশ কয়েকজন নেমে পড়লেন। চেনাজানা না থাকলেও নামার সময় তারাও হাত নেড়ে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন, শুভরাত্রী জানালেন। আমার হোটেল আর কতদূরে কে জানে! কতক্ষণ লাগবে তাও বুঝতে পারছিলাম না। গুগল ম্যাপে দেখে নেয়ার সুযোগ থাকলেও চীনে ইন্টারনেটের যে নিয়ন্ত্রিত বেহাল অবস্থা তাতে খুব বেশি সুবিধা করতে পারছিলাম না।
ভীষণ টায়ার্ড লাগছিল। শরীরেই বা দোষ কী! ভোর থেকে মূলতঃ রাস্তায়, পথে। ছোটাছুটিও হয়েছে প্রচুর। ক্ষুধাও টের পাচ্ছিলাম। ক্ষুধার কথা মনে পড়তেই আমার কপালে ভাঁজ পড়লো। রাতে তো আমাকে নিজের খাওয়া নিজেকে খেতে হবে। কিন্তু হোটেল পাবো কোথায়? হোটেল খুঁজে–টুজে নিলেও খাবো কি! ভাত, মাছ, ডাল বা সবজির কথা বুঝাবো কি করে! বাইরে খোঁজাখুঁজি না করে হোটেলের রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিলেই ভালো হবে বলেও মনে হলো।
আরো একটি হোটেলের সামনে প্যাসেঞ্জার নামিয়ে দেয়া হলো। ড্রাইভার আমার চোখে চোখ রেখে কিছু একটা বললেন। আমি নিজে নিজে অর্থ করে নিলাম যে, নেক্সট আমি। আমার হোটেল থেকে শুধুমাত্র আমি একজনই এই ট্যুরে এসেছি। শুধুমাত্র একজন প্যাসেঞ্জার নামানোর জন্য এতদূর যেতে হচ্ছে তাকে। বেচারা কি আমার উপর বিরক্ত!
মিনিট দশেক পর আমার হোটেলের সামনে বাসটি থামলো। ড্রাইভার আমাকে ইশারা করে দরোজা খুলে দিলেন। হাসিমুখে হাত নাড়লেন। বুঝতে পারলাম যে, তিনি বিরক্ত হননি। (চলবে) লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।