শত দুর্ভোগ আর যন্ত্রণার নাম কালুরঘাট সেতু। এই দুর্ভোগ যেন শেষই হতে চায় না। দিন-মাস নয়, বছরের পর বছর কালুরঘাট সেতুর দুর্ভোগ বোয়ালখালীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের একাংশের জনগণের নিত্য সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতিতে বছরের পর বছর পার হয়ে যাচ্ছে এই অঞ্চলের মানুষের। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি আর পূরণ হয় না। নতুন সেতুর স্বপ্ন-স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর। দুই বছর আগে রেল কর্তৃপক্ষ দুই লেনের সড়ক কাম ডুয়েল-গেজ সিঙ্গেল ট্র্যাক রেল সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই অনুযায়ী প্রকল্পের ড্রইং-ডিজাইন, প্রকল্পের বাজেট এবং প্রকল্পের মেয়াদ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল। রেল কর্তৃপক্ষের এই ডিজাইনে নদী থেকে সেতুর উচ্চতা ৭ দশমিক ৬ মিটার করলে তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি নদী থেকে সেতুর উচ্চতা ১২ দশমিক দুই মিটার হতে হবে। তাতেই আটকে যায় নতুন সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সমস্ত কার্যক্রম। নতুন সেতুর ব্যাপারে এবার নতুন করে ফিজিবিলিটি স্টাডি করছে সেতুর অর্থ দাতা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ কোরিয়ার এঙ্মি ব্যাংক। যেহেতু সেতুর উচ্চতা বেড়েছে, সুতরাং আগের ডিজাইন আর কাজে লাগছে না। নতুন ডিজাইনে সেতুর ব্যয় কত হবে তা নতুন সমীক্ষার পর র্নিধারণ হবে বলে রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগ থেকে জানা গেছে। ব্রিটিশ আমলে কর্ণফুলী নদীর উপর নির্মিত কালুরঘাট সেতুটি ব্যবহার এখন অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। সেতুর উভয় পাশের ডেক এবং লোহার বেড়া প্রায়ই নষ্ট হয়ে গেছে। সেতুতে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। ফলে
দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার যানবাহন সীমাহীন দুর্ভোগ মাড়িয়ে চলাফেরা করছে। প্রতি বছরই কর্তৃপক্ষকে সেতুটি মেরামত করতে হয়। ১৯৩১ সালে নির্মিত এই সেতুটি মূলত একটি রেলসেতু ছিল। তবে, ৬০ এর দশকে এটিকে রেল-কাম-সড়ক সেতুতে রূপান্তর করা হয়। কালুরঘাট সেতুটি এখন কেবল বোয়ালখালী, রাঙ্গুনিয়া এবং মোহরাবাসীর দাবিতে নেই। এই সেতুটি এখন দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সেতুর উভয় পাশের মানুষ এই সেতু নির্মাণের দাবি করে আসছে। বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য মাঈনুদ্দিন খান বাদল কালুরঘাট সেতু নির্মাণে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে সর্বত্র সোর্চ্চার ছিলেন। একই ভাবে এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদও এই সেতু নির্মাণে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু নানান কারণে কালুরঘাট সেতুর নির্মাণ কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। নির্মাণ কাজ শুরু হতে আরো ২-৩ বছর লাগবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের সেতু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এই ব্যাপারে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ব্রিজ) আহসান জাবির আজাদীকে জানান, দাতা সংস্থা নতুন কালুরঘাট সেতুর প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি করছে। ইনভেস্টের জন্য দাতা সংস্থা নিজেরাই এ কাজটি করে। এখন পুরোটাই (ফিজিবিলিটি স্টাডি, ডিজাইন, বাজেট) নতুন করে করতে হবে। আমরা ডিজাইন করবো, তারপর ঠিকাদার নিয়োগ করবো। কাজ শুরু করতে ২-৩ বছর লেগে যাবে।
এদিকে নতুন করে সেতু নির্মাণ কার্যক্রম বিলম্বিত হওয়ায় কালুরঘাট বিদ্যমান (পুরনো) সেতু মেরামতের জন্য বুয়েটের দ্বারস্থ হয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। বিদ্যমান পুরনো সেতুটি মেরামতের জন্য বুয়েটকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাওয়ার জন্য আবেদন করলে তাতে বুয়েট সাড়া দেয়। গত মাসে বুয়েটের ৩ সদস্যের বিশেষজ্ঞ টিমের সদস্যরা কালুরঘাট সেতু সরেজমিনে পরির্দশন করেছেন। তারা শহর থেকে পায়ে হেঁটে বোয়ালখালী পর্যন্ত পুরো সেতু প্রত্যক্ষ করেন। এরপর নৌকায় করে নদী থেকে সেতুর নিচের অংশও প্রত্যক্ষ করেন।
মূলত বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যদের পরামর্শ অনুয়ায়ী শতবছরের জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতু মেরামত করা হবে বলে জানান রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) আহসান জাবির। তিনি গতকাল আজাদীকে জানান, বুয়েট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী জানুয়ারির মধ্যেই কালুরঘাট সেতুর সংস্কার কাজ শুরু হবে। বাড়ানো হবে লোড ক্যাপসিটি। সেতু যারা ব্যবহার করেন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। অধিক যাত্রী নিয়ে যাতে সেতু দিয়ে ট্রেন পারাপার হতে পারে সেভাবে মেরামত করা হবে। বুয়েটের পরামর্শের উপর ভিত্তি করে আমরা টেন্ডার আহ্বান করবো। তারপর কাজ শুরু করবো।
বোয়ালখালী আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য জাসদের মাঈনুদ্দিন খান বাদল জীবিত থাকাকালীন একাধিকবার কালুরঘাট সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সংসদে একাধিকবার কালুরঘাট সেতুর দুর্ভোগের কথা তুলে ধরেছেন। কিন্তু চেষ্টা করেও অগ্রগতি না হওয়ায় তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। সেই স্বপ্ন নিয়েই ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর মারা যান তিনি।
২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি মোছলেম উদ্দিন আহমদ এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর কালুরঘাট সেতু নির্মাণের ব্যাপারে রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন, রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালকসহ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সরেজমিনে পুরনো কালুরঘাট সেতুর দুর্ভোগ সরজমিন দেখাতে নিয়ে আসেন। সেতুর বোয়ালখালী অংশে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভার আয়োজন করেন। ওই সভায় রেলমন্ত্রী পরবর্তী এক বছরের মধ্যে কালুরঘাট সেতুর নির্মাণের কাজ শুরু হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনো সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়নি। তাই শেষ হয়নি এই অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগও।











