দায়িত্ব পালনকালে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা দেনা পরিশোধ করেছি

চসিকের প্রাক বাজেট আলোচনায় মেয়র শহরকে সাজাতে চাই, বন্দর ও কাস্টমস থেকে ‘সিটি ডেভেলপমেন্ট চার্জ’ আদায় করতে পারলে অর্থের সংকট হবে না

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ১৬ মে, ২০২৪ at ৬:৩১ পূর্বাহ্ণ

নানা সীমাবদ্ধতা ও সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও নাগরিক সেবা নিশ্চিত করে শহরকে সুন্দরভাবে সাজানোর চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস থেকে ‘সিটি ডেভেলপমেন্ট চার্জ’ আদায় করতে পারলে শহরকে এগিয়ে নিতে অর্থের সংকট হবে না বলে মনে করেন তিনি। একইসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন জটিলতা এড়িয়ে আয়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণ করতে পারলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে (চসিক) অর্থের জন্য কারো দিকে তাকাতে হবে না বলেও মন্তব্য করেন মেয়র। দায়িত্ব পালনকালে কৃচ্ছ্রতাসাধন করে চসিকের সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা দেনা পরিশোধ করেছেন বলেও জানান মেয়র। গতকাল বুধবার সকালে টাইগারপাসস্থ চসিকের অস্থায়ী কার্যালয়ে সংস্থাটির প্রাক বাজেট (২০২৪২৫ অর্থবছর) আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। চসিক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে সভায় চসিকের আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে নাগরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়কে প্রাধান্য দেয়ার সুপারিশ করে বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক প্রফেসর ড. জ্যোতি প্রকাশ দত্ত, আইসিএবি চেয়ারম্যান মো. মনিরুজ্জামান, আইসিএবি সাধারণ সম্পাদক নাজনীন সুলতানা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সালেহ জহুর, চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ওমর হাজ্জাজ, নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার ও মোহাম্মদ এরাদত উল্লাহ।

রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, মেয়রের অনেক ক্ষমতা, কিন্তু হাত পাবাঁধা। বিষয়টি এমন, তুমি সাঁতার কাট কিন্তু তোমার হাত পা বেঁধে দিয়েছি। আয়বর্ধক প্রকল্প নিতে গেলেও মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগে। আমি মন্ত্রণালয়ের সভায়ও বলেছি, আয়বর্ধক প্রকল্প আমাদের উপর ছেড়ে দিন, কর্পোরেশনের আর বাইরের টাকা লাগবে না।

মেয়র বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বছরে আমাদের ৪০ কোটি টাকা দেয়া হয়, তাও হোল্ডিং ট্যাঙ। অথচ এই বন্দরের টাকা বিভিন্ন খাতে ব্যয় হয়। আর চট্টগ্রামের দুরবস্থা। অর্থের জন্য আমাদের তীর্থের কাকের মত চেয়ে থাকতে হয়।

তিনি বলেন, আমি নৌপরিবহন মন্ত্রীকে বলেছি, বন্দরের আয় থেকে ১ শতাংশ দেয়ার বিষয়টি আইনগত বাধার জন্য হচ্ছে না। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে আনলোড করা প্রতিটি কন্টেনার থেকে সিটি ডেভেলপমেন্ট চার্জ দিতে হবে। যত ট্রাকলরি বন্দর থেকে বের হবে সেখানে টোল আদায় করতে হবে এবং সিটি কর্পোরেশনকে দিতে হবে। এতে সিটি কর্পোরেশন বছরে ১৫০২০০ কোটি পাবে। কাস্টমসে বিল অব এন্ট্রিতে বিভিন্ন চার্জ আদায় করা হয়, সেখানে কর্পোরেশনের জন্য যদি সিটি ডেভেলপমেন্ট চার্জ যুক্ত করা হয় কর্পোরেশনের আয় বাড়বে। সিটি কর্পোরেশন এমনিতেই এগিয়ে যাবে।

মেয়র বলেন, আমাদের করা রাস্তার ধারণক্ষমতা হচ্ছে ১০১২ টন ওজনের গাড়ি চলা। সে রাস্তা দিয়ে বন্দর ও বিভিন্ন শিল্প কারখানার ৩০, ৪০, ৬০ টনের গাড়ি চলছে। আমরা রাস্তা এ বছর করলাম, পরের বছর দেখা যায় তা কর্ণফুলী নদীর ঢেউয়ের মত হয়ে গেছে। গাড়ি চলতে পারে না। তিনি বলেন, ভারতে টাটাবিড়লার মত শিল্পগোষ্ঠী রাস্তা করে দিয়েছে। কারণ তাদের গাড়ির জন্য রাস্তা নষ্ট হয়। আমাদের বড় বড় শিল্প কারখানার মালিকদের বলেছি, আপনারা করে দিতে পারেন না? এসব বিষয়ে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।

তিনি বলেন, প্রায় ১১শ’ কোটি টাকা দেনা নিয়ে আমি দায়িত্ব নিয়েছিলাম। প্রকল্প ছাড়া কোনো অর্থ সরকার থেকে আমাদের দেয়া হয় না। আমরা রাজস্ব থেকে ব্যয় নির্বাহী করি। এরপরও কৃচ্ছ্রতাসাধন করে ও অপচয় কমিয়ে এনে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা দেনা শোধ করেছি।

তিনি বলেন, ফুটপাত দখলমুক্ত করতে আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছি, এ বিষয়ে আমরা অত্যন্ত কঠোর। কিন্তু হকার উচ্ছেদ করার ১৫ দিন বা এক মাসের মধ্যে আবার বসে যায়। আমাদের নিজস্ব ফোর্স নেই। তারপরও খবর পেলে ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে হকারদের তুলে দিই। হকাররা আবার বসে। এক্ষত্রে যেখানে হকার বসে সেটা কোনো না কোনা থানার আওতাধীন এলাকা। তাই সিএমপিকে বলেছি, ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যারা তাদের মনিটরিংয়ে নির্দেশ দেয়। অন্তত থানার মোবাইল টিম ঘোরাঘুরি করলে এবং মনিটরিং করলে হকাররা আর বসতে পারে না। কিন্তু তা ঠিকমত করে না। যার ফলে হকাররা আবার বসে যায়। তিনি বলেন, ফুটপাত করেছি নাগরিকদের হাঁটার জন্য, এখানে কোনো ব্যবসা হবে না। আমি হলিডে মার্কেট করার চেষ্টা করছি।

মেয়র বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিপ্রকৃতির লীলভূমি চট্টগ্রাম। কিন্তু চট্টগ্রামের মানুষের নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা নেই। একটা পার্ক নেই আমাদের। সবাই আমাদের লজ্জা দেয়। প্রধানমন্ত্রী পার্কের জায়গা বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন। এসময় মেয়র নগরের প্রতিটি ওয়ার্ডে শিশুদের খেলার মাঠ করার চেষ্টা করছেন উল্লেখ করে বলেন, চান্দগাঁও, বাকলিয়াসহ কয়েক জায়গায় করে দিয়েছি। সামান্য জায়গা পেলেও ব্যবস্থা করব। ইন্টারন্যাশনাল মাল্টিপারপাস কনভেনশন হল ও ওশান অ্যামিউজমেন্ট পার্ক করারও চিন্তা আছে। সিটি কর্পোরেশন জেনারেল হাসপাতালতে ডেডিকেটেড শিশু হাসপাতাল করার পরিকল্পনা আছে। অনেক কিছু করার ইচ্ছে আছে। আয়বর্ধক কিছু করতে গেলে পারমিশন নিতে নিতেই সময় চলে যাচ্ছে। তারপরও আমরা সীমিত সামর্থ্যে চেষ্টা করছি।

. জ্যোতি প্রকাশ দত্ত স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামে সরকারি হাসপাতাল না হওয়াকে চট্টগ্রামবাসীর জন্য দুভার্গ্য অবহিত করে চসিকের স্বাস্থ্যসেবা খাতের উন্নয়নের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, এত মন্ত্রী, বড় বড় নেতা, বড় বড় মুক্তিযোদ্ধারা আছেন এরপরও একটা সরকারি হাসপাতাল হয়নি। এ দুঃখের কথা আমি সবসময় বলি।

তিনি চসিকের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির জন্য পরামর্শ দিয়ে বলেন, বিভিন্ন সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে হোল্ডিং ট্যাঙ প্রদান করেছে তা নিশ্চিত করতে হবে। সন্তান যদি স্কুলকলেজে ভর্তি হয় এবং যদি শহরে বাবার ফ্ল্যাট থাকে হোল্ডিং ট্যাঙ সার্টিফিকেট জমা দিতে হবে। এ ধরনের বাইন্ডিং করতে হবে। তিনি বলেন, মেয়র সাহেব হঠাৎ একদিন কোনো বাসায় ভিজিট করে বলতে পারেন, আমি চা খেতে এসেছি। আপনার হোল্ডিং ট্যাঙ সার্টিফিকেট দেখান। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, হোল্ডিং ট্যাঙ কীভাবে আদায় করা যায় এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা উচিত। যাতে কর্পোরেশনকে সরকারের মুখাপেক্ষী হতে না হয়।

প্রফেসর ড. সালেহ জহুর বলেন সিটি কর্পোরেশনকে মধ্যবর্তী বাজেট এর ফ্রেম ওয়ার্ক করার প্রস্তাব দেন। তিনি সিটি কর্পোরেশনের অব্যবহৃত খালি জায়গায় উন্নয়ন করে আয় বৃদ্ধির প্রস্তাব দেন।

মো. মনিরুজ্জামান সরকারের সাথে লিয়াঁেজা করে উন্নয়ন বাজেট বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দেন।

প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, সিটি কর্পোরেশনের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় বাজেট থেকে বরাদ্দ আনা যায় কীনা সে ব্যাপারে চেষ্টার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, শহরে যেসব ট্রাক লরি প্রবেশ করে তা কর্পোরেশনকে ট্যাঙ দেয়া ছাড়া ঢুকতে পারবে না। ওমর হাজ্জাজ আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় ফুটপাতে হকার থাকায় বিদেশিদের সামনে লজ্জা পেতে হয় বলে মন্তব্য করে বলেন, আগ্রাবাদ এলাকায় মনে হয় তারাই বাড়িওয়ালা।

মোহাম্মদ এরাদত উল্লাহ করদাতা সনাক্তে জোর দিতে কর্পোরেশনকে পরামর্শ দেন।

সভায় উপস্থিত ছিলেন চসিক সচিব মো. আশরাফুল আমিন, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির, প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা লতিফুল হক কাজমী, প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম ও প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. ইমাম হোসেন রানা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধউত্তেজনা ভুলে সামনে তাকাতে চান লু
পরবর্তী নিবন্ধনৌপথে পণ্য পরিবহনে ধস