হার্টের রিং বা স্টেন্টের এর উচ্চ দাম নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে ভুক্তভোগীদের হৈ চৈ এর মধ্যে দাম যখন কমানো হল, তখন আমদানিকারকদের বড় একটি অংশ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে; এতে সুফল পাচ্ছেন না রোগীরা। একই সঙ্গে হৃদরোগের চিকিৎসায় যেসব রোগীর হার্টে রিং বা করোনারি স্টেন্ট পরানো বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে তাদের এখন কয়েকটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের বাইরে যাওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে কিংবা আগের দামেই অন্য ব্র্যান্ডের রিং বা স্টেন্ট কিনতে হচ্ছে। খবর বিডিনিউজের।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে সরকারিভাবে দাম কমিয়ে নতুন দর নির্ধারণের সিদ্ধান্ত কার্যকরের পর দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও এ জটিলতার সুরাহা হয়নি; কবে হবে তা নিয়েও কেউ কিছু বলতে পারছে না। চিকিৎসা সেবায় এমন জরুরি একটি পণ্য সরবরাহ নিয়ে আমদানিকারকরা নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল হয়ে রয়েছেন। এ বিষয়ে দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ‘আলোচনার দরজা খোলা থাকার’ কথা বললেও আমদানিকারকদের পণ্য সরবরাহে ফেরাতে ব্যবস্থা নেয়নি।
ধমনীতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক ক্রিয়া সচল রাখতে এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে রিং বা করোনারি স্টেন্ট পরানো হয়। দীর্ঘদিন থেকে হাসপাতালগুলোতে এসব রিং এর দাম বেশি নেওয়া হচ্ছিল বলে অভিযোগের মধ্যে সবশেষ দফায় গত ডিসেম্বরে প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে নতুন দর নির্ধারণ করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, যা ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়। এর আগে অক্টোবরে দুটি কোম্পানির স্টেন্টের দাম কমিয়ে নতুন দর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। বেঁধে দেওয়া নতুন দর কার্যকরের দিন ১৬ ডিসেম্বর থেকেই ইউরোপিয়ানসহ আরও কিছু দেশের ব্র্যান্ডের স্টেন্ট আমদানিকারকরা সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। তবে আমেরিকান ব্র্যান্ডের স্টেন্ট আমদানিকারক চার কোম্পানি তাদের সরবরাহ বজায় রেখেছে। এতে রোগীদের বাজেট অনুযায়ী বিকল্প ব্র্যান্ডের রিং বেছে নেওয়ার সুযোগ বন্ধ হওয়ায় জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। তবে সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এখনও কোনও সঙ্কট দেখা না দিলেও রিং পরানো কমে গেছে বা অনেকে সূচি পিছিয়ে দিয়েছেন।
সরকারি হাসপাতালে পরিস্থিতি ঠিক থাকলেও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, সরবরাহ বন্ধ থাকায় রিং পরানো কমেছে। কেননা আমেরিকান ব্র্যান্ডের স্টেন্টের দাম বেশি। সরবরাহ বন্ধ থাকার এ ধারা বেশি দিন চলতে থাকলে বিষয়টি নিয়ে জটিলতা আরও বাড়তে পারে। সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া আমদানিকারকদের দাবি, দর নির্ধারণের ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হয়েছে। এতে লোকসানে পড়তে হবে। এ নিয়ে তারা উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করলেও পরে তা তুলে নিয়েছেন।
মেডিকেল ডিভাইস ইমপোটার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওয়াসিম আহমদ বৈষম্যের বিষয়ে বলেন, আমেরিকান কোম্পানির স্টেন্ট আমদানিকারকদের জন্য ‘মার্ক–আপ’ ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। বাকিদের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। এটিই বৈষম্য তৈরি করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম দাম নির্ধারণের পদ্ধতিটি সবার জন্য যেন এক হয়, বৈষম্য যেন না থাকে। যেহেতু আমাদের দাবিটি মানা হয়নি সেজন্য কোর্টে গিয়েছিলাম। ঔষধ প্রশাসন বলেছিল বিষয়টি তারা দেখবেন। পরে আমরা সবার সঙ্গে কথা বলে রিট আবেদনটি তুলে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত অফিসিয়ালি কিছু জানায়নি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।’
এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) উপপরিচালক ও আইন কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম বলেন, ‘স্টেন্টের দাম কমানো হয়নি। বরং এ নিয়ে দীর্ঘদিন একটা নৈরাজ্য চলছিল। সেখান থেকে একটা শৃঙ্খলায় নিয়ে আসা হয়েছে। স্টেন্টের মূল্য নির্ধারণ নিয়ে ডিজিডিএ আগের অবস্থানেই আছে। তবে আমদানিকারকরা চাইলে নতুন কোনো প্রস্তাব দিতে পারেন।’
হৃদরোগের চিকিৎসার একটি ধাপে করোনারি এনজিওপ্লাস্টি করা হয়। এটি হার্টের চিকিৎসায় একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। হৃদযন্ত্রের ধমনীর ভেতর ‘প্লাক’ জমে তা ব্লক বা বন্ধ হয়ে গেলে ওষুধে কাজ না হল কৃত্রিম উপায়ে স্টেন্ট বা রিং পরিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া ওই ধমনী খুলে দেওয়া হয়। ‘এনজিও’ শব্দের অর্থ রক্তনালি এবং ‘প্লাস্টি’ শব্দের অর্থ খুলে দেওয়া। চর্বি জমে বা অন্য কোনো কারণে হৃদযন্ত্রের রক্তনালি সংকুচিত হয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হতে পারে বা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হতে পারে। ওষুধের মাধ্যমে তা ঠিক না হলে রক্ত চলাচল বাড়াতে ধমনির ভেতরে বিশেষ ধরনের যন্ত্র স্থাপন করা হয়; যা করোনারি স্টেন্ট বা হার্টের রিং নামে পরিচিত।
চিকিৎসকদের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩৫ হাজার স্টেন্ট বসানো হয়। এগুলোর বেশির ভাগ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের। ২৭টি কোম্পানি ৪৪ ব্র্যান্ডের এসব স্টেন্ট সরবরাহ করে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি কোম্পানির তিন ধরনের স্টেন্টের দাম কমায় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। তখন ‘রেজোলিউট ইন্টেগ্রিটি’ ধরনের স্টেন্টের ভিত্তিমূল্য ৮৮০ থেকে কমিয়ে ৫০০ ডলার, রেজোলিউট ওনিক্সের দাম ১১৫০ থেকে কমিয়ে ৯০০ ডলার এবং অনিক্স ট্রকারের দাম নির্ধারণ করা হয় ৪৫০ ডলার। এরপর ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর আরও বিভিন্ন ধরনের স্টেন্টের দাম নির্ধারণ করে দেয়, যা কার্যকর হয় গত ১৬ ডিসেম্বর থেকে। নতুন তালিকায় সর্বনিম্ন ১৪ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত দামের স্টেন্টও রয়েছে। এতে প্রকারভেদে স্টেন্টের দাম সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে আসে।
সবশেষ দফায় দাম কমিয়ে অধিদপ্তরের নতুন মূল্যতালিকা নির্ধারণ করার পর থেকেই জটিলতার শুরু। দাম নির্ধারণে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে আমদানিকারকদের বড় একটি অংশ বিশেষ করে ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের সরবরাহকারীরা স্টেন্ট সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। একাধিক আমদানিকারক বলেন, আমদানি করা করোনারি স্টেন্টের সঙ্গে ভ্যাট, শুল্ক, সিএন্ডএফ এজেন্টের ব্যয়সহ সব ধরনের খরচের সঙ্গে মুনাফা যোগ করে দর ঠিক করে দেওয়া হয়। এর ব্যাখ্যায় তারা বলেন, স্টেন্টের আমদানিমূল্য ১০০ টাকা হলে সেটি ১৪২ টাকায় বিক্রি করতে হবে। দর নির্ধারণের এ পদ্ধতিকে ‘মার্ক–আপ’ বলা হয়।
আমদানিকারকদের অভিযোগ, আমেরিকা থেকে স্টেন্ট আমদানিকারক কোম্পানিগুলোকে ‘মার্ক–আপ’ ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাকিগুলোর ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। এসব কোম্পানিকে ডলারকে টাকায় রূপান্তর করলে যে মূল্য আসে সেই দামে বিক্রি করতে বলা হয়েছে। তাদের আপত্তি তা নিয়েই।
দেশে হৃদরোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা করোনারি স্টেন্ট আসে মূলত যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, আয়ারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, ভারত ও জাপান থেকে। এরমধ্যে প্রায় অর্ধেক আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বাকিগুলো আসে অন্যান্য দেশ থেকে। আমদানিকারক ও সরবরাহকারীরা বলছেন, দেশে সাধারণত ৪৪টি ব্র্যান্ডের স্টেন্ট ব্যবহার করা হয়। এগুলো আমদানি করে ২৭টি কোম্পানি। এরমধ্যে চারটি কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি ব্র্যান্ডের স্টেন্ট আমদানি করে।