চীনের শ্রমিক সংকট এবং বিভিন্ন দেশের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক আরোপের কারণে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে বাংলাদেশের। ফলে নয়াদিল্লি, ইসলামাবাদ ও বেইজিং থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন বিদেশি ক্রেতারা, তাদের গন্তব্য বাংলাদেশ। এশিয়ার তিন দেশসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশ থেকে তৈরি পোশাকের ক্রেতারা আসছেন ঢাকায়, বাড়ছে ক্রয়াদেশ। ইতোমধ্যে এসব পণ্যের রপ্তানি বাজারে ঢুকছেন রপ্তানিকারকরা। সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে রপ্তানি আয়ে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধির। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশে নতুন রপ্তানি আদেশ দিতে ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছেন পোশাকের বিশ্ববাজারের বড় ক্রেতারা। তাদের এই আগ্রহ অব্যাহত থাকলে সেপ্টেম্বর থেকে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ দ্বিগুণ হবে। পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, গত দুই মাসে আগের একই সময়ের তুলনায় পোশাকের ক্রয়াদেশ প্রায় ৩২% বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে মোট রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ২৫% ছিল। শুধু তৈরি পোশাকই নয়, চীন ও ভারত থেকে আগে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হতো এমন বিভিন্ন ধরনের পণ্যের ক্রেতারা এখন বাংলাদেশে আসছেন। উদ্যোক্তারা তাদের প্রতিশ্রুতি ঠিক রাখলে এসব ক্রেতা স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে শিফট হতে পারেন। তবে এজন্য দ্রুত গ্যাস, বিদ্যুৎ–জ্বালানি সংকট ও বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী রপ্তানির সব আদেশ ধরতে পারলে চলতি অর্থবছরেই রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধি ৪০–৪৫% ছাড়িয়ে যাবে। তবে ব্যাংকিং খাতসহ কয়েকটি জায়গায় শিল্প বিনিয়োগ ও উৎপাদন প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার পর বাংলাদেশের ওপর দেশটির আরোপ করা পাল্টা শুল্কের হার শেষ পর্যন্ত ২০% নির্ধারিত হয়েছে। নতুন শুল্কহার ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে। বাণিজ্য বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্কহার কমে প্রতিযোগীদের কাছাকাছি অবস্থানে আসার ঘটনা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব পান গত ২১ জানুয়ারি। এর দুই মাস পর গত ২ এপ্রিল হঠাৎ বিশ্বের ৭০ দেশের জন্য বিভিন্ন হারে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন তিনি। অনেকেই ট্রাম্পের এ ঘোষণাকে একধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ বলে সমালোচনা করেন। প্রথমে ২ এপ্রিল বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা হয় ৩৭% পাল্টা শুল্ক। মাঝখানে তিন মাস স্থগিত রাখার পর ৮ জুলাই তা কমিয়ে ট্রাম্প ৩৫% করেন। বর্তমানে গড়ে ১৫% শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। নতুন পাল্টা শুল্ক ২০% করায় মোট শুল্কহার দাঁড়াবে এখন ৩৫%।
দর–কষাকষির মাধ্যমে ঘোষিত শুল্কহার কমিয়ে আনাকে ঐতিহাসিক আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের আলোচকদের অভিনন্দন জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, এটি সুস্পষ্ট এক কূটনৈতিক সাফল্য।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এই আলোচনায় অনেকগুলো বিষয় জড়িত থাকায় শুল্ক আলোচনার প্রক্রিয়াটি ছিল বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ। শুল্ক ছাড় পাওয়ার বিষয়টি শুধু শুল্ক কমানোর সঙ্গে যুক্ত ছিল না, বরং অশুল্ক বাধা, বাণিজ্যঘাটতি ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত মার্কিন উদ্বেগও ছিল এর সঙ্গে। আর সমাধানের বিষয়টি নির্ভর করছিল যুক্তরাষ্ট্রের সদিচ্ছার ওপর। রপ্তানিকারকেরা বলছেন, বাংলাদেশের ওপর ২০% শুল্ক আরোপ করায় আমরা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় থাকব এবং যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে আমরা ২০% এর নিচে প্রত্যাশা করেছিলাম।
যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারতের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। বাংলাদেশের সমান ২০% ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কা এবং ১৯% হার নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য কম রয়েছে পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের হারও ১৯%। তাইওয়ানের উপর ২০% এবং দক্ষিণ আফ্রিকার উপর ৩০% শুল্কারোপ করা হয়েছে। যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিলের ওপর ১০%। জাপান, ইসরায়েল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং আফগানিস্তানের ওপর ১৫% শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৪১% শুল্কহার সিরিয়ার ওপর। বেশি হার আরোপ হওয়া দেশগুলোর মধ্যে লাওস ও মিয়ানমারের ওপর ৪০%, সুইজারল্যান্ডের উপর ৩৯%, ইরাক ও সার্বিয়ার উপর ৩৫% এবং লিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আলজেরিয়ার উপর ৩০%।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনভেশন পুরোপুরি মেনে চলার অঙ্গীকার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে দেশটি থেকে দাম বেশি দিয়ে হলেও বছরে সাত লাখ টন করে গম কেনা হবে–পাঁচ বছর ধরে। ইতিমধ্যে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি। দেশটি থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আগে থেকেই আমদানি করা হতো। তা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আর যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ কেনার সংখ্যা বাড়িয়ে ২৫ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৯–১১ জুলাই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা সফল না হওয়ার পর থেকেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে থাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য বেশি আমদানি করে, সেসব পণ্যের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে ১৭–২৩ জুলাই সপ্তাহব্যাপী অনলাইনে বৈঠক করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়েই তিনি বৈঠকগুলো করেন।
গত ১৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (প্রকাশ না করার চুক্তি) করার কারণে সরকারি প্রতিনিধিদলে অন্য কাউকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে ভেতরে–ভেতরে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। সরকারের আহ্বানে সফরের এক সপ্তাহ আগে থেকেই ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর প্রতিনিধিদল দফায় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করে। এসব সভায় তাৎক্ষণিকভাবে ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সয়াবিনবীজ ও তুলা আমদানির সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করেন তাঁরা। তারা বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
আসলে বাণিজ্য আলোচনা বা চুক্তি একটি কঠিন বিষয়। এতে প্রচুর হোমওয়ার্ক, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, দেশপ্রেম ও পেশাদারিত্ব প্রদর্শন করতে পারলেই সফলতা অর্জন করা যায়। এবার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য আলোচনায় আমলা, উপদেষ্টা ও ব্যবসায়ী সমাজ যথেষ্ট তথ্যভিত্তিক ফলপ্রসূ আলোচনা করেই বাংলাদেশের শুল্ক কমিয়ে বাণিজ্য চুক্তি করতে সক্ষম হয়েছেন। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। আশা করা যায় ভবিষ্যতেও তাঁরা একই রকমের দক্ষতা প্রদর্শন করে সর্বক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখবেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।