তিস্তা : বিকল্প পথে বাংলাদেশ

শঙ্কর প্রসাদ দে | সোমবার , ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৯:১৪ পূর্বাহ্ণ

১৯৯৮ সালে দ্বিতীয় ভূ-স্বর্গ সিকিম বেড়াতে গিয়ে দেখেছি রাজ্যটির অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তিস্তার উৎপত্তি ৭২০০ ফুট উচ্চতার চিতামু লেক থেকে। নদীটি কিয়দংশ দেখে ভেবেছি এই পাহাড়ি নদীটির সাথে আমাদের রংপুর বিভাগের কোটী মানুষের জীবন জীবিকা এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে দোদুল্যমান। সিকিম এবং পশ্চিম বঙ্গের একাধিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এই সংকটের মূল কারণ। তিস্তার উপর সিকিম একাধিক বাঁধ দিয়ে তৈরি করেছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। ঐ প্রকল্পগুলোতে ব্যবহৃত পানি ঠিকই ভাটিতে আসে। সংকট সৃষ্টি হয়েছে পশ্চিম বঙ্গ সীমানায়। এখানে একাধিক বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে সেচের জন্য। বাঁধকে ঘিরে জলাধারগুলোর পানি সরবরাহ করা হয় কৃষি জমিতে। মমতা ব্যানার্জীর আপত্তি ঠিক এই বিন্দুতে তাঁর বক্তব্য, যে পরিমাণ জল জলাধারগুলোতে জমে তা দিয়ে পশ্চিম বঙ্গের চাষই পরিপূর্ণভাবে সম্ভব হয় না। তার উপর প্রায় ত্রিশ শতাংশের মতো পানি বাংলাদেশকে দেয়া হয়।
তিস্তার ন্যায্য হিস্যার দাবি এই শতাংশকে ঘিরে। নদীটির দৈর্ঘ্য ৩১৫ কি: মি:। বাংলাদেশ অংশে পড়েছে ১১৫ কি: মি:। যেহেতু সিকিম জল কৃষিতে ব্যবহার করে না সেহেতু বাটোয়ারার বিষয়টি শুধু পশ্চিম বঙ্গ আর বাংলাদেশকে ঘিরে আবর্তিত। এর দৈর্ঘ্য মোটামুটি ২৫০ কি: মি:। এই হিসাবকে ভিত্তি করে ১৯৮৩ সালে পশ্চিম বঙ্গ ৩৯ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ৩৬ শতাংশ হিস্যার ব্যবস্থা হয়। ২০০৭ সাল পর্যন্ত এই হিস্যাটি মোটামুটি চালু ছিল। সংকট দেখা দেয় এরপর থেকে। কারণ ২০০৭ সালের পর থেকে তিস্তাতেই পানি প্রবাহ কমে আসতে থাকে। যে ২৫ শতাংশ রিজার্ভ রাখা হয়েছিল তা সহ বন্টনের প্রস্তাব উঠে যৌথ নদী কমিশনে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবীটি যৌক্তিক মনে হয়। সরকারিভাবে যদিও ঘোষণা করা হয়নি তবু অসমর্থিত সূত্র অনুযায়ী দিল্লী ঢাকা ৫৩:৪৭ শতাংশে একটি ঐকমত্যে পৌঁছে এবং এই চুক্তি সম্পাদনের জন্য মনমোহন সিংহ মমতাকে নিয়ে ২০১১ সালে ঢাকায় আসার দিনক্ষণ ঠিক করে এগিয়েছিলেন। ঢাকায় উড়াল দেবে আগে মমতা সাফ জানিয়ে দেন, প্রস্তাবিত এই হিস্যা তিনি গ্রহণ করতে অপারগ। মাত্র ৫৩ শতাংশ জল দিয়ে পশ্চিম বঙ্গের বিদ্যমান সেচ প্রকল্পগুলো চালানো সম্ভব নয়। ভেস্তে যায় দীর্ঘ প্রতিক্ষিত একটি সংকট সমাধানের সুবর্ণ সুযোগ। ২০১৪ সালের শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ অংশে পানির প্রবাহ বলতে গেলে ২০ শতাংশেরও নীচে নেমে আসে। রংপুর বিভাগ বিশেষত; নীলফামারী জেলা মারাত্মক পানি সংকটে নিপতিত হয়। গত কয়েক বছরে পানি এভাবে কমে যাওয়ার মূল কারণ বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গজলডোবা বাঁধে পানির পরিমান কমে যাওয়া। গজলডোবায় পানি কমে যাওয়ার মূল কারণ এর উজানে পশ্চিম বঙ্গের সেচ প্রকল্পগুলো। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ যদি তিস্তার উপর নির্ভরশীল সেচ প্রকল্পের সংখ্যা কমিয়ে না আনে তবে এ সংকটের আশু সমাধান সুদূর পরাহত। তিস্তার উপর নির্ভরশীল না থেকে সেচ প্রকল্পগুলো জলাধার নির্ভর প্রকল্পে রূপান্তর করা কঠিন কোন বিষয় নয়। বর্ষার জল অনেকগুলো জলাধারে সংরক্ষণ করলে সংকটের আশু সমাধান সম্ভব। মমতা সেদিকে যাচ্ছেন না। তিনি গোঁ ধরে আছেন বর্তমান কাঠামোকে ভিত্তি করে সেচ প্রকল্পগুলো চালু রাখা চাই। এটি সময় উপযোগী কোন নীতি হলো না। অথচ তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী, পশ্চিম বঙ্গে কি হলো বা কি হবে না তার উপর বাংলাদেশের ভাগ্যকে ছেড়ে দেয়া যায় না। পশ্চিমবঙ্গের পানি সংকট হতেই পারে। সে সংকট সমাধানে তাদের বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক মানচিত্রে ৫২ নং নদী হিসেবে চিহ্নিত তিস্তা একটি প্রাচীন নদী। এটির তিনটি স্রোতধারা বাংলাদেশ অংশে এসে পদ্মায় নিপতিত হতো। করতোয়া, পূর্ণভবা ও আত্রাই, এই তিনটি স্রোতধারার নদী বলে বিবর্তিত হয়ে তিস্তা নামের উৎপত্তি। ১৭৮৭ সালের প্রলয়ংকারী বন্যায় নদীটির গতিপথ বহুলাংশে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে মিলিত হয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদে। ব্রহ্মপুত্রের আগ পর্যন্ত নদীর স্রোতধারার উপর গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের কোটী মানুষের জনবসতি। পানি ভবিষ্যতে কমুক বা বাড়ুক, সংকট বাংলাদেশের জন্য বর্ষা মওসুমেও কম নয়। প্রবল মৌসুমী বর্ষণে সিকিম এবং পশ্চিম বঙ্গের, বর্ষা এলে বাঁধগুলোর পানি ছেড়ে দেয়া বাধ্যতামূলক। তখন রংপুর বিভাগে দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা। এ সমস্যারও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান জরুরি।
বিদ্যমান বাস্তবতায় বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞরা ভিন্ন পথে হাঁটার পরামর্শ দিচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিকল্প প্রস্তাব লুফে নিয়েছেন। সরকারিভাবে ইতোমধ্যে চীনের সাথে আলোচনা হয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশ অংশে এমন একটি জলাধার নির্মাণ করা হবে যার ধারণ ক্ষমতা হবে ন্যূনতম ২০০০ কিউসেক। এমনিতে তিস্তার মোট পানি প্রবাহের পরিমাণ সর্বোচ্চ ২৪৩০ কিউসেক। সমস্যার দিক একটিই, সেটি হলো বিনিয়োগতব্য অর্থের পরিমাণ। মোটামুটি ২০,০০০ কোটী টাকার এ প্রকল্পের ব্যয়ভার বহন এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে চীন রাজী হয়েছে। বলে রাখা ভাল, এই বিশাল জলাধারের সাথে চীনের সরাসরি কোন অর্থনৈতিক লাভ তথা কৃষি বা বিদ্যুৎ বা অন্য কোন প্রকল্প সুবিধার প্রশ্ন নেই। বিষয়টা এমন যে, চীনের কাছে বিনিয়োগ করার মতো প্রচুর টাকা আছে, প্রযুক্তিও আছে। চীন গোটা পৃথিবীতে এরকম বৃহৎ প্রকল্প হন্য হয়ে খুঁজছে। বাংলাদেশের প্রস্তাব এজন্য চীনের কাছে প্রাথমিকভাবে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। ২০১৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে যখন বললেন তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে যুগের পর যুগ দর কষাকষি না করে নিজেরাই জলাধার নির্মাণ করে সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা উচিত।
জাতীয়ভাবে বিষয়টি এখন গুরুত্বের সাথে আলোচিত হচ্ছে। নদী ও পানি বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাবটিকে স্বাগত জানিয়েছেন। এখন শুধু সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। ঘটনাপ্রবাহ যে দিকে গড়াচ্ছে, ধারণা করা যায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রকল্পটিতে কাজ শুরু হবার সুুযোগ আছে। প্রকল্পটির আকার এতই বড় যে, আঞ্চলিক কুটনীতির ক্ষেত্রেও বড় ধরনের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। ভারতের সাথে বর্তমান ঘনিষ্ঠতর সম্পর্কের ব্যত্যয় কতটুকু ঘটবে বলা মুশকিল, তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে চীনের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নীত হবে এক নতুন মাত্রায়। তিস্তার পানি বন্টনের বিকল্প এই উদ্যোগ হয়তো উত্তর বঙ্গের কৃষির মৌলিক চেহারাই পাল্টে দেবে। দেখা যাক প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকার কতটুকু মুন্সীয়ানার পরিচয় দেয়।
লেখক: আইনজীবী কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি
পরবর্তী নিবন্ধঅবন্তীর ‘প্রয়োজন’