অমিত দত্তের চলচ্চিত্র কখনও জনসাধারণের জন্য প্রদর্শিত হয়নি। যে কারণে সম্ভবত বেশিরভাগ লোকেরা তাঁর নাম শোনেনি। কিন্তু রটারডাম, ভেনিস, এমনকি কেরালা বা মুম্বাইতেও ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যান, আপনি অন্তত কিছু লোককে তাঁর সিনেমা নিয়ে কথা বলতে দেখতে পাবেন। শৈল্পিকভাবে চ্যালেঞ্জিং ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম, যার কাজ সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়। অমিত দত্ত বহু বছর ধরে ভারতীয় সিনেমা বলতে কী বোঝায় তা নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছেন। তাঁর চলচ্চিত্রগুলি বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে তবে সেগুলি ভারতীয় দর্শকদের কাছে অনেকটাই অজানা থেকে যায়।
কেন? তাহলে কীভাবে একজন বহুল প্রশংসিত চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি ছাড়া দর্শক খুঁজে পান?
দত্তের কাছে এর একটা সমাধান আছে। তিনি ল্যাপটপ দর্শকের গভীর সমর্থক।
তিনি লিখেছেন, ‘আমি এই ধরণের দেখার প্রতি খুব আগ্রহী হয়ে উঠছি। গভীরভাবে বারবার দেখা– সে আমার আদর্শ দর্শক, এটি একটি বই পড়ার মতো ব্যক্তিগত। আপনি একটি বই নিয়ে পড়ুন; সম্মিলিত পাঠের অধিবেশনে যোগ দেবার দরকার নেই।’
দত্তের সিনেমার দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর দেশে ভারতের সিনেমা চিন্তাধারার মূলধারার থেকে একেবারেই আলাদা। বিশ্বের অনেক শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাণের পথিকৃৎ এবং সেইসাথে ভারতীয় নিউ ওয়েভের সূচনাকারী পরিচালকদের মতো, দত্তের চলচ্চিত্রগুলি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে প্রতিটি ফ্রেম এক একটি চিত্রকর্ম।
এমনকি সাক্ষাৎকার দিতেও তার অনীহা প্রবল। তবু মানুষ তো অনুসন্ধিৎসু, তাই, এ ধরনের নানান প্রশ্ন তাঁকে বিভিন্ন সময়ে করা হয়েছিল, কোনো এক জায়গায় তিনি বলেছিলেন–
“আমি সিনেমা থেকে সিনেমায় আসিনি। আমার পরিবারে আমরা বছরে একবারই বলিউডের সিনেমা দেখতাম। আমি দুর্দান্ত কোনো চলচ্চিত্র দেখিনি, সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমি চলচ্চিত্র তৈরি করব, আরও বলেছেন “আমি সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে লেখা একটি বই হাতে পাই, যেখানে তাঁকে পড়তে দেখা যাচ্ছিল। তাঁর সুন্দর কিন্তু কার্যকরী, পরিমিতভাবে সজ্জিত লাইব্রেরি এবং ব্যক্তিত্ব দ্বারা খুব প্রভাবিত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম একটি সাধারণ, মধ্যবিত্ত বা উচ্চ–মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করা সম্ভব এবং এভাবেও একজন গভীর চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়া সম্ভব। এভাবেই সিনেমাকে ব্যক্তিগত ক্রিয়াকলাপ হিসাবে তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল।” অমিত দত্ত তাঁর শৈল্পিক লক্ষ্যগুলো ব্যখ্যা করতে গিয়ে আরও বলেন “আমার প্রাথমিক কাজ হল চলচ্চিত্র নির্মাণ, আমি সিনেমা নিয়ে মুগ্ধ। এটি সবচেয়ে সাম্প্রতিক শিল্প ফর্ম এবং এটি শিখতে অন্যান্য শিল্প ফর্মে যেতে হবে, যদিও এটি এখনও খুব অনুন্নত। আমার কাছে চলচ্চিত্র নির্মাণ একটি দার্শনিক অনুসন্ধান, একটি আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান। যা কিছু এড়িয়ে যায়, তার অন্বেষণে আমি এটিকে ব্যবহার করতে চাই।”
তিনি মনে করেন সিনেমা হল সংস্কৃতি, ইতিহাস, সংগীত, সৌন্দর্য এবং শেষ পর্যন্ত সত্যের মাধ্যমে একটি অনুসন্ধান এবং শেখার উপায়। ভারতের হিমাচল প্রদেশের ছোট্ট একটি শহর যার নাম পালামপুর সেখানে সস্ত্রীক বসবাস করেন, স্ত্রীর নাম ঐশ্বরীয়া, যিনি নিজেও একজন শিল্পী। ১৯৭৭ সালে জম্মুতে জন্ম নেয়া অমিত একজন চলচ্চিত্রকার এবং চিত্রনাট্যকার। এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমার অন্যতম ধারক হিসেবে তিনি এখন বিশ্বব্যাপী পরিচিত। মূলতঃ ভারতীয় নন্দনতত্ত্ব এবং প্রতীকি নিজস্ব উপস্থাপনশৈলীর জন্য তিনি প্রশংসিত। তাঁর প্রতিটি কাজ গবেষণালব্ধ, তাঁর সিনেমায় মূর্ত হয়ে উঠেছে ভারতীয় শিল্পের ইতিহাস ও নৃতাত্ত্বিকতা। দর্শক তার সিনেমা নিঃসৃত ধারণার সাথে সহমত বা দ্বিমত হতে পারে। তাঁর কাজ বা কাজের উপস্থিতি ওই সিনেমা দেখবার সময়টুকুই, বাকী স্থাপন বা প্রতিস্থাপন দর্শকের নিজস্ব ভাবনাপ্রসূত।
‘ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়া, পুনে থেকে ২০০৪ সালে গ্রাজুয়েশান শেষে অমিত অনেক এক্সপেরিমেন্টাল স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করে ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিলেন। ২০০৭ সালে নির্মাণ করেন পরীক্ষামূলক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ক্রমশঃ’ (To be continued), এই চলচ্চিত্র বোদ্ধা এবং সমালোচকদের কাছ থেকে যথেষ্ট প্রশংসা অর্জন করেছিল এবং পরীক্ষামূলক সিনেমায় এটিকে একটি মাইলফলক বলে বিবেচনা করা হয়। অনেক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভের পরে, এটি চলচ্চিত্র সমালোচক জোনাথন রোজেনবাউম দ্বারা সংকলিত সর্বকালের সেরা হাজার হাজার সেরা চলচ্চিত্রের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ২০০৭ সালের সিনেমার জরিপের সেরা চলচ্চিত্র হিসাবেও এটি ভোট পেয়েছিল।
‘ক্রমশঃ’ (kramasha) সিনেমাটি মূলত ব্যক্তিগত পৌরাণিক কাহিনী, সাহিত্যপাঠ এবং সিনেমাটিক চিত্রের মধ্যে সম্পর্কের অন্বেষণ হিসাবে বিবেচিত হয়। পরবর্তীতে এই অন্বেষণ তাঁর ধারাবাহিক কল্পকাহিনী চলচ্চিত্র ‘দ্য ম্যান ওম্যান এন্ড আদার স্টোরিজ (২০০৯)-এ অব্যাহতভাবে দেখা যায়। ২০১০ সালে নয়নসুখ (Nainshukh) সিনেমা নির্মাণের পরে অমিত ব্যাপক আলোচনায় চলে আসেন। ১৮শ শতাব্দীর হিমাচল প্রদেশের কাংরা ভ্যালির মিনিয়েচার আর্টিস্ট নয়নসুখকে নিয়ে নির্মিত হয় এই চলচ্চিত্র। বলা হয়েছিল এই সিনেমা ডকুমেন্টারি পদ্ধতি এবং কাহিনীচিত্রের এক অপূর্ব মিশ্রণ। এই সিনেমায় তিনি কেবল নয়নসুখের চিত্রায়িত বহুরূপী সৌন্দর্যেই নয়, তার সৌন্দর্য, ইতিহাস, সংগীত এবং রসগুলির বহু স্তর সহ মিনিয়েচার আর্টের বহুবিধ রূপকেও গভীরভাবে অনুভব করেছেন ও করিয়েছেন। তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ডায়লগ ছাড়া, প্রায় নিঃশব্দ এই সিনেমাটি চিত্র এবং শব্দগুলির সম্মোহক সংশ্লেষ তৈরির মাধ্যমে একটি হারিয়ে যাওয়া সময়কে উপস্থাপন করে।
২০১৩ সালে অমিত দত্ত সেই কাংরা ভ্যালিতে আবার ফিরে যান, এবারের সিনেমার নাম ‘দ্যা সেভেন্থ ওয়াক’ (The seventh walk), এই সিনেমায় তিনি এক শিল্পী পরমজিত–এর মাধ্যমে এই অঞ্চলের ভিজ্যুয়াল আর্টের ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছেন। সিনেমাটি মূলতঃ পরমজিত সিং এর ছবিগুলোকে উপজীব্য করে একটি স্যুরিয়েল চিত্রায়ন, যাতে শব্দ চিত্র এবং টেক্সট মিলেমিশে একাকার হয়েছে। সিনেমায় একটি বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো চিত্রকর রহস্যজনক পদচিহ্ন দেখতে পান এবং সংগীতের সুক্ষ্ম শ্রুতিতরঙ্গ শুনতে পান যা তাকে উৎসের সন্ধানে প্রকৃতির গভীরে নিয়ে যায়, তিনি এগিয়ে চলেন এই আকাঙ্ক্ষায় যে এটি তাকে অন্তর্নিহিত সন্ধানের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ঘুরতে ঘুরতে শিল্পী গাছের নীচে বসেন বুদ্ধের মত ধ্যানী ভঙ্গিতে; স্বপ্নের ভেতর নিজেকে হাঁটতে, আঁকতে, পাথরকে এবং মহাকর্ষকে অস্বীকার করতে দেখছে। একটি ছোট্ট মেয়ে তার প্রতিদিনের ফল এবং দুধ সরবরাহের জন্য আকাশপথে যাত্রা করছে, ঋতু পরিবর্তন হচ্ছে এবং বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। তিনি উঠে তাঁর নিজের আঁকা চিত্রের তৈরি প্রাকৃতিক দৃশ্যে হাঁটেন যেখানে তার সন্ধানের বস্তুটি তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে পারে, মিউজিক ইন্সট্রুমেন্টের শব্দ এবং উপত্যকার জীবন (বাতাসের শিস, ডানা ঝাপটানো, পাখির ডাক, বয়ে যাওয়া জলের ঝাপটা), গাছ–গাছালিতে আলোর খেলা ইত্যাদি তিনি আঁকতে থাকেন।
কেউ তাঁকে আব্বাস কিয়ারোস্তামির ধারা অনুসরণকারী হিসেবে বিবেচনা করেন, আবার কেউ হয়তো ভাবেন তাঁকে সাত বছরের অগ্রজ আপিচাতপং এর কন্টেম্পরারি, অমিত দত্তের চলচ্চিত্র সহজ একটা পরিসমাপ্তির দিকে ধাবিত হয় না। তাঁর সিনেমা কারুকাজ করা দৃশ্যাবলী থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুখোমুখি হয়ে মনমরা স্ব–প্রতিচ্ছবি থেকে ভুতুড়ে যাদুতে চলে যায়। শিল্প সাহিত্য, সংগীত এবং বিশেষত চিত্রকলায় ঠাসা দত্তের কাজগুলো। এগুলো তাঁর চলচ্চিত্রগুলির বিষয় হিসাবে প্রদর্শিত হয়। পেইন্টিংগুলির মতো, এই ফিল্মগুলির পৃষ্ঠের টান রয়েছে। এই পৃষ্ঠের পিছনে ইঞ্চিগুলি আবছা, প্রতিধ্বনির স্থান রয়েছে যেখানে অহরহ ট্র্যাকিং শট এবং দূরবর্তী পরিবেশগুলি খুব তাৎ্ক্ষণিক সময়ের প্রস্তাব করে যা দীর্ঘ অতীত। দত্তের চলচ্চিত্রগুলিতে যেমন অস্থায়ী ও স্থানিক নিবন্ধগুলি একত্রিত হয় এবং অস্পষ্ট হয়, তেমনি শিল্প ও প্রকৃতিও প্রকৃতপক্ষে মনুষ্যসৃষ্ট এবং প্রাকৃতিক হয়, যতক্ষণ না তাদের পার্থক্যগুলি ম্লান হয়ে যায় এবং মধ্যবর্তী ফাঁকগুলি থেকে উদ্ভূত সমৃদ্ধ অনুরণনগুলির পথ তৈরি না করে।
পরিশেষে এইটুকু বলা যেতে পারে যে অমিত দত্তের ছবি দেখবার জন্য দর্শককেও প্রস্তুত হতে হয়। ফাদায়েভ নামের একজন লেখক একবার পিকাসোর ছবি দেখে বলেছিলেন, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না’। পিকাসো উত্তরে বলেছিলেন, ‘তুমি ঠিক বলেছ, তোমার পক্ষে আদতে বোঝা সম্ভব নয়। তুমি তো লেখাপড়া শিখেছিলে– কতদিন ধরে অ–আ–ক–খ শিখেছ? পেইন্টিং দেখা তো শেখনি। শিখতে হবে, তা না হলে তুমি পারবে না। ’