দুর্গাপূজা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের চিরকালীন শাশ্বত সর্বজনীন উৎসব। বাঙালির ঐতিহ্যের উৎসবও বটে। দুর্গাপূজার আনন্দ উৎসবে উদ্বেলিত হন নাই, এমন সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শৈশবের দুর্গাপূজার স্মৃতি আমাদের সকলের মনে এখনো অমলিন। দুর্গাপূজা এলেই আমরা নস্টালজিয়ায় ফিরে যাই কেউ কেউ, বিশেষ করে যাদের সাথে পূজার সম্পৃক্ততা যে কোন কারণে সবসময় একটু বেশিই ছিলো। যারা হয়তো সময় বা ব্যস্ততার কারণে এখন অনেকটাই দূরে, কিন্তু সেই দিনগুলোকে তারা এখন দারুণভাবে মিস করেন। পাড়ায় পাড়ায় একসময় দারুণ জমজমাট পুজো হতো। শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে এগিয়ে থাকা অনেক এলাকার পূজা ছিলো সেই অঞ্চলের সেরা। সেরা ছিলো সেই অর্থে সেখানে প্রতিদিন ধর্মীয় নাটক,ধর্মীয় যাত্রাপালা, ধর্মীয় সংগীতানুষ্ঠান ও নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সমৃদ্ধ ছিলো প্রতিটি দিন। অনেক আগে থেকেই এগুলোর রিহার্সেল হতো। এখন সেই সব দিনের পরিবর্তন ঘটেছে। পূজার সেই রীতি, আচার, আনন্দেতেও এসেছে এক ধরনের পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনের ছোঁয়ায় পুজো তার সাত্ত্বিক তত্ত্ব হারিয়ে হয়ে উঠেছে এক ধরনের শুধুই বিনোদনের মাধ্যম। সেই বিনোদনের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি অনেকটাই ম্লান। চারিদিকের পূজা দেখলেই তা সহজেই দৃশ্যমান হবে। তবুও কোনো কোনো জায়গায় এখনও এসব অপসংস্কৃতির ঢেউ আচঁড়ে পড়েনি। এসব দেখে ভালো লাগে। কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানভিত্তিক পূজা এখনো পূজার সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। আমরা চাই পুজোর নামে কোন সস্তা কোনো বিনোদন নয়, পুজো হয়ে উঠুক রীতি আচার সমৃদ্ধ সত্যিকারের সাত্ত্বিক পুজো। সমাজ থেকে সকল অপশক্তি ও অসুর শক্তি বিনাশ করে মানব জাতির কল্যাণ বয়ে আনার প্রাার্থনাতেই দুর্গাপূজার মাহাত্ম্য। সাত্ত্বিক পূজার ব্যাখায় বলা হয় পত্র, পুষ্প, ফল, জল ভক্তিসহকারে ঈশ্বরকে অর্পণ নামই হচ্ছে সাত্ত্বিক পূজা। বিশ্বাস করা হয়, এভাবে ভক্তি সহকারে পূজা নিবেদিত হলে ঈশ্বর তা গ্রহণ করেন। আত্মনিবেদন মানে হচ্ছে ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ। ভক্তির মাধ্যমেই ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা যায়। হৃদয়ে ভক্তির উদয় মানে হৃদয়ে ঈশ্বরের অনুভব। পূজার অর্থ ঈশ্বরের প্রশংসা বা ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। আর ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা বা তার রূপ সম্মুখে ভক্তিসহকারে পত্র, পুষ্প, ফল, জল, ধূপ, দীপ প্রভৃতিতে উপাসনা করাকেই বলে সাত্ত্বিক পূজা। সর্বশক্তিমান পরম স্রষ্টার নিকট মাথানত করা কিংবা স্রষ্টাকে কাছে পাবার মূল অনুষঙ্গ হচ্ছে পূজা। পূজার মাধ্যমেই আমাদের আত্মশুদ্ধি ঘটে। নিজেদের মধ্যে আত্মজাগরণ ঘটাতে পারলেই পূজা হয়ে ওঠে মহিমান্বিত। আমাদের মনে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের অশুভ শক্তি জাগ্রত হয়, প্রতিনিয়ত নানা আসুরিক শক্তির সাথে বসবাস করেই আমাদের পথ চলা। অশুভ শক্তিগুলো দূর করতে পারলেই আমাদের মনের আত্মজাগরণ ঘটতে পারে। পূজা অর্চনা করেই আমাদের মনের অশুভ শক্তি দূর করা যেতে পারে। মনে সাত্ত্বিকভাব নিয়ে পূজা অর্চনা করতে না পারলে হৃদয় পবিত্র হয়ে ওঠে না। সাত্ত্বিকতা ও পবিত্রতার মাধ্যমেই আত্মশুদ্ধির পাঠ নিতে হয়। আর আত্মশুদ্ধি হলেই পূজা হয়ে ওঠে সাত্ত্বিক। বর্তমান সময়ে সাত্ত্বিক পূজার ঘোর প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে রাজসিক ও তামসিক পূজা। এই রাজসিক ও তামসিক পূজার কোপানলে পড়ে পূজার প্রকৃত মাহাত্ম্য হারিয়ে যেতে বসেছে। পূজার সাথে প্রাসঙ্গিক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলোসহ পূজা সংশ্লিষ্ট সংগীত, নাটকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পূজার আনন্দের অনুষঙ্গ অবশ্যই। পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় শহরে নগরে এ সব অনুষ্ঠান এলাকার যুব সমপ্রদায়ের মধ্যে এক ধরনের সাংস্কৃতিক গণজাগরণ সৃষ্টি করে। এর সুদূরপ্রসারী একটি ইতিবাচক দিক অবশ্যই আছে। কিন্তু পূজার প্রাসঙ্গিকতার সাথে একেবারে যায় না এমন কর্মকাণ্ড পূজার পবিত্রতাকে নষ্ট তো করছেই বরং সমাজে ধর্ম বা পূজা সম্পর্কে একটি ভুল বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। সাত্ত্বিকতার মূল স্রোতকে পাশ কাটিয়ে প্রতিনিয়ত তামসিকতার গড্ডালিকা প্রবাহে ক্রমশ আমরা আত্মনিবেদন করছি।
ফলে প্রাণের স্পন্দন, আত্মজাগরণ কিংবা আত্মশুদ্ধির বিষয়গুলো গৌণ হয়ে যাচ্ছে বারবার। বাহিরের চাকচিক্যের আবরণে আমরা মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। কামনা বাসনা লোভ মোহকে ঘিরেই যেন আমাদের পথচলা। মনের দৈন্যকে প্রসারিত করতে করতে পূজার সাত্ত্বিক দিকটাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। পূজা হচ্ছে আমাদের এই সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে সকল অশুভ শক্তি বিনাশের জন্য ঈশ্বরের আবাহন। সেই পূজার প্রকৃত অর্থ ভুলে গিয়ে কোথাও কোথাও পূজার নামে উন্মাতাল নৃত্য, এক ধরনের শ্রদ্ধাহীন কর্মকাণ্ডের প্রদর্শনী আমাদের পূজাকে করছে কলুষময়, যা পূজার মূল আদর্শের সাথে সংগতিপূর্ণতো নয়ই, বরং তা সাংঘর্ষিক। সাত্ত্বিকতা বর্জিত পূজা মঙ্গলময় হতেই পারে না, বরং আমাদেরকে সে ধরনের পূজা নানা ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলে। এই দুর্গাপূজা বিধিসস্মতভাবে পালিত হলে সমাজে হানাহানি, হিংসা, দ্বেষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, কূপমণ্ডূকতা কুসংস্কার, প্রেম প্রীতি, সাম্য এবং সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সমাজ হয়ে উঠতে পারে কলুষমুক্ত এক অনাবিল সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি। ধর্মীয় আচার আচরণের মত বিষয়গুলো একান্ত বিশ্বাসের ব্যাপার এবং সে বিশ্বাসের মধ্যে ইতিবাচক দিকই বিদ্যমান।
যদি ধর্মীয় বিষয়গুলো কিছু ব্যক্তির বিতর্কিত করার প্রয়াসে আবর্তিত হয় তাহলে নানা ধরনের বিভেদ তৈরি হতেই পারে। যেটা মোটেও কাম্য নয়। পূজার সময় বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় নানা কমিটি গঠনের মাধ্যমে পূজা হয়। সে কমিটি বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক ধর্মীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সাত্ত্বিক পূজার বিষয়টিও যাতে সঠিকভাবে সম্পাদিত হয় তার দিকে নজর রাখতে পারে। সমাজে উঠতি কিছু তরুণের চাহিদার কাছে আত্মসমর্পণের কোনো সুযোগ নেই। পূজা হউক ঢাক ঢোলের ঝংকারে, ছন্দময় সুরে, কাঁসা ঘণ্টার আনন্দধ্বনিতে, শঙ্খ আর উলুধ্বনির পবিত্র আবাহনে শারদীয়া আকাশের শুভ্র আলোয় আলোকিত। জীবের কল্যাণের জন্যই পূজা। আর দুর্গতি নাশের জন্যই তো শারদীয়ক্ষণে দুর্গার আবাহন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।