(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চীনের তাইজুর সাউথ গ্রেট ওয়ালের উপর দিয়ে হাঁটছিলাম। শত শত নারী পুরুষ হাঁটছেন। ঘামে গরমে একাকার হয়ে হাঁটছিলেন মানুষ। বেইজিংয়ের গ্রেট ওয়ালের মতো অগুনতি মানুষ না থাকলেও এখানেও পর্যটকের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। চীনা জনগোষ্ঠির পাশাপাশি পশ্চিমা সাদা চামড়ার অনেকের দেখা মিললো। শিশুরা দেয়ালের উপরে ছোটাছুটি করে ঘুরছে, বয়স্করা ঢিমেতালে। তবে সবার চোখে মুখে ভিন্নমাত্রার আনন্দ ঝিলিক দিচ্ছিলো। কষ্টকর এক পথচলাও যে এমন আনন্দ ছড়িয়ে দিতে পারে তা বেশ বুঝতে পারছিলাম আমি। মনে হচ্ছিলো, সাউথ গ্রেট ওয়াল দেখার তৃপ্তি যেনো মানুষে মানুষে সংক্রমিত হচ্ছিলো।
কী দুর্দান্ত এক নির্মাণ! কী দুর্দান্ত আয়োজন! এক হাজার বছরেরও বেশি আগে আগে কী করে যে এমন একটি স্থাপনা নির্মাণের কথা সম্রাটের মাথায় এসেছিল? কি করে এমন স্থাপনা নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল কে জানে! বিজ্ঞানের নিশ্চয় তখন এখনকার মতো জয়জয়কার ছিল না। আজকের দিনের প্রযুক্তি বা যান্ত্রিক সুবিধার কথাতো তখন কল্পনাও করা যায়নি। অথচ, চীনের মিং সাম্রাজ্যের মানুষেরা নিজেদের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে কী অসাধ্যই না সাধন করেছিলেন!
তাইজুর সাউথ গ্রেট ওয়ালের স্থাপত্যশৈলী অসাধারণ। শুধু অসাধারণ বললে কম বলা হবে, আজকের বিশ্বের জন্যও এটি একটি দুর্দান্ত নির্মাণ, অত্যন্ত চিত্তাকর্ষকও। যেদিকে তাকাচ্ছিলাম, চোখ ফিরানো যাচ্ছিলো না। যদিও এটি চীনের প্রধান গ্রেট ওয়ালের মতো বিশাল নয়, তবে এর নির্মাণশৈলী প্রায় ওটির মতোই, সমানভাবে বিস্ময়কর। দেয়ালটি ঘিরে প্রচুর গাছগাছালি। নিচ থেকে উঠে আসা বড় বড় সব গাছের ঢালপালা ছড়িয়ে রয়েছে দেয়ালের উপরে, পাশে। সবুজে সবুজে ভরে থাকা একটি অঞ্চলে পোড়া ইটের সাউথ গ্রেট ওয়ালের অনন্য নির্মাণশৈলী দ্যুতি ছড়াচ্ছিলো চারপাশে।
পাহাড়ের ঢালু পথ ধরে আঁকাবাঁকা করে নির্মিত সাউথ গ্রেট ওয়াল। এটি কখনো পাহাড়ের ঢালু বেয়ে উপরে উঠেছে, আবার কখনো নিচের দিকে নেমে আবারো বাঁক নিয়েছে। মনে হয় পাহাড় না কেটে, পাহাড়কে পাহাড়ের আদলেই রেখেই তারা সাউথ গ্রেট ওয়াল নির্মাণ করেছিল। এটির নির্মাণশৈলী দেয়ালের সৌন্দর্য যেমন বাড়িয়েছে তেমনি তৎকালে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়ও বিশেষভাবে ভূমিকা রেখেছে। পাহাড়ের উপরে অবস্থান নিয়ে নিচের দিক থেকে আসা শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করা যে সহজ তা এক হাজার বছরেরও বেশি সময় আগেকার মানুষও যে বেশ রপ্ত করেছিল তা বুঝা যাচ্ছিলো দেয়ালটির নির্মাণের কৌশল দেখে।
পাহাড়ের উপর দেয়ালটির উচ্চতা সর্বত্র সমান নয়। এখানেও দারুণ এক ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ করেছে। কোথাও দেয়াল উঁচু করা হয়েছে ১০ ফুটের মতো আবার কোথাও ৭ ফুট। তবে অন্তত ৮ ফুট চওড়া দেয়ালটির উপরের অংশটি ঢালু হলেও পুরোপুরি সমতল। দেয়ালের উপর দিয়ে সৈনিকদের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে নানা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দেয়ালের উপরে ঘর নির্মাণ করে বানানো হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। কোথাও বেশ বড়সড় দোতলা ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। পুরোপুরি ঘরের মতো। এই ঘরে অবস্থান করেও চারদিকের সবকিছু মনিটরিংয়ের সুবিধা রয়েছে। আমরা একটি ওয়াচ টাওয়ারে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। দোতলা ঘরের ছাদেও চক্কর দিয়ে আসলাম। আসলে আমাদের কোন তাড়া নেই, যতটুক সম্ভব দেখে যাওয়াটাই এই মুহূর্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে হচ্ছিলো। তাই যতটুকু সম্ভব সবটুকু ঘুরে টুরে দেখতে আমরা কাহিল হলেও হয়রান হচ্ছিলাম না। প্রচন্ড গরম লাগলেও বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, এই গরমকে গুরুত্ব দিলে সাউথ গ্রেট ওয়াল পুরোপুরি দেখা হবে না। জীবনে হয়তো আর কখনো আসাও হবে না।
আগেই বলেছি যে, তাইজুর সাউথ গ্রেট ওয়াল ছিল মিং সাম্রাজ্যের এক অনন্য সামরিক স্থাপনা। এটি শুধু শত্রুপক্ষ মিয়াও জনগোষ্ঠির আক্রমণ প্রতিরোধই নয়, একইসাথে সাম্রাজ্যের সীমান্ত দেয়াল হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। সম্রাট দেয়ালটির নিকটবর্তী অঞ্চলে বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটিও স্থাপন করেছিলেন। ওই ঘাঁটিগুলোতে সশস্ত্র সৈনিকেরা অবস্থান করতো। এমন একটি ঘাঁটিতে তখনকার সৈন্যদের ব্যবহৃত তীর বর্শাসহ নানা সরঞ্জাম পড়ে থাকতেও দেখলাম। অবশ্য দেয়ালের উপরও কামান দাগানোর বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। শত্রুপক্ষের গোলা কিংবা বর্শা থেকে নিজেদের রক্ষা করে নিরাপদে কামান দাগানোর জন্য ঢাল হিসেবে লোহার পোশাক তৈরি করে রাখা হয়েছে। যেখানে একজন মানুষ দাঁড়ালে তাকে আর কপোকাৎ করা সম্ভব হতো না। কারণ তার পুরো শরীর তখন আচ্ছাদিত হয়ে যেতো লোহার পোশাকে। মিং সাম্রাজ্যের সৈন্যরা যেভাবে দাঁড়িয়ে কামান দাগাতো আমরাও ঠিক সেইভাবে দাঁড়িয়ে মজা করলাম। কামানে গোলা না থাকলেও আমরা গোলা ছোড়ার অভিনয় করলাম। লোহার পোষাকের ভিতরে হাত মুখ সব চালান করে দেয়ার পর শরীরজুড়ে ভিন্নমাত্রার রোমাঞ্চ খেলে গেলো! এক হাজার বছর আগে সৈনিকেরা এভাবেই দাঁড়িয়ে গোলা ছুড়তো!!
আমরা সবাই লোহার পোশাকে ঢুকে পোজ দিলাম। লায়ন ফজলে করিম ভাই নিজে ঢোকার আগে ডালিয়া ভাবীকে লোহার পিঞ্জরে ঢুকিয়ে ছবি তুললেন। শাসা এবং ফ্রাঞ্চি আমাদের উচ্ছ্বাস দেখে বেশ মজা পাচ্ছিলো। তবে তারা লোহার পোষাকে ঢুকে ছবি তোলার আগ্রহ দেখালো না। আমার মনে হলো, জ্যাক কোম্পানির সদর দপ্তরে আসা অতিথিদের প্রায়শঃ তারা এখানে বেড়াতে নিয়ে আসে। বছরে দু’চার বার করে দেখতে দেখতে তাদের উচ্ছ্বাসে ভাটার টান শুরু হয়েছে। সুতরাং উচ্ছ্বাসের জোয়ার–ভাটা একই তালে থাকা কঠিন।
দেয়ালের উপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে আমরা টের পেলাম যে, ঘামে গরমে টি–শার্টের ভিতরটা পুরোপুরি ভিজে গেছে। তবে একইসাথে টের পেলাম যে, আমাদের অন্তরজুড়ে বৈচিত্র খেলা করছে। দারুণ একটি ঐতিহাসিক স্থাপনায় চক্কর মারার যেই আনন্দ তা আমাদের ভিতরে ফল্গুধারার সৃষ্টি করেছে।
শত সহস্র পর্যটকদের আগ্রহ দেখে আমার মনে হচ্ছিলো, এক হাজার বছর আগেকার দেয়ালটি এখনো অক্ষয় হয়ে রয়েছে। রয়েছে মানুষের মমতা ও ভালোবাসায়। সম্রাটের দিন শেষ, স্থানীয়দের মধ্যে যুদ্ধের দামামাও এখন আর বাজে না। তবুও সাউথ গ্রেট ওয়ালকে অনন্য এক যত্নে আগলে রাখা হয়েছে। বহু বছর ধরে এটি চীনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ট্যুরিস্ট স্পট। প্রতি বছর হাজার হাজার দেশি–বিদেশী পর্যটক দেয়ালটি পরিদর্শন করে। দেয়ালের ক্ষয়ে যাওয়া অংশগুলো সরকার যত্নের সাথে ঠিকঠাক করে রাখে, নিয়মিত চলে সংস্কার কার্যক্রমও। সাউথ গ্রেট ওয়ালের নাম ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় নেই। তবে শত শত পর্যটকের আগ্রহ এবং উচ্ছ্বাস দেখে আমার মনে হলো, ইউনেস্কোর তালিকায় ঠাঁই না পাওয়া দেয়ালটি মানুষের অন্তরে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছে। ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং স্থাপত্যের এক অনন্য মিশ্রণে সাউথ গ্রেট ওয়াল সত্যিই বিস্ময়কর এক স্থাপনায় পরিণত হয়েছে।
অনেকক্ষণ ধরে হাঁটলাম। কখনো উপরে উঠলাম, কখনো ঢালু বেয়ে নিচে নামলাম। পাহাড়ের উপর নির্মিত আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে আমরা দেয়ালের শেষদিকে এসে পৌঁছে গেলাম। দেয়ালের শেষদিকের পাহাড়ের উপর থেকে নিচেই চোখ পড়তেই পরানটি নেচে উঠলো। অনন্য সুন্দর এক নদী কুল কুল করে বয়ে যাচ্ছে। নদীর টলটলে পানি আমাদের যেনো হাতছানি দিচ্ছিলো। ঘামে গরমে কাহিল হয়ে উঠা আমাদের ইচ্ছে করছিল নদীতে গিয়ে ডুবসাঁতার কাটতে। কিন্তু পাহাড়ের শীর্ষ থেকে নদীটি এতো নিচে যে সেখানে ইচ্ছে করলেও যাওয়ার উপায় নেই। নদীতে কয়েকটি জলযান ভাসছে। নদীর দু’পাড়ে প্রচুর গাছগাছালি। ছবির মতো সুন্দর নদীটিকে অনন্য লাগছিলো। শাসা জানালো যে, এই নদীপথেও শত্রুরা হামলা করতো। তাই নদীর দিক থেকে যাতে কোন শত্রুর জলযান কূলে ভিড়তে না পারে সেজন্য গ্রেট ওয়ালের এই ওয়াচ টাওয়ার থেকে তদারক করা হতো। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।