তিন কারণে গ্রামেও বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ

চট্টগ্রামে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৩০ শতাংশ রোগী উপজেলার

মোরশেদ তালুকদার | শনিবার , ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৪:০৭ পূর্বাহ্ণ

অতীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি দেখা যেত মহানগরের বাসিন্দাদের মাঝে। বিগত বছরগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্তদের সিংহভাগ ছিল মহানগরের বাসিন্দা। তবে এবার উপজেলা বা গ্রামেও বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। চলতি বছর এ পর্যন্ত চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া রোগীর ৩০ দশমিক ৪৭ শতাংশ বাস করেন গ্রামে। আবার উপেজেলা পর্যায়ে আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী হচ্ছে সীতাকুণ্ড উপজেলার বাসিন্দা। ১৫ উপজেলার মধ্যে ৩৬ শতাংশ রোগীই সীতাকুণ্ডের।

কীটতত্ত্ববিদের সাথে আলাপকালে তারা গ্রামে ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধির জন্য তিনটি কারণকে সন্দেহ করছেন। এগুলো হচ্ছেগ্রামেও এডিস মশা বৃদ্ধি পাওয়া, দ্রুত নগরায়ণ এবং দুর্বল প্রতিরোধ ব্যবস্থা। গ্রামে এবার এডিস মশার বিস্তার যেভাবে হয়েছে ভবিষ্যতে তা আরো বাড়তে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা।

কীটতত্ত্ববিদরা জানান, ২৬ প্রজাতির এডিস মশার মধ্যে ‘এডিস ইজিপ্টাই’ ও ‘এডিস অ্যালবোপিকটাস’ ডেঙ্গু ছড়ায়। অবস্থানগত দিক দিয়ে এডিস ইজিপ্টাই শহরের এবং এডিস অ্যালবোপিকটাস গ্রামের মশা বলে পরিচিত। তবে এবার ‘এডিস ইজিপ্টাই’ বাড়ছে গ্রামেও। সাথে আগে থেকে গ্রামে পাওয়া যাওয়া ডেঙ্গুবাহী অপর মশা ‘এডিস অ্যালবোপিকটাস’ এর ঘনত্ব পূর্বের চেয়ে বেড়েছে। ‘এডিস অ্যালবোপিকটাস’ গাছের কোটরে, কলাগাছের বাকলের মধ্যে বা কচুপাতায় থাকা পানিতে ডিম পারে।

গ্রামে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির দ্বিতীয় কারণ হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে দ্রুত নগরায়নকে। এক্ষেত্রে গ্রামেও নগরায়নের ফলে কংক্রিটের দালানকোঠা বেড়েছে। বৃষ্টি হলে ওসব দালানকোঠায় জমে থাকা পানিতে ডিম ছাড়ছে এডিস মশা। তাছাড়া শহরের মানুষের ব্যবহার্য নানা জিনিসপত্র বিশেষ করে প্লাস্টিকের তৈজসপত্র এখন গ্রামেও ব্যাপক ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া অটোরিকশার টায়ারে জমে থাকা পানিতে ডিম দেয় এডিস মশা। এ টায়ারের ব্যবহারও গ্রামে বহুলাংশে বেড়েছে। সবমিলিয়ে গ্রামেও বাড়ছে ডিম দেয়ার উপযোগী পরিবেশ।

তৃতীয় কারণ হচ্ছে, প্রতিরোধ ব্যবস্থা। গ্রামে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। শহরে এডিস মশার বিস্তার রোধে যেভাবে কার্যক্রম পরিচালিত হয় গ্রামে সেভাবে হচ্ছে না। শহরে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে কীটনাশক ছিটানোসহ নানা কার্যক্রম পরিচালিত হলেও গ্রামে তা করা হয় না।

চট্টগ্রাম জেলা কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদাওচ আজাদীকে বলেন, গতবারের তুলনায় তো এবার ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে। ওই হিসেবে উপজেলায়ও বাড়ছে। তাছাড়া বৃষ্টি তো সব জায়গায় হচ্ছে। শহরগ্রাম সবখানে হচ্ছে। এতে এডিস মশার বিস্তার গ্রামেও বাড়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

আর বিশেষ কোনো কারণ আছে কীনা জানতে চাইলে বলেন, নগরায়ন দ্রুত হচ্ছে। নগরায়নের কারণে গ্রামগুলোও এখন শহরের মত হয়ে যাচ্ছে। সেখানেও কন্টেনার ফুড খাচ্ছে মানুষ এবং যেখানেসেখানে মানুষ পলিথিনপ্লাস্টিক ফেলে রাখছে। এটার পরিমাণও দিন দিন বাড়ছে। পলিথিন, প্লাস্টিক, বোতলে জমে থাকা পানিতে তো মশা ডিম পাড়ে।

তিনি বলেন, গ্রামের মশাটাও তুলনামূলকভাবে আগের চেয়ে বেড়েছে। ডেঙ্গুবাহী ‘এডিস অ্যালবোপিকটাস’ মশা আগে গ্রামে কম পেতাম। আগে ১৫ বা ২০ শতাংশ এর মধ্যে ছিল। এবার ২৫ শতাংশ বা ৩০ শতাংশ হয়ে গেছে। শহরেও এ মশাটা পাওয়া গেছে। তবে ডেঙ্গু ছড়ানোর জন্য ওটা (এডিস অ্যালবোপিকটাস বেড়ে যাওয়া) ফ্যাক্টর কীনা আমরা এখনো নিশ্চিত না, সেটা এখনো আইডেন্টিফাইড না। তবে এখন ‘এডিস ইজিপ্টাই’ গ্রামে পাওয়া যাচ্ছে। আবার এডিস অ্যালবোপিকটাস শহরে পাওয়া যাচ্ছে।

গত ২৭ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) যৌথভাবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে একটি বৈঠকের আয়োজন করে। সেখানে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, এ বছর ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ কোন ধরনের মশায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, তা আমরা জানি না। শহরের মানুষকে পানি জমিয়ে রাখতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু গ্রামের মানুষের পানি না জমিয়ে উপায় থাকে না। তাহলে ডেঙ্গু মোকাবিলায় গ্রামের মানুষের জন্য কী বার্তা দেওয়া হবে?

কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবীরুল বাশার সম্প্রতি গণমাধ্যমে বলেন, এবার এডিস যেভাবে গ্রামে ছড়িয়েছে, তাতে আর এ মশা এ দেশ থেকে তাড়ানো যাবে বলে মনে হয় না। এবার যেসব গ্রামে পাওয়া গেল, ভবিষ্যতে আশপাশের নতুন নতুন গ্রামে পাওয়া যেতে পারে।

উপজেলায় রোগী বেশি সীতাকুণ্ডে : চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে গতকাল ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয় ৮ হাজার ৫৭৩ জন ডেঙ্গু রোগী। এর মধ্যে মহানগরের রোগী আছে ৫ হাজার ৯৬০ জন (যা মোট রোগীর ৬৯ দশমিক ৫২ শতাংশ) এবং গ্রামের রোগী আছে ২ হাজার ৬১৩ জন। উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী চিকিৎসা নেয় আগস্ট মাসে। মাসটিতে ১ হাজার ১৪ জন উপজেলার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।

চলতি বছর এ পর্যন্ত উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর মধ্যে সর্বোচ্চ ৯৪৭ জন সীতাকুণ্ড উপজেলার বাসিন্দা। এছাড়া লোহাগাড়ার ৮৬ জন, সাতকানিয়ার ১১৮ জন, বাঁশখালীর ১৭১ জন, আনোয়ারার ১১৩ জন, চন্দনাইশের ৫৫ জন, পটিয়ার ২৮৫ জন, বোয়ালখালীর ৬০ জন, রাঙ্গুনিয়ার ৫৬ জন, রাউজানের ৯৬ জন, ফটিকছড়ির ১৩০ জন, হাটহাজারীর ২০৯ জন, মীরসরাইয়ের ১৬১ জন, সন্দ্বীপের ৫৪ জন, এবং কর্ণফুলী উপজেলার বাসিন্দা রয়েছে ৭২ জন।

গতকালকের ডেঙ্গু পরিস্থিতি : সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রামে গতকাল নতুন করে ৭৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএগিয়ে যাওয়ার লড়াই আজ
পরবর্তী নিবন্ধদুদিনে ছয়বার সংঘর্ষে জড়াল ছাত্রলীগ