নগরের হিলভিউ আবাসিক এলাকার একটি রাস্তায় ২০২৩ সালে সড়কবাতি দিয়ে আলোকায়ন করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। একইসড়কে এলইডি বাতি স্থাপনে গত বছরের জুলাই মাসে আবারও ঠিকাদার নিয়োগ করে চসিক। গত বছর নিয়োগকৃত ঠিকাদারের কাজ সমাপ্ত হয়েছে উল্লেখ করে সম্প্রতি বিল তৈরির জন্য ‘গোপনে’ নথি উপস্থাপন করেন এক সহকারী প্রকৌশলী। কিন্তু এরি মধ্যে অভিযোগ ওঠে, পূর্বে বাতি স্থাপনে যে তার লাগানো হয় তা নষ্ট হয়নি। একই তার ব্যবহার করে নতুন করে আবারও বাতি স্থাপন করা হয়। অথচ নতুন তার–এর জন্য বিল ধরা হয় প্রাক্কলনে। একইভাবে নতুন করে স্থাপিত বাতিগুলো ‘নিম্নমান’–এর। এছাড়া নতুন করে বাতি স্থাপন করার অন্যান্য খাতেও বেশকিছু ‘অনিয়ম’ হয়েছে। এসব অনিয়ম তদন্তে চসিকের প্রধান প্রকৌশলীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এছাড়া আটকে দেয়া হয় বিলের জন্য উপস্থাপিত ফাইলটি।
এলইডি বাতি স্থাপন করতে গিয়ে সংঘটিত অনিয়মে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনা হয়েছে চসিকের বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী কামাল হোসেন সেলিম এর বিরুদ্ধে। গত ২৫ জানুয়ারি চসিকের দুই বাতি পরিদর্শক মোহাম্মদ মহসিন ও বাসু বিশ্বাস এ বিষয়ে সংস্থার প্রধান নির্বাহী বরাবর লিখিত অভিযোগও দেন। এরপর ২৭ জানুয়ারি অভিযোগ তদন্তে প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবুল কাশেমকে দায়িত্ব দিয়ে অফিস আদেশ জারি করেন চসিক সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন। এতে সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। আগামী রোববার তদন্তের অংশ হিসেবে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। এদিকে কামাল হোসেন সেলিম এর বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ শীতলঝর্ণা আবাসিক এলাকায় বাতি স্থাপনেও অনিয়মের লিখিত অভিযোগ করেন আবাসিক এলাকাটির সভাপতি। এ অভিযোগ যাচাই শেষে ১৩ জানুয়ারি প্রধান নির্বাহী বরাবর একটি একটি প্রতিবেদন দেন চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) মুহাম্মদ শাফকাত বিন আমিন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে’।
শীতলঝর্ণা আবাসিক এলাকার অভিযোগ প্রসঙ্গে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার বিষয়টি আজদীকে নিশ্চিত করেন মুহাম্মদ শাফকাত বিন আমিন। হিলভিউ আবসিক এলাকার অনিয়ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি তদন্তে কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর আসল সত্য জানা যাবে। তবে প্রাথমিকভাবে আমার কাছে মনে হয়েছে এখানে অসংলগ্ন কিছু আছে। তাই বিলের ফাইল আটকে রেখেছি।
এ বিষয়ে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, আমরা তদন্ত করছি। সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে সহকারী প্রকৌশলী কামাল হোসেন সেলিম আজাদীকে বলেন, কাজ যতটুকু হয়েছে ততটুকু বিল দেয়া হবে। এর বেশি দেয়া হলে অনিয়ম হবে। আমাকে তো এখনো বিলই দিইনি, তাহলে অনিয়ম কীভাবে করলাম। আসলে সামনে পদোন্নতির বিষয় আছে। তাই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
তিনি বলেন, এখনো কাজ চলমান। আমি বিল উপস্থাপন করিনি। পুরাতনগুলো স্টোরে জমা দেয়ার পর বিল দেয়া হবে। কাজ চলাকালীন তা সুপারভাইজারদের পর্যবেক্ষণ করার কথা। কোনো ভুল থাকলে তাদের জানানোর কথা। তারা জানায়নি কেন।
শীতলঝর্ণা আবসিক এলাকায় অনিয়ম–এর অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কামাল হোসেন সেলিম বলেন, ডাহা মিথ্যে অভিযোগ আনা হয়েছে। শীতলঝর্র্ণায় আমি কোনো বাতি লাগাইনি। সেখানে কোভিড প্রজেক্ট থেকে লাগানো হয়। কোথায় লাগানো হবে তা গুগল ম্যাপ–এর মাধ্যমে সিলেক্ট করা হয়। গুগল–এর যে রোড তার বাইরে লাগানোর সুযোগ নেই। বিশ্ব ব্যাংক এর প্রতিনিধিরা সেখানে পরিদর্শন করেছেন। সেখানে আমার কোনো হাত নেই।
হিলভিউতে আবাসিকে যে অনিয়ম : চসিকের এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজাদীকে বলেন, কোথাও নতুন করে বাতি স্থাপন করা হলে পুরনো মালামালগুলো স্টোরে জমা দিতে হয়। কিন্ত হিলভিউ অবাসিক এলাকার ক্ষেত্রে তারসহ বিভিন্ন উপকরণ জমা দেয়া হয়নি। এতে স্পষ্ট পুরনো তারগুলো বহাল রেখেই নতুন করে লাগানোর নামে অর্থ আত্মসাৎ করার চেষ্টা হয়েছে।
এদিকে দুই বাতি পরিদর্শকের লিখিত অভিযোগে বলা হয়, চসিকের উন্নয়নমূলক সরবরাহ ও স্থাপন কাজের ঠিকাদারের বিলের উপর যৌথ পরিমাপে বাতি পরিদর্শকগণের স্বাক্ষর গ্রহণের সু–স্পষ্ট অফিস আদেশ রয়েছে। এরপরও বাতি পরিদর্শকগণের স্বাক্ষর না নিয়ে কাজে দুর্নীতির লক্ষ্যে গোপনে ঠিকাদারের বিল পরিশোধের জন্য উপস্থাপন করা হয়। এ জন্য তারা কামাল হোসেন সেলিমকে দায়ি করেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, বাতির শেইড নষ্ট দেখিয়ে নতুন অত্যন্ত নিম্নমানের শেইড স্থাপন করা হয়। সিডিউলে ১০৫টি শেইড লাগানোর কথা থাকলে ও নতুন স্থাপন করা হয় ৯৯টি। নিয়ম থাকার পরও পুরাতন মালামাল ( শেইড) স্টোরে জমা করা হয়নি।
এলইডি বাতি স্থাপনের প্রাক্কলনে ৪৫০০ মিটার ২৫ এম এম তার ধরা আছে। কিন্তু ওই এলাকায় এলাকায় সব রোডে তার পূর্বে লাগানো ছিল। নতুন করে লাগানো হয়নি। একইভাবে প্রাক্কলনে ৬৫০ মিটার ১ দশমিক ৫ আরএম তার স্থাপন ধরা থাকলেও পূর্বের কানেকশনের তার ব্যবহার করা হয়। ১৭০ মিটার ১৬ আরএম তারের মধ্যে মাত্র লাগানো হয় ৬০ মিটার। এছাড়া ১০৫ সেট জি আই পাইপ ব্র্যাকেট এর মধ্যে লাগানো হয় মাত্র ৪২টি। ১০৫টি সাইকেল ইনসুলেটর নাট বোল্ট এর মধ্যে ১৫টি লাগানো হয়। প্রাক্কলনের ০৭ নং থেকে ১০নং আইটেম পর্যন্ত লাগানো হলেও সিডিউল মতে লাগানো হয় নাই। লিখিত অভিযোগে বলা হয়, কামাল হোসেন সেলিম পুরনো মালামাল স্টোরে জমা না করে ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজসে পুরনো মালামাল ব্যবহার করে পার্টনার হয়ে অর্থ আত্মসাৎ করে।
যাচাই প্রতিবেদনে যা আছে : শীতলঝর্ণা আবাসিক এলাকায় অনিয়ম এর অভিযোগের বিষয়ে পরিদর্শন শেষে প্রধান নির্বাহীকে ‘যাচাই প্রতিবেদন’ দেন চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) মুহাম্মদ শাফকাত বিন আমিন। এতে বলা হয়, আবাসিকটির প্রধান সড়কের অর্ধেক অংশে বাতি স্থাপন করা হয়েছে বাকি যে অর্ধেক অংশে বাতি স্থাপন করা হয়নি সে অংশে বেশিরভাগ দোকানপাট ও ঘরবাড়ি রয়েছে। এছাড়া আবাসিকের ৩নং সড়ক দিয়ে প্রতিদিন কয়েকশ গার্মেন্টস শ্রমিকের আসা যাওয়া রয়েছে। কিন্তু ঐ সড়কেও বাতি রয়েছে মাত্র ৪/৫ টি। সড়কের বেশিরভাগ অংশে বাতি স্থাপন করা হয় নি। আবাসিকের ২নং সড়কের প্রধান অংশ ও বাইলেইনসমূহ যথাযথভাবে বাতি স্থাপন করা হয়। অথচ বাইলেইনসমূহে বাতি স্থাপন করা যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আবাসিক এলাকার সভাপতির কাছে থেকে টাকা পয়সা দাবি করে এবং তা না পেয়ে অভিযুক্ত প্রকৌশলী (কামাল হোসেন সেলিম) ২নং রোডের বাড়ির মালিকদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা আদায় করেন। তৎপ্রেক্ষিতে ঐ রোডের আশেপাশে (বাইলেইনসহ) বাতি স্থাপন করেন। ৫০ হাজার টাকারও অধিক টাকা এখানে লেনদেন হয়। যে বা যারা এ কাজে জড়িত তাদেরকে এ বিষয়ে মুখ না খুলতে নির্দেশনা দেন সেলিম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শীতলঝর্ণা আবাসিক এলাকায় সড়ক বাতি স্থাপনের জন্য যে রোড মার্কিং করা ছিল, মূলত সেসব সড়কে বাতি স্থাপন করা হয়নি। নথিতে উল্লেখিত সড়ক বাদ দিয়ে একই এলাকার অন্য সড়ক (কম জনবসতিপূর্ণ এলাকা) আলোকিত করার কোনো অনুমোদনও নথিতে দেখা যায়নি। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। প্রতিবেদেনে বলা হয়, কামাল হোসেন সেলিম এর সহায়তায় ওই এলাকায় সড়ক বাতি স্থাপন করা হয়।