নিরাপদ বাহন হিসেবে যাত্রীদের পছন্দের শীর্ষে রেলওয়ে। অথচ আরামদায়ক এই বাহনে যাত্রীদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পাথর নিক্ষেপ। চলার পথে হঠাৎ করে আতঙ্ক হয়ে ছুটে আসছে পাথর। সশব্দে ভাঙছে জানালার কাচ। আহত হচ্ছেন যাত্রীরা, ঘটছে মৃত্যুও। রেলওয়েও পরিবহন বিভাগ, আরএনবি এবং জিআরপি পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কেবল গত এক বছরেই দেড় শতাধিক পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ।
যাত্রীরা বলছেন, দুর্বৃত্তদের কারণে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে রেলযাত্রা। পাথর নিক্ষেপের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে চট্টগ্রাম ও সিলেট রুটে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা বেশি ঘটছে। এতে পূর্বাঞ্চলীয় রেলপথে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে চলাচলকারী যাত্রীরা, বিশেষ করে রাতে চলতি পথে জানালার পাশে বসতে ভয় পাচ্ছে তারা। তবে সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়গামী শাটল ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
রেল পুলিশ বলছে, রেললাইনের পাশে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বস্তি, দোকানপাট ও নানা স্থাপনার আশপাশ থেকে ছোড়া হয় পাথর। পাথর নিক্ষেপের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে চট্টগ্রাম ও সিলেট রুটে। ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা বন্ধে রেল লাইনের দুইপাশ থেকে অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ ও জনসচেতনতার পাশাপাশি স্থায়ী সমাধানে ট্রেনলাইনকেন্দ্রিক মানুষ চলাচল বন্ধের তাগিদ দিয়েছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। রেলওয়ে সূত্রমতে, পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে ৮০টি এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখান থেকে ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটছে সবচেয়ে বেশি। এরমধ্যে পূর্বাঞ্চলের ৫টি জেলার ২০টি এলাকায় ৩৬টি স্পট খুব ঝুঁকিপূর্ণ, যেখান থেকে প্রায় সময় পাথর ছোড়া হয়।
পূর্বাঞ্চলের যেসব এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ : চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, সীতাকুণ্ড, ভাটিয়ারী, বাড়বকুণ্ড, চিমকি আস্তানা, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, সীতাকুণ্ড, পাহাড়তলী, বটতলী ও কুমিল্লা, ফেনীর ফাজিলপুর, কমলদহ, নরসিংদী, জিনারদী, ঘোড়াশাল, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, নীলফামারীর সৈয়দপুর, আক্কেলপুর, উল্লাপাড়া, যমুনা সেতু, খুলনার ফুলতলা, বেনাপোল ইত্যাদি এলাকায় বিভিন্ন সময়ে চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে ২০টি এলাকার ৩৬টি স্পটে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে বেশি। এদিকে চট্টগ্রামের ২ নম্বর গেট রেলক্রসিং, ষোলশহর, আমিন জুটমিলসহ কয়েকটি এলাকায় ইদানিং সময়ে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় তিনজন ছাত্রছাত্রী মারাত্মক আহত হয়েছে।
জড়িতরা বস্তির শিশু-কিশোর : জিআরপি সূত্রমতে, ট্রেনে পাথর ছোড়ার যেসব ঘটনা ঘটছে তার সঙ্গে জড়িত ৮০ ভাগই শিশু-কিশোর। যারা বিভিন্ন বস্তি এলাকায় বেড়ে উঠেছে। এতে প্রায়ই যাত্রীরা গুরুতর আহত হওয়ার পাশাপাশি ক্ষতি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ট্রেনেরও। বস্তির এসব শিশুদের আটক করা হলেও বেশিরভাগ সময় মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
পাথর ছোড়ার অপরাধে শাস্তি : রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারায় ট্রেনে পাথর ছুড়লে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। পাথর ছোড়ায় যদি কারো মৃত্যু হয়, তাহলে ৩০২ ধারায় দোষির মৃত্যুদণ্ডের বিধানও রয়েছে। তবে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় শিশু ও কিশোররা জড়িত থাকায় তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো হয়। এ আইনে এখন পর্যন্ত কারো শাস্তির নজির নেই বলেই জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এই ব্যাপারে চট্টগ্রাম জেলার রেলওয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী আজাদীকে জানান, চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ বন্ধে আমরা দিনরাত কাজ করছি। যেসব এলাকায় পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে, সেসব এলাকার জনপ্রতিনিধি, বিশিষ্ট ব্যক্তি, শিক্ষকসহ সব শ্রেণির মানুষকে নিয়ে সচেতনতামূলক সভা-সমাবেশ করছি নিয়মিত। এমনকি মসজিদেও এ নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। তবে অতীতের তুলনায় কিছুটা কমলেও পাথর নিক্ষেপের ঘটনা বন্ধ হয়নি। এ জন্য প্রয়োজন সবাইকে সচেতন হওয়া। আমি আজকেও সারাদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রুটের বিভিন্ন এলাকায় প্রচারণা চালিয়েছি। এলাকার জনগণের সঙ্গে কথা বলেছি। এখন আমরা সচেতনতা মূলক কর্মসূচির পাশাপাশি আইনি পদক্ষেপও নেব। নিয়মিত অভিযান চালাব। ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ রোধে এখন জিরো ট্রলারেন্স নীতিতে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু যারা এগুলো করছে, তারা এর ভয়াবহতা বুঝতে পারছে না।