দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র জ্বালানি তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি (ইআরএল) ৫৭ বছরের ইতিহাস ভঙ্গ করে উৎপাদনক্ষমতার চেয়ে বেশি জ্বালানি তেল পরিশোধন করেছে। গত মধ্যরাত পর্যন্ত অর্থবছরের শেষ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি ১৫ লাখ ২৫ হাজার টনের মতো জ্বালানি তেল পরিশোধন করে। অথচ ১৯৬৮ সাল থেকে চলে আসা প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদনক্ষমতা হচ্ছে বছরে ১৫ লাখ টন। বিভিন্ন বছরে প্রতিষ্ঠানটি ১২ থেকে ১৫ লাখ টনের ধারে কাছে উৎপাদন চালালেও এবার অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বলে জানিয়েছেন ইআরএল–এর কর্মকর্তারা। তারা বলেন, প্রতিষ্ঠার ৫৭ বছর পরও এমন তাক লাগানো সফলতা প্রশংসার দাবিদার। বিষয়টি উদযাপন করে কর্মকর্তা কর্মচারীদের ধন্যবাদ জানানোর জন্য আজ ইআরএল পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান চট্টগ্রামে আসছেন।
সূত্র জানিয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের জ্বালানি তেলের চাহিদা মেটানোর জন্য তৎকালীন সরকার ১৯৬৩ সালে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। বিদেশ থেকে ক্রুড অয়েল আমদানি করে এখানে পরিশোধন করে বাজারজাত করার জন্যই মূলতঃ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। ১৯৬৬ সালে ফরাসি কোম্পানি টেকনিপ, ইএনএসএ এবং সিওএফআরআই কনসোর্টিয়ামের সাথে সরকার ইআরএল প্রতিষ্ঠার চুক্তি করে। কর্ণফুলী নদীর তীরে উত্তর পতেঙ্গা এলাকায় প্রায় ২০২ একর জায়গাজুড়ে গড়ে তোলা হয় ইস্টার্ন রিফাইনারি। প্রকল্পটিতে ওই সময় খরচ হয়েছিল ১৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। ১৯৬৮ সালের ৭ মে ইস্টার্ন রিফাইনারি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানিকৃত ক্রুডঅয়েল এখানে পরিশোধন করে তিনটি তেল বিপণন কোম্পানির মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়।
বিশ্বে দুই ধরনের জ্বালানি তেল বিক্রি হয়ে থাকে। পরিশোধিত এবং অপরিশোধিত। পরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বেশি। অপরিশোধিত ক্রুডঅয়েলের দাম তুলনামূলক কম। ক্রুডঅয়েল দেশে এনে পরিশোধন করে বাজারজাত করলে বেশ সাশ্রয় হয়। এছাড়া দেশের কর্মসংস্থান এবং জ্বালানি নিরাপত্তায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এসব বিষয় মাথায় রেখে বছরে ১৫ লাখ টন ক্রুডঅয়েল পরিশোধনের সক্ষমতা নিয়ে গড়ে তোলা হয় ইস্টার্ন রিফাইনারি।
ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ১৫ লাখ টন ক্রুডঅয়েল পরিশোধন করে ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন, জেটফুয়েল, বিটুমিন, এলপিজিসহ বিভিন্ন পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে উৎপাদন সক্ষমতার ধারে কাছে পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছিল। মাঝে উৎপাদনের পরিমান কমে যাওয়ায় আশির দশকে এবং দুই হাজার সালের দিকে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে বড় ধরণের বিএমআরআই করা হয়। এরপর উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে। শুরুতে যে উৎপাদন ক্ষমতা ছিল তার ধারে কাছে উৎপাদন চলে প্রতিবছর।
কিন্তু গতরাতে শেষ হওয়া অর্থবছরে তাক লাগিয়ে দিয়েছে ইস্টার্ন রিফাইনারি। ৫৭ বছরের ইতিহাস ভেঙে সর্বোচ্চ পরিমান জ্বালানি তেল উৎপাদন করে বলে জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, উৎপাদনক্ষমতার চেয়ে বেশি পণ্য উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে ইআরএল। এই অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটিতে ১৫ লাখ ২৫ হাজার টনের বেশি পণ্য উৎপাদিত হয়েছে।
বিষয়টিকে ইস্টার্ন রিফাইনারির একটি ‘ঐতিহাসিক মাইলফলক স্পর্শ’ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীরা। তারা বেশ উচ্ছ্বসিত। উচ্ছ্বসিত সরকার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিপিসিও। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পণ্য উৎপাদন এবং পদ্মা অয়েল কোম্পানি, যমুনা অয়েল কোম্পানি এবং মেঘনা পেট্রোলিয়ামের মাধ্যমে তা বাজারজাতকরণ দেশের জ্বালানি খাতের জন্য একটি অনন্য অর্জন বলেও মন্তব্য করেছেন কর্মকর্তারা।
তারা বলেন, ৫৭ বছরের পুরানো একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এখনো একেবারে নতুনের মতো রেজাল্ট পাওয়া বেশ খুশির একটি ব্যাপার। এটি ধরে রাখা সম্ভব হলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাসহ সার্বিক ক্ষেত্রে বেশ ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিষয়টি সেলিব্রেশন করতে ইস্টার্ন রিফাইনারি পরিচালনা পর্যদের চেয়ারম্যান, সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ নাসিমুল গনি এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান আজ সকালে ইস্টার্ন রিফাইনারি পরিদর্শন করবেন। তারা কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে বৈঠক ও মতবিনিময় করে উৎপাদনের এই ধারা সামনের দিনগুলোতেও ধরে রাখার দিকনির্দেশনা প্রদান করবেন বলেও সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে জানান।