দুঃখ জাগানিয়া ও চিরন্তন ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি

জসিম উদ্দিন খান | রবিবার , ২০ এপ্রিল, ২০২৫ at ১০:১৯ পূর্বাহ্ণ

ভালোবাসা। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুখের নাম। ভালোবাসার ছোঁয়ায় জীবন হয়ে ওঠে সুন্দর, মধুময়, কাব্যময়। তাই ভালোবাসার নেশায় মানুষ নিরন্তর ছুটে চলে মেরু থেকে মেরুতে, সাত সমুদ্রতেরো নদীর ওপারে। দুটি মনের বিশ্বাসের অটল গাঁথুনিতে গড়ে ওঠে ভালোবাসার নিরেট ইমারত। কিন্তু কখনো কখনো কাল বৈশাখির ছোঁ এর মতো অপ্রত্যাশিত কোনো ঝড় এসে ফিকে করে দেয় ভালোবাসার সব রঙ। এলোমেলো করে দেয় জীবনের সব ভাবনা। অবিশ্বাস আর ছলনার ঘুনপোকা যদি বাসা বাঁধে ভালোবাসার স্বপ্নীল কাননে, তখন জীবনের সকল ফাগুন ম্লান হয়ে যায়। ভালোবাসা তখন বিধ্বস্ত ও বিপন্নতায় রূপ নেয়। তবুও জীবন থেমে থাকে না। ভালোবাসা হারায় না। কারো মন যমুনায় একবার ভালোবাসা নোঙর করলেই জেগে থাকে চরের মতো সারাজীবন।

ভালোবাসা কখনো পরম সুখের নাম, কখনোবা মন পোড়া, বেদনা বিধুর এক দহন জ্বালা। কবি জি এম জহির উদ্দীনের ‘বিধ্বস্ত প্রেম বিপন্ন ভালোবাসা’ এমন স্মৃতিমধুর, দুঃখ জাগানিয়া চিরন্তন ভালোবাসারই প্রতিচ্ছবি।”

কাব্যগ্রন্থটি চৌষট্টিটি রোমান্টিক কবিতার অনবদ্য সমাহার। জিএম জহির উদ্দীন একজন স্বভাবজাত কবি। লেখালেখির ক্ষেত্রে তার পদাচরণা বেশ কিছু দিনের হলেও ‘বিধ্বস্ত প্রেম বিপন্ন ভালোবাসা’ তার প্রথম কবিতা গ্রন্থ। প্রথম কবিতাগ্রন্থ হলেও কবিত্ব প্রকাশের তার ভাষা চমৎকার। শব্দের বুননে কবি যথেষ্ট কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। তার কবিতার বইয়ের সবগুলো কবিতা ধরে ধরে আলোচনার টেবিলে তুলে আনা কঠিন ও সময় সাপেক্ষ। আমি কবির অনেক কবিতার মধ্যে কয়েকটি কবিতা নিয়ে আলোচনা করবো।

বিরহী আমি’ নামের কবিতাতে কবি একজন পুরুষের বিরহ বেদনার চিত্রকে নানাভাবে চিত্রিত করেছেন। ‘ও জল গড়িয়ে গেলে হৃদয় প্রশান্ত হয় জানো? আমার অশ্রবিন্দু তার প্রতিচ্ছবি মানো কি না মানো, আমি পুরুষ মানায় কি বলো অশ্রুর ফোঁটা? পুরুষ যখন কাঁদে বিষাদিত হয় পুরো বিশ্বটা।’ এখানে কবি বিরহে পুরুষের কান্নাকে পৃথিবীর কান্নার সাথে ভাগ করে নিয়েছেন। প্রেয়সী সেই কান্নার ভাগ নিতে চাননি, কষ্টের অনুভবে। কবিতার ছত্রে ছত্রে এভাবে বিরহী ভাবনাকে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন শব্দের চমৎকার নির্মাণে।

চোরাবালি’ নামের কবিতায় শুরুতেই কবি বলছেন, ‘পলিগুলো জমে কবে জোয়ারেভাটায়? চেয়ে দেখ প্রতিক্ষণ কলকল স্রোত বহে যায়, যে থাকার, সে থাকে, শত বাধা সহে, যে যাবার সে যায় নীরবে বহে।’ একটি জোয়ার ভাটায় কবি জীবনের গল্পকেই চিত্রিত করেছেন। এ যেন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনেরই চিত্র। কবিরা এমনিই। কবিরা জীবন চলার পথে খুব সুক্ষ্‌ণ অথচ অর্থবহ কী চমৎকার কাব্যের ভুবনে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যান নদীর স্রোতের মত।

বিপন্ন ভালোবাসা’ নামের কবিতায় কবি রোমান্টিকতায় নিজেকে একজন অন্তরীণ বন্দির মতই ভেবেছেন। প্রেয়সীকে না পাবার কারণে কবি তার সমস্ত পাওয়াকে বিবর্ণ মলিন তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের মানুষ হিসাবে নিজেকে বন্দি ও অন্তরীণ মানুষ হিসাবে কল্পনা করেছেন। কবি ব্যর্থ প্রেমিক হয়ে কল্পনা করেছেন প্রেমের বলয় হতে মনকে সরানো যায় না।

বিমূর্ত প্রেম’ কবিতায় কবি প্রেমে হৃদয় রাঙিয়ে জীবনের প্রতিদান দিতে এক ধরনের আকুতিই জানিয়েছেন। সংকীর্ণতা সমসাময়িকতা, জাগতিক বাস্তবতা হৃদয়ে স্থান পেলে কী করতে হবে তার প্রশ্ন রেখে কবি প্রেমিককে সমৃদ্ধ হবার গল্প রচনা করে দিয়েছেন কবিতায়। কবিতার একটি অংশে কবি বলছেন ‘ভয়হীন শংকাহীন চিত্তে ও প্রেম না বিলালে আর কবে প্রেমিক হবে এ পৃথিবীতেজীবন ফুরালে?’ এমন সাহসী প্রশ্নের উচ্চারণ দেখা যায় কবির কবিতায়। কবি প্রেমিককে সাহসী হতে বলছেন নানা উপমায়। ‘যদি ঘৃণাও দাও তবুও ভালোবাসবো তোমাকে ভালোবাসা নয় কারো প্ররোচিত অন্তরের আকুতি’ – ‘আমি ভালোবাসি’ শিরোনামের কবিতায় কবি দৃঢ়চিত্তে সহজ সরলভাবে ভালোবাসার কথা উচ্চারণ করেছেন। কবিতার ভাষায় ফুটে উঠেছে প্রেমের চিরন্তন শাশ্বত রূপ। কবি তার নানা কবিতায় প্রেমকে মিলন বিরহের নানা অবগাহনে তুলে এনেছেন নিজস্ব স্বকীয়তায়।

নির্বাসিতা’ শিরোনামের কবিতায় কবি বিরহ বেদনায় বলেছেন ‘যে মন দেবে বলে সাজিয়ে রেখেছো, যে রূপ করেছো গোপন, তা আজ নির্বাসিত সময়ের কারাবাসে, তুমি আর হলে না আপন।’

তুমি তোমার আধুনিক প্রেম নিয়েই সুখে থাকো আমি সুখী এই বলে, এ মন কলুষিত নয়।’ ‘অক্ষত বিজয়’ কবিতায় কবি নিজেকে চেনাচ্ছেন এইভাবে যে তিনি নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার। আধুনিকতার নামে প্রেমকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন।

তোমার চিন্তা’ কবিতায় কবি প্রেয়সীকে কল্পনা করেছেন এই ভাবে, ‘তুমি বন্ধ চোখে ভাবনার জানালাগুলো খোলো, তুমি বৈশাখের রৌদ্র প্রখরতায় ঘূর্ণিবায়ু তোলো, তুমি বরষার অথই জলে সাঁতরে দাও পাড়ি, তুমি শরতের শিউলির গন্ধে যাও যদি হারি, কে তোমার চঞ্চল মনে বাঁধন পরাবে বলো? তুমি প্রস্তুত হও আগে, মনের আগল তোলো।’ কী সুন্দর অনুভূতির প্রকাশ। যা কবির কল্পনাকে একজন প্রেমিকের মনের সাথে যেন একাকার করে তোলে।

দেবদাসপার্বতী, নির্বাক প্রেম, তেপান্ন বছর পর, সিকন্তি যৌবন, যৌবন, ১৪৩১ সাল, রুদ্ধ জীবন নামের বেশ কিছু কবিতায় কবি তার প্রেম ও রোমান্টিকতাকে সাজিয়েছেন অপরূপ শব্দমালার বৈচিত্রে। একজন রোমান্টিক কবি হিসাবে জিএম জহির উদ্দীন তাঁর বইতে নানা কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন তা বলাই যায়। শৈলী থেকে প্রকাশিত দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে বিধ্বস্ত প্রেম বিপন্ন ভালোবাসা কাব্যগ্রন্থটির মূল্য রাখা হয়েছে তিনশত পঞ্চাশ টাকা। আমি গ্রন্থটির বহুল পঠন ও প্রচার কামনা করছি।

লেখক: কবি ও গীতিকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ