আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল। ১৯৯১ সালের ভয়াবহ এই ২৯ এপ্রিলের স্মৃতি উপকূলের মানুষকে এখনো কাঁদায়। দিনটি উপকূলীয় এলাকার জন্য শোকাবহ দিন। দুঃসহ সেই ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতি বয়ে নিয়ে আবারও উপকূলীয় মানুষের কাছে এসেছে দিনটি। গত কয়দিন থেকে প্রচণ্ড খরতাপে উপকূলের মানুষের যেন প্রাণ ওষ্ঠাগত। ২৯ এপ্রিলের মতো ফের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের আশংকায় উপকূলবাসী।
ওই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গিয়েছিল কক্সবাজার জেলার মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর, চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালীসহ দেশের ১৩টি উপকূলীয় জেলার শত শত ইউনিয়ন। ঘণ্টায় ২০০ থেকে ২৫০কিলোমিটার গতিবেগের প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় এবং ২৫ থেকে ৩০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে দেশের উপকূলীয় এলাকা পরিণত হয়েছিল বিরাণভূমিতে। এখনো উপকূলীয় অনেক এলাকা অরক্ষিত। বর্ষা আসলে সেই ভয়াল দিনের কথা স্মরণ করে আতংকে থাকে ভুক্তভোগীরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় হওয়ার একটি বড় কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। পাহাড়ের বরফ গলে সমুদ্রে মিশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া আমাদের সুপেয় পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। লোনা পানি আমাদের নদ–নদীগুলোতে মিশে পানিদূষণ ঘটাচ্ছে। বিশেষত দেশের দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে বিস্তৃত অঞ্চলে মাটির নিচে লবণাক্ত পানি ঢুকে যেতে শুরু করেছে। এগুলো সবই জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব। তবে এক্ষেত্রে আমাদের কাজ করার পরিসর সীমিত। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি তো একা একটি দেশের পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়। প্রতিটি দেশই কোনো না কোনোভাবে এর পেছনে দায়ী। এক্ষেত্রে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করতে পারি। অবশ্য এ বিষয়ে সব সময়ই বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়। আবার নতুন ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আনতেও দেখা যায়। অথচ প্রতিবারই দেখা যায় এই পদক্ষেপগুলো ব্যর্থ হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রতি বছরই ঝড়, বৃষ্টি ও বন্যাসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে রোধ করার কোনো উপায় নেই এটা যেমন ঠিক, তেমনি প্রস্তুতি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত হলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমানো সম্ভব– যা আমলে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা রাখতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স অধ্যাপক মো. জিল্লুর রহমান তাঁর এক লেখায় বলেছেন, দুর্যোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমরা বরাবরই অন্য দেশের দিকে তাকাই। বিষয়টি ভুল তা নয়। কিন্তু অন্য দেশের প্র্যাকটিসকে হুবহু এখানে বসিয়ে দেওয়াটা মোটেও বিজ্ঞানসম্মত নয়। আমাদের ভূ–প্রকৃতি, মানুষের জীবন, অবকাঠামো, প্রকৃতির রূপভেদ ইত্যাদি বিবেচনা করে ওই প্রযুক্তিকে খাপ খাওয়াতে হবে। প্রযুক্তি তখনই আশীর্বাদ হয় যখন তা খাপ খাওয়াতে সক্ষম হয়। ষাটের দশকের পর অনেক জায়গায় বাঁধ গড়ে তোলা হয়েছিল। বন্যার পানি যেন ঢুকতে না পারে, সেজন্য স্লুইসগেট তৈরি করা হয়েছিল। পরে স্লুইসগেট আমাদের জন্য মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্লুইসগেটের উদ্দেশ্য তো সফল হয়ইনি, উল্টো ওই এলাকায় বছরের পর বছর জলাবদ্ধতা একটি বড় সমস্যা হয়ে টিকে ছিল। অর্থাৎ দুর্যোগপরবর্তী সময়ের পরিকল্পনা অনেক জরুরি। একটু ভুল হলে তা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এজন্য বিশেষায়িত বিভাগ রয়েছে এবং এসব পরিকল্পনায় বিশেষজ্ঞদের ডেকে আনা হয়। তবে অধিকাংশ সময়ে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞদের আনা হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল না থেকে দেশের বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। কারণ এই ভূখণ্ডের সঙ্গে যারা পরিচিত, তারাই এ বিষয়ে সবচেয়ে ভালো সমাধান বের করে দিতে পারবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিবেশ বিজ্ঞান বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক বিভাগের গবেষকদের সংযুক্ত করা গেলে একটি ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
মোট কথা, ঝড়ের তাণ্ডবসহ যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি রাখতে হবে, মানুষকে সচেতন করতে প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করে পুনর্বাসনেও উদ্যোগ নিতে হবে। একইসঙ্গে সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে যে কোনো ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ ও তার যথাযথ বাস্তবায়নে সামগ্রিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে।