পর্ব- ৫
পরের অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে নিলাম ঝড়ের বেগে। এর মাঝেই রক ফেসটা থেকে আরও দু-তিনটা ছোটখাটো এভালাঞ্চ হয়েছে। সেগুলোর গতিপথ অবশ্য আমাদের ক্যাম্প এরিয়া থেকে দূরে। তবে যতবারই ওইরকম শব্দ শুনি, ততবারই আমাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বেশ খানিকক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে তানভীর ভাই হঠাৎ দাঁড়ানো থেকে বসে পড়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বাবর, কী দেখলাম রে ওটা! কী দেখলাম ওটা! গতিপথ আরেকটু এদিকে হলেই একজনও তো বাঁচতাম না আমরা। একজনও না।’ বুঝলাম ব্যাপারটা থেকে এখনো বের হতে পারেন নাই ভাই। তাকে তাগাদা দিয়ে মিনিট বিশেকের মধ্যেই আমরা প্রস্তুত হয়ে গেলাম। লাকপা এসে আমাকে বলল, সবাইকে রোপ আপ (একই দড়িতে সংযুক্ত) করে লিড দিয়ে নিয়ে যেতে। আমি ওকে ক্যাম্প ওয়ানে আসার সময় দেখা দুটো ক্রেভাসের অবস্থানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই ও জানাল, ‘ও মুঝে ক্যায়া পাতা হ্যায়! ও তো স্নো কে অন্দর ঘুস গ্যায়া (ওগুলো কোথায় আমি জানি না। সব তো তুষারের নিচে ঢাকা পড়ে গেছে)। আমার ইতস্তত দশা আঁচ করে করণ বলল, ‘ঠিক আছে, আমি লিড দিচ্ছি। তুমি সবার পেছনে থাকো।‘
সবাইকে রোপ আপ করে প্রাণান্তকর সেই চলা শুরু হলো। এই দড়িটাই জীবনের সাথে যেন আমাদের বাঁধন। এর থেকে চ্যুত হলে অপেক্ষা করছে কঠিন দুর্যোগ। শক্ত বরফের উপর হালকা তুষারের আস্তরণের উপর যে পথে সহজেই এসেছিলাম, সেটাই এখন কখনো হাঁটু সমান কখনো কোমর সমান তুষারের কারণে দুর্ভেদ্য। তুষারের জন্য পা চালানোই বড্ড মুশকিল। কিন্তু সে অনুযোগ জানানোর সময় কই? এই মৃত্যুপুরী থেকে যত তাড়াতাড়ি বেরোতে পারি, ততই মঙ্গল। একজনের গতির সাথে অন্যজনের গতি না মেলায় মাঝে মাঝেই বেশ কষ্ট হচ্ছিল। পেছনের জন হয়তো খানিক জিরিয়ে নিচ্ছে, সামনের জন খুব তাড়াতাড়ি এগোনোতে পেছনের জনের দড়িতে টান খেয়ে যাচ্ছে। তানভীর ভাই সবাইকে চিৎকার করে ক্ষণে ক্ষণে দ্রুত চলার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। অন্যদের তুলনায় মনির ভাই আর আইয়ুব দলের গতির সাথে টাল সামলাতে গিয়ে কিছুটা পিছিয়ে পড়ছিল। মনির ভাই একবার রোপ থেকে বেরিয়ে নিজের গতিতে চলার জন্য বলেওছিল। কিন্তু ক্রেভাসের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত না থাকায় সেটা আমরা করতে দেইনি। কোথায় চলছি সেটা বোঝাও দুষ্কর। সামনে অপেক্ষা করছে হিমালয়ের কুহেলিকাময় পথ। পেছনে তাকালে কিচ্ছু দেখা যায় না। সব সাদায় লুপ্ত। পা দুইখানা নিঃশব্দে পীড়ন সহ্য করে যাচ্ছে। শূন্য দৃষ্টি আর অবসন্ন মনে চলছি বেস ক্যাম্পের নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে।
পথ দুর্গম, কিন্তু অগম্য নয়। বেস ক্যাম্পের যত কাছে আসছি, কাঁধের উপর তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলা আতঙ্ককে প্রতি মুহূর্তে একটু একটু করে দূরে ফেলে আসছি। এক নম্বর ক্যাম্পে যাত্রার সময় এই পথের সৌন্দর্য দুই চোখে গিলতে গিলতে গিয়েছি। এবারও দেখছি, কিন্তু সন্তর্পণে। নিসর্গ শোভার চেয়ে সাবধান থাকাটা প্রাধান্য পাচ্ছে। এমন দেখায় চোখের ভেতরে মনটা থাকে না। কেউ একটু থেমে গেলেই আমরা নানান উদ্দীপনার বাণী শুনিয়ে তাকে আবার চলতে শুরু করিয়ে দিচ্ছি। বেস ক্যাম্পের দিকে যত এগোচ্ছি, ততই আবহাওয়া খানিকটা পরিষ্কার হয়ে আসছে। কিন্তু পথের দূরত্ব কোন দয়া দেখাচ্ছে না। মাঝে করণ একবার একটু থামার জন্য বলল। ওই এভালাঞ্চের কারণে সকালে কারও পেটে কিছু পড়েনি। এমনকি বরফ গলিয়ে পানিটা পর্যন্ত করা হয়নি। আগের রাতের বেঁচে যাওয়া অল্প একটু পানিই সম্বল। আর কয়েকটা চকলেট বার। বিশ্রামের ফাঁকেই পেছনে মাঝারি আকৃতির দুটো এভালাঞ্চ চাক্ষুষ করলাম। সেটাই সম্ভবত বিরামের সময়টুকুকে কমিয়ে দিতে সবার মনের মধ্যে ঘন্টা হিসেবে বাজল।
বাকি পথটুকু আবারও হাঁটু অবধি তুষার মাড়িয়ে চলা। বেস ক্যাম্পের কাছাকাছি যে গ্লেসিয়ারটায় দিন কয়েক আগে আইস ক্রাফট প্র্যাকটিস করেছিলাম, সেখানে আসতেই মনির ভাই নিজেকে রোপ থেকে সরিয়ে নিলেন। খালি পেটে সবার গতির সাথে তাল মেলাতে কষ্ট হচ্ছিল ওনার। অবশ্য এইখানে আর বিপদের আশঙ্কা নেই। দূরে বেস ক্যাম্পের তাঁবু দেখা যাচ্ছে। আরো কিছুদূর সামনে এগোলে বেস ক্যাম্পে আমাদের পানির উৎস নালাটার দেখাও পাওয়া যাবে। সেটা মনে হতেই তৃষ্ণাটা আরেকবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। টানা পা চালিয়ে নালার কাছে এসে মাথায় হাত। কোনো তরলের অস্তিত্বই নাই নালায়। পুরোটা তুষারে ঢাকা। থুথু দিয়ে জিহবাটা আরেকবার চাটা ছাড়া উপায় কই! এবার পাখির চোখ করেছি বেস ক্যাম্পকে। ওখানে অপেক্ষমাণ বন্ধুর কাছে নিশ্চয়ই বরফ গলানো পানি থাকবে। আরও খানিক বাদেই বেস ক্যাম্পে। ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে দেখলাম দুই ঘন্টাতেই এক নম্বর ক্যাম্প থেকে বেস ক্যাম্পে চলে এসেছি। অথচ যেদিন বেস ক্যাম্প থেকে ক্যাম্প এক-এ গিয়েছিলাম, সেদিন সময় লেগেছিল পাক্কা পাঁচ ঘন্টা। মাত্রই ফেলে আসা পথটার দিকে একবার পেছন ফিরে তাকালাম। এই ফেলা আসা পথের মূল্য এই মুহূর্তে শূন্য। কিন্তু গত ক’দিনের এই অভিজ্ঞতাকে পরিমাপ করার কোনো এককের কথা আমার অজানা। সারা জীবন অমূল্য সম্পদ হয়েই থাকবে। এই ক’দিনে বেস ক্যাম্প হঠাৎ বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়া প্রেমিকার ন্যায় অচেনা হয়ে গেছে। কয়েক দিন আগে অল্প কিছু স্নো প্যাচ ক্যাম্পের এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিল। এখন পুরোটা নরম তুষারের রাজ্য। কোথায় সেই বড় বোল্ডার আর মোরেইন! পুজোর বেদিটাও ঘন তুষারের নিচে। লম্বা সূচালো পাথরের শীর্ষভাগটাই দেখা যাচ্ছে শুধু।
খানিক জিরিয়ে ধাতস্থ হতেই পাহাড়ের অন্তরাল থেকে গত কিছুদিনে প্রথমবারের মতো সূর্যের আত্মপ্রকাশ ঘটল। সোনালি রেণু ছড়ানো রোদে দূরের এক নম্বর ক্যাম্পটা আবছামতো দৃশ্যমান হলো কিছুক্ষণ বাদেই। দিনের বাকি সময়টা ওদিক পানে চেয়ে চেয়েই কাটালাম। মৃদু হলদে আলোটা রক ওয়ালের কঠিন শরীর থেকে পিছলে পড়ছে নিচের উপত্যকায়। রোদে বরফ গলার কারণেই সম্ভবত চারপাশের ৩০-৪০ ডিগ্রি ঢালগুলো থেকে অনবরত ছোট আর মাঝারি সাইজের এভালাঞ্চ হচ্ছে। এভালাঞ্চগুলোর উৎসস্থল এক নম্বর ক্যাম্পের আশেপাশেই। আজকের দিনটা ওখানে কাটাতে হলে কে জানে হয়তো অনন্তকাল ওখানের তুষারেই মুখ থুবড়ে পড়ে কাটাতে হতো! বিকেলছোঁয়া নিভন্ত দুপুরে দুই কাপ চা নিয়ে এসে তানভীর ভাই এক কাপ আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। তার চায়ের কাপ নিয়ে আমার চায়ের কাপে মৃদু টোকা দিয়ে বললেন, ‘চিয়ার্স! টু নিউ লাইফ!’