তেল সরবরাহ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হচ্ছে, উদ্বোধন ১৪ আগস্ট

চট্টগ্রাম-ঢাকা পাইপলাইন । কয়েক দফায় পরীক্ষা, সাশ্রয় হবে সময় ও অর্থ

হাসান আকবর | সোমবার , ৪ আগস্ট, ২০২৫ at ৮:০৬ পূর্বাহ্ণ

পরীক্ষামূলকভাবে বেশ কয়েক দফায় জ্বালানি তেল সরবরাহের পর অবশেষে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হচ্ছে। আগামী ১৪ আগস্ট জ্বালানি উপদেষ্টা চট্টগ্রামে এসে গুপ্তাখাল পদ্মা অয়েল কোম্পানির ডিপোতে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহের এই কার্যক্রম দেশের জ্বালানি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার পাশাপাশি তেল চুরি এবং অপচয় ঠেকানোসহ কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় করবে। ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলক তেল সরবরাহকালে জিরো সিস্টেম লস অর্জিত হওয়ার রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) সূত্র জানিয়েছে, দেশের চাহিদার ৭০ লাখ টন জ্বালানির অন্তত ৩০ লাখ টন ব্যবহৃত হয় ঢাকা ও কুমিল্লা অঞ্চলে। এসব জ্বালানির বেশিরভাগ বেসরকারি অয়েল ট্যাংকারের মাধ্যমে নৌপথে পরিবাহিত হয়। এতে কোটি কোটি টাকার তেল চুরিসহ নানা ধরনের অপকর্ম ঘটে। ট্যাংকারে জ্বালানি তেল পরিবহনের ক্ষেত্রে পয়েন্ট ১৭ শতাংশ সিস্টেম লস বিপিসি মেনে নেয়। বছর শেষে এটা বিশাল অংক হয়ে দাঁড়ায়। সিস্টেম লস কিংবা তেল চুরির এই লোকসান থেকে জ্বালানি তেল সেক্টরকে বাঁচাতেই মূলত চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়। ৫০ লাখ টন ধারণক্ষমতার পাইপলাইনে বর্তমানে ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল সরবরাহ দেওয়া হবে।

প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় জ্বালানি তেল সরবরাহের পাইপলাইন নির্মাণের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেন সেনাবাহিনীর প্রকৌশলীরা। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল হয়ে ঢাকার ফতুল্লা পর্যন্ত ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পাইপলাইনে ইতোমধ্যে লক্ষ লক্ষ টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের প্রধান ডিপো থেকে ঢাকা অঞ্চলে তেল সরবরাহকালে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্তভাবে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত হয়। এগুলো পুরোপুরি সুরাহা করা হয়েছে। গতকালও এই পাইপলাইন ব্যবহার করে পদ্মা অয়েল কোম্পানি ৫০ লাখ লিটার ডিজেল গোদনাইল ডিপোতে নিয়েছে।

পাইপলাইন এবং আনুষাঙ্গিক স্থাপনাসহ অবকাঠামো পুরোপুরি প্রস্তুত হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে এর কার্যক্রম শুরুর দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছে। গেল সপ্তাহে বিপিসি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেছে। যোগাযোগ করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। সবকিছু ঠিক করে আগামী ১৪ আগস্ট সকালে পাইপলাইনটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের যোগদান করার কথা রয়েছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের পর থেকে এই পাইপলাইন ব্যবহার করে তিনটি তেল বিপণন কোম্পানি জ্বালানি তেল সরবরাহ করবে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লার বারুড়া হয়ে জ্বালানি তেল যাবে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল এবং ঢাকার ফতুল্লায়। কুমিল্লার বরুড়ায় স্থাপন করা হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ অটোমেটেড ডিপো। সর্বাধুনিক এই ডিপো থেকে চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ সন্নিহিত অঞ্চলের প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হবে; যা এখন নৌপথে চাঁদপুরে পাঠানো হয়ে থাকে। এই ডিপোতে জ্বালানি তেল গ্রহণ এবং সরবরাহ সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হবে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে। তেলের ওজন, তাপমাত্রা, সরবরাহ সবই পরিচালিত হবে কম্পিউটারাইজড প্রযুক্তিতে। ম্যানুয়ালি কোনো কাজ হবে না। চট্টগ্রামের ডেসপ্যাচ টার্মিনালের স্ক্যাডা মাস্টার কন্ট্রোল স্টেশন থেকেই পুরো পাইপলাইনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করা হবে। স্ক্যাডা, টেলিকমিউনিকেশন এবং লিক ডিটেকশন করতে এই পাইপলাইনের সাথে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল লাইন সংযুক্ত রয়েছে। ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের ২৪১ কিলোমিটার অংশে ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ বসানো হয়েছে, যা পতেঙ্গা থেকে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। পাশাপাশি গোদনাইল থেকে ফতুল্লা ডিপো পর্যন্ত ৮.২৯ কিলোমিটার পৃথক ১০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। বিপিসির একজন কর্মকর্তা জানান, ভূগর্ভস্থ এই পাইপলাইন ২২টি নদী ও খালের নিচ নিয়ে এসেছে এবং পুরো রুটে মোট ৯টি পাম্পিং স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে।

অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে পরিচালনার ফলে সিস্টেম লস শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে পদ্মা অয়েল কোম্পানি কয়েক দফায় জিরো সিস্টেম লসে জ্বালানি তেল চট্টগ্রাম থেকে গোদনাইলে নিয়ে গেছে। অর্থাৎ চট্টগ্রাম থেকে যে পরিমাণ তেল পাইপলাইনে পাম্প করা হয়েছে ঠিক সেই পরিমাণ তেল গোদনাইলে রিসিভ করেছে।

পূর্বে তেলবাহী ট্যাংকারে চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত তেল পরিবহনে অন্তত ২৪ ঘণ্টা সময় লাগত। কিন্তু নতুন পাইপলাইনের মাধ্যমে মাত্র ৪ ঘণ্টায় তেল পৌঁছানো যাবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত তেল পরিবহনে বিপিসির বার্ষিক খরচ হয় প্রায় ৩২৬ কোটি টাকা। পাইপলাইনে খরচ হবে মাত্র ৯০ কোটি টাকা। ফলে বছরে অন্তত ২২৬ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এছাড়া সিস্টেম লস এবং চুরি ঠেকানোর মাধ্যমেও কোটি কোটি টাকা রক্ষা পাবে।

খারাপ আবহাওয়ার কারণে নৌপথে ট্যাংকারে তেল পরিবহন বিঘ্নিত হতো, ঝুঁকির সৃষ্টি করত। এই পাইপলাইন সেই সমস্যার সমাধান করে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে বিপিসির কর্মকর্তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচবির এক শিক্ষক ও ৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী সাময়িক বরখাস্ত
পরবর্তী নিবন্ধএক ব্যক্তিকে লাখ টাকা জরিমানা, স্থাপনা উচ্ছেদ