দারিদ্র্য বিমোচনে গ্রামীণ অর্থায়নকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দারিদ্র্য বিমোচনের অনেক উপাদানের মধ্যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। দারিদ্র্য বিমোচনে গ্রামীণ অর্থায়নের প্রভাব শুধু তখনই অনুভূত হয় যখন সহায়ক নীতিগুলো কার্যকর হয়, বাজারগুলো কাজ করে এবং অনানুষ্ঠানিক পরিষেবাগুলো উপলব্ধ থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ অর্থায়ন অপরিহার্য। গ্রামীণ জনগণকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের করে আনতে এবং দেশে টেকসই উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়নে গ্রামীণ অঞ্চলে অর্থের ব্যবহার অধিক হারে বাড়াতে হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার দরিদ্র নারী, পুরুষ, কৃষক এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সঙ্গে তাদের আয়–উৎপাদনমূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গ্রামীণ অর্থায়ন অপরিহার্য।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশেষ একটি সমাবেশ। সেখানে জড়ো হয়েছিল লক্ষাধিক মানুষ। এর উদ্যোক্তা জোসেফ রেসিনস্কির মৃত্যুর পর ১৯৯২ সালে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৭ অক্টোবরকে দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে মনোনীত করে। ১৭ অক্টোবরের স্মারক ফলক–যা ফাদার জোসেফ ১৯৮৭ সালে ট্রোকাডেরো প্লাজায় উন্মোচন করেছিলেন–তা আজ বিশ্বব্যাপী মানবতার প্রতীক হিসাবে স্বীকৃত। সেই ফলকে বলা হয়েছে, ‘যেখানেই নারী–পুরুষের চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে, সেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়।’ নানা নকম সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দুর্ভিক্ষ–মঙ্গা–ক্ষুধার যন্ত্রণা ভুলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। খাদ্যাভ্যাসের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এখন সবাই ফলমূল ও প্রচুর শাকসবজি ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ায় পুষ্টিহীনতা কমেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভুক্ত করা হয়। স্বাধীনতার আগে ও পরে এ দেশে ৮৮ শতাংশ লোক ছিলেন দরিদ্র, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা ছিল। ১৯৭২ সালে ৭ কোটি লোকের মধ্যে ৫ কোটি ছিলেন দরিদ্র। ১৯৯১ সালে দরিদ্রের হার ছিল ৪৪.২ শতাংশ, ২০০৫ সালে ৪৩ শতাংশ, ২০১০ সালে ১৮.৫ শতাংশ, ২০১৬ সালে ১৪.৩ শতাংশ, ২০১৮ সালে ২০ শতাংশ, ২০২২ সালে ১৭.৭ শতাংশ এবং অতি–দরিদ্র ছিল ৫.৬ শতাংশ। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে বিসিএস জরিপে দরিদ্রের সংখ্যা ৫ কোটি ১৭ লাখ। বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিং দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশে সাফল্যের প্রশংসা করে বলেছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য বিমোচনের সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের সম্পদ লুট করে সফল হতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের দারিদ্র্য ২০২৩ সালে ৩৭.৯ শতাংশ, ২০২২ সালে ৩৯.২ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৩০ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলে ৫৫ শতাংশ, পাঞ্জাবে ৩২ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলেছে, পাকিস্তানের দারিদ্র্য ৪.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫.৮ শতাংশ হয়েছে।
অন্যদিকে কয়েক মাস আগে জাতিসংঘের চরম দারিদ্র্য এবং মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত অলিভিয়ে ডি শ্যুটার দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ যে অগ্রগতি করেছে সেটিকে ‘ভঙ্গুর‘ বলে মন্তব্য করেছেন। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নীত হবার পর মজুরি বৃদ্ধি এবং সামাজিক খাতে বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে মি. শ্যুটার বলেন, বাংলাদেশের উচিত মজুরি বাড়ানো যেন বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সুবিধা পেতে দেশটির জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের মধ্যে রাখতে না হয়। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর সামপ্রতিক একটি জরিপে দারিদ্র্য কমে আসার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সামপ্রতিক বছরগুলোয় চরম দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসা অনেক মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার সামান্য উপরে উঠেছে। এর ফলে হঠাৎ কোন বিপদ এলে সেটা মোকাবিলা করার মতো অবস্থা তাদের নেই। অনেক পরিবার, দারিদ্র্যসীমার ঠিক উপরে উঠে এলেও তাদের টিকে থাকার সামর্থ্য নেই। তাদের অর্থ সঞ্চয় করা বা পুঁজি জমানোর সক্ষমতা নেই। ধাক্কা সামলানোর মতো কোন সম্পদ তাদের নেই। মি. শ্যুটার মনে করেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উঠে আসার ধাক্কা সামলাতে বাংলাদেশের উন্নয়নের মডেল পরিবর্তন করা উচিত। রপ্তানি বাড়ানোর চাইতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোর দিকেই বেশি নির্ভর করা উচিত এই উন্নয়ন মডেলের। যেটি কিনা চীন করেছে ১৫–২০ বছর আগে, যখন তারা স্থানীয়ভাবে মজুরি বাড়াতে শুরু করে। তখন তারা সামাজিক সুরক্ষার পেছনে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসার পর বাংলাদেশও এটি করতে পারে এবং করা উচিত। সবচেয়ে বড় কথা, শারীরিক সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দারিদ্র্যমুক্ত জীবন অর্জনের চেষ্টা করা উচিত।