ভারত মহাসাগরে সোমালিয়া দস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর খাবার দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। দস্যুরা জাহাজের খাবার লুটেপুটে খাচ্ছে, বেপরোয়াভাবে নষ্ট করছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সপ্তাহখানেকের মধ্যে জাহাজের খাবার ও পানি ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে জাহাজটি তীর থেকে মাত্র দেড় মাইল দূরে অবস্থান করছে।
দস্যুরা নাবিকদের জাহাজের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে দিলেও ফোনে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনীর হাতে একটি জাহাজসহ ৩৫ জন সতীর্থকে খোয়ানোর পর এমভি আবদুল্লাহকে কবজায় রাখা দস্যুরা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছে।
জানা যায়, সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়া এমভি আবদুল্লাহ সাগরে আগের অবস্থানে রয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনীসহ আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর অভিযান পরিচালনার চেষ্টা এবং ইতোপূর্বে ছিনতাই করে রাখা এমভি রুয়েন হাতছাড়া হওয়ার পর জলদস্যুরা বেপরোয়া আচরণ করছে। এমভি রুয়েনের সাথে ৩৫ জন জলদস্যু আটক হয়েছে। যারা বাণিজ্যিক জাহাজ ছিনতাইয়ের পাশাপাশি ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজেও হামলা করেছে–এমন অপরাধের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। প্রায় আড়াই হাজার নটিক্যাল মাইল সাগর পাড়ি দিয়ে সোমালিয়া দস্যুদের আইএনএস কোলকাতার মাধ্যমে ভারতে নিয়ে আসা হচ্ছে। দস্যুদের ছিনতাই করা একটি জাহাজের দখল হাতছাড়া এবং অস্ত্রশস্ত্রসহ ৩৫ জন সতীর্থ ধরা পড়ার ঘটনায় মর্মাহত এমভি আবদুল্লাহর দখল নেওয়া জলদস্যুরা। তারা নাবিকদের সাথে দৃশ্যমান খারাপ আচরণ না করলেও ফোন করতে দিচ্ছে না। প্রচুর খাবার রান্না করা হচ্ছে প্রতিদিন। তারা যা খাচ্ছে তার চেয়ে বেশি নষ্ট করছে। জাহাজের খাবার ফুরিয়ে গেলে তারা বাইরে থেকে খাবার আনাবে। সেই খাবার নাবিকদের দেবে নাকি রেশনিং করাবে, তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। একাধিক নাবিক বিষয়টি তাদের পরিবারের সাথে শেয়ার করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। খাবার বেশিদিন চলার জন্য জাহাজের নাবিকরাও রাতের খাবার বাদ দিয়েছেন। এখন মূলত ইফতার আর সেহেরি তৈরি হচ্ছে। একাধিক তরকারির আয়োজন পরিহার করে শুধু একটি তরকারি তৈরি হচ্ছে।
এদিকে গত রাতে নাবিকদের উদ্ধৃতি দিয়ে চট্টগ্রামে অবস্থানকারী ক্যাপ্টেন আতিক খান জানান, আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী এমভি আবদুল্লাহ ছিনতাই করা জলদস্যুদের চাপের মুখে রেখেছে। যুদ্ধজাহাজগুলো আবদুল্লাহর দেড় মাইলের মধ্যে চলে এলে জলদস্যুরা জাহাজের নোঙর তুলে আরো ভিতরে চলে গিয়ে তীরের মাত্র ১.৫ মাইল দূরে নোঙর করেছে। ইতোমধ্যে দস্যুরা হুমকি দিয়েছে, বাড়াবাড়ি করলে জাহাজ তীরে তুলে দেবে। তবে নৌবাহিনী এখনো বিভিন্নভাবে তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। এই চাপ হয়তো জলদস্যুদের দ্রুত মুক্তিপণ দাবিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
ভারতীয় নৌবাহিনীর অভিযানের প্রস্তুতির মুখে দস্যুরা সব নাবিককে এখন দিন–রাত ২৪ ঘণ্টা ব্রিজে জড়ো করে রাখছে। তারা ভিএইচএফ (ওয়াকিটকি) ব্যবহার করে নৌবাহিনীকে কাছে না আসার জন্য হুঁশিয়ারি দিচ্ছে।
তবে দস্যুরা নাবিকদের জাহাজের সাধারণ রুটিন মেনে কাজকর্ম পরিচালনায় বাধা দিচ্ছে না। জাহাজটির ইঞ্জিনিয়াররা ইঞ্জিন রুমে স্বাভাবিক কাজকর্ম করছেন। ইঞ্জিনরুমে দস্যুদের কোনো পাহারা নেই বলেও নাবিকদের উদ্ধৃতি দিয়ে সূত্র জানিয়েছে। জাহাজের ডেক অফিসাররা কার্গো হোল্ডের ৫৫ হাজার টন কয়লার তাপমাত্রা ঠিক রাখতে কাজ করছেন। কয়লার তাপমাত্রা ও হোল্ডের অক্সিজেন নিয়ন্ত্রণে রাখার স্বাভাবিক কার্যক্রমে দস্যুরা বাধা দিচ্ছে না। হ্যাজের তাপমাত্রা এবং অক্সিজেন নিয়ন্ত্রণ না করলে কয়লায় বিস্ফোরণ ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে গতকালও দস্যুদের পক্ষ থেকে মুক্তিপণের ব্যাপারে ফোন করা হয়নি। দস্যুরা এভাবে চুপচাপ কেন অপেক্ষা করছে তা বোঝা যাচ্ছে না বলে গতকাল জাহাজটির মালিকপক্ষ জানিয়েছেন। জাহাজটিতে অভিযানের প্রস্তুতির খবর প্রচার হলেও বাংলাদেশ সরকার না করায় তাতে ভারতীয় নৌবাহিনীসহ আন্তর্জাতিক বাহিনী অগ্রসর হয়নি।
জাহাজের পাহারায় ৪০ সশস্ত্র জলদস্যু : আনোয়ারা প্রতিনিধি জানান, এমভি আবদুল্লাহতে জিম্মি নাবিকদের মধ্যে তিনজনের বাড়ি আনোয়ারায়। বৈরাগ ইউনিয়নের উত্তর বন্দরের বাসিন্দা গাজু মিয়ার পুত্র সাজ্জাদ হোসেন (৩০), মধ্য বন্দরের মৃত আয়ুব আলীর পুত্র শামসু উদ্দীন শিমুল (৩৫) ও বদল পুরা গ্রামের বদলপুরা গ্রামের আক্তার উদ্দীনের পুত্র আসিফুর রহমান (২৪) জিম্মি আছেন।
এক নাবিকের আত্মীয় বদরুল হক জানান, বন্দি এক নাবিক শুক্রবার রাত ১২টার দিকে এবং শনিবার দুপুর ২টায় এবং সর্বশেষ সোমবার রাত ৯টায় ফোন করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। ক্ষতির আশঙ্কা থেকে তিনি ওই নাবিকের নাম প্রকাশে রাজি হননি। ফোনে ওই নাবিক বলেন, জলদস্যুরা নাবিকদের পানি ও খাবার সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। শুক্রবার রাত থেকে সশস্ত্র ২০ জলদস্যু তাদের পাহারায় ছিল। শনিবার দুপুর থেকে আরো বিশজন সশস্ত্র জলদস্যু যোগ দিয়েছে। বর্তমানে ৪০ জন জলদস্যু পাহারা দিচ্ছে।
কোথায় আছে জাহাজটি : বিবিসি বাংলা জানায়, পরিবারের সাথে যোগাযোগ না থাকলেও জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণের থাকা জাহাজটির সর্বশেষ অবস্থান মনিটর করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নৌপরিবহন অধিদপ্তরের পাশাপাশি বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনও (বিএমএমওএ) জাহাজটির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। দস্যুরা জাহাজটিকে নিয়ে কয়েক দফায় ভারত মহাসাগরে স্থান পরিবর্তন করে।
জাহাজটির এই গতিপথ ও অবস্থান দেখে বিএমএমওএ বলছে, জাহাজটি জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর প্রথমে তারা বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজটিকে দেড় দিনের মাথায় সোমালিয়া উপকূলের কাছাকাছি নিয়ে যায়। জলদস্যুদের কবলে পড়ার পরদিন বুধবার এটি ছিল সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু উপকূলের কাছাকাছি অবস্থানে। পরে সেটিকে আরো উত্তর দিকে সরিয়ে প্রথমে নেওয়া হয় গারদাকে। এরপর ভারতীয় নৌবাহিনী জাহাজটি ঘিরে নজরদারি বাড়ালে সেটি আবারো সরিয়ে নেওয়া হয় গদবজিরান উপকূলে। গত তিনদিন ধরে জাহাজটি একই জায়গায় নোঙর করে আছে বলে জানিয়েছে বিএমএমওএ। তারা জানাচ্ছে, জাহাজটি গদবজিরান শহর থেকে ৪ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছে।
বিএমএমওএর সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, এমভি আব্দুল্লাহ যে জায়গায় ছিল গত তিন দিন ধরে সেখানেই আছে। আমরা আশা করছি এখান থেকেই তারা মালিকপক্ষের সাথে দেনদরবার শুরু করবে।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পরিবার : আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে আরব আমিরাত যাওয়ার পথে ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরের সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ। জিম্মি হওয়ার দুদিন পর্যন্ত জাহাজটির অবস্থানসহ বিভিন্ন তথ্য পরিবারের কাছে জানানোর সুযোগ পেয়েছিল জিম্মি নাবিকরা। কিন্তু গত দুদিন ধরে সে যোগাযোগ বন্ধ।
এ জাহাজে থাকা তিনজন জিম্মির পরিবারের সাথে কথা হয়। গত দুদিনে কারোর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি তাদের। সর্বশেষ শনিবার চিফ অফিসার ক্যাপ্টেন আতিকুল্লাহ খানের সাথে তার পরিবারের কথা হয়।
ক্যাপ্টেন আতিকুল্লাহ খানের মা শাহানুর বেগম বলেন, আমাদের সাথে শেষ যখন কথা হয়েছে তখন আমার ছেলে বলেছে ওরা গায়ে হাত না দিলেও অনেক দুর্ব্যবহার করা শুরু করেছে। বিশেষ করে ভারতীয় নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার টহল দেখার পর থেকে জলদস্যুদের আচরণে পরির্বতন হয়েছে।
সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার তৌফিকুল ইসলামের শ্যালক সিব্বির মাহমুদ বলেন, গত শনিবারের পর থেকে আমাদের সাথে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। এ নিয়ে পুরো পরিবার দুশ্চিন্তায় আছি।
জিম্মি ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খানের বড় ভাই ওমর ফারুক বলেন, তার ভাই যখন তাকে দুদিন আগে ফোন দিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন জিম্মি আব্দুল্লাহর নাবিকদের সবচেয়ে বড় ভয় খাদ্য ও পানি সংকট। কারণ সোমালি জলদস্যুরা খাবার শুধু খাচ্ছে না, তারা প্রতিবেলায় খাবার নিয়ে সেগুলো নষ্ট করছে। প্রতিবেলায় গড়ে একশজনের খাবার নষ্ট হচ্ছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে শিগগিরই জাহাজে খাদ্য ও পানি সংকট দেখা দেবে।