তারুণ্য, মুক্তচিন্তা এবং অগ্রসরমান বাংলাদেশ

সৌভিক চৌধুরী | রবিবার , ১ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৪:৩৮ পূর্বাহ্ণ

একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে দাঁড়িয়ে এক অভিনব বাংলাদেশ দেখার সুযোগ হয়েছে আমাদের। সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে চলেছে, সামষ্টিক কর্মক্ষেত্রের মাধ্যমেই তা করা সম্ভব হচ্ছে। আর এই ক্ষেত্র যদি অটুট থাকে তবে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস পেরিয়ে পাকিস্তান আমল হয়ে আজ যে বাংলাদেশ আমরা দেখছি তার প্রেক্ষিতে বলা যায়, বাঙালির চিন্তা চেতনায় এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। আধুনিক ভাবনার জাগরণ ঘটেছে, সৃষ্টিশীলতার উন্মেষ ঘটছে সবার মাঝে, বিশেষত তরুণ সমাজের ভেতর, যারা দেশের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। উন্নয়ন শুধু কাঠামোগত চিন্তাভাবনার ফসল নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে চিন্তার উন্মুক্ততা এবং তারুণ্যের সম্পৃক্ততা। আমরা যদি দেখি, ইউরোপের জাগরণের দিকে সেখানে ষোড়শ শতকে মানুষের মাঝে জাগরণ এসেছিলো। রেনেসাঁসের হাত ধরেই সেখানে মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং যুক্তিবোধের মাধ্যমে উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছিলো। বাঙালি সমাজে মুক্তবুদ্ধির চর্চার জন্য আমাদের বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের শোষণ শাসনের ফলে অনেকটা পিছিয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিলো একসময়। পাকিস্তান আমলের সেই সময়টাতে আমাদের চিন্তা চেতনায় অনেকটাই বন্ধ্যাত্ব তৈরি হয়। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের দিকে অগ্রসর হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব আমাদের পথ দেখায়। একটি ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য চেষ্টা তিনি করেছিলেন বটে কিন্তু সময় তিনি পাননি। তাঁর হত্যাকাণ্ডের পর অনেকটাই থেমে যায় কর্মপ্রক্রিয়া। নতুনভাবে জেগে ওঠার স্বপ্ন এসেছিল, তবে অনেক সময় পরেই তা সম্ভব হয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন শুধু একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়নি, আমাদের আর্থ সামাজিক অগ্রগতিরও একটি পথ বাতলে দিয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যেমন তরুণ সমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে, তেমনি তারুণ্যের উদ্দীপনায় দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমও এগিয়ে গেছে। একসময়ের ২০০ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশ থেকে এখন ২৮২৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। একটু ফিরে তাকালেই দেখা যাবে, মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে এই তরুণ সমাজ গড়ে তুলেছিল ‘মুজিব বাহিনী’। পাকিস্তানী বাহিনির বিরুদ্ধে তাদের কার্যক্রম চোখে পড়ার মত। উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থানে তরুণ সমাজের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং অংশগ্রহণ স্বৈরাচারের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। এরও আগে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে তরুণ প্রতিবাদী জনতা প্রাণ দিয়েছে। সামাজিকভাবে তখন মানুষের মধ্যে মুক্ত চিন্তার প্রভাব পড়েছিলো। তরুণ সমাজ মনে করেছিলো মানুষের মুক্তি অবশ্যম্ভাবী এবং সম্মিলিতভাবে আন্দোলন এগিয়ে নেয়া না হলে মুক্তি মিলবে না। তখনো তৎকালীন সরকার প্রতিবাদী জনতাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মত প্রকাশের শক্তি তাদের এগিয়ে নিয়েছে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার গুরুত্ব ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। সমাজসত্তা সক্রিয় এবং অবিচল থাকে যদি সেখানে মত এবং চিন্তার সচলতা অবাধ থাকে। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অভাবিত নৃশংসতায় মেতে উঠেছিলো বিশ্ব। ইউরোপ এবং এশিয়া জুড়ে যে নিষ্ঠুরতা হয়েছিলো তার পেছনে ছিলো শ্রেষ্ঠত্বের মতাদর্শ থেকে অপর জাতিসমূহকে পদানত, পর্যুদস্ত এবং পরাধীনতার অবস্থায় নিয়ে যাওয়া। এর পর থেকেই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার সূচনা করা হয়। শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে ইউনেস্কো। মতাদর্শের স্বাধীনতা এবং সংঘাতকে বড় পরিসরে বিবেচনা এবং সেই উপলব্ধি থেকে বিভিন্ন বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণে ব্রতী হয় ইউনেস্কো। প্রতিটি দেশে চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্রগুলোকে সমৃদ্ধ করার কাজ করে যাছে তারা। এ ক্ষেত্রে একটি জাতির চিন্তার প্রসারতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রিয়াকলাপ মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে বিভিন্ন মতাদর্শের দল এবং মানুষের অবস্থান রয়েছে। মতাদর্শগত পার্থক্য রয়েছে অনেকের ক্ষেত্রে। কিন্তু তাই বলে একটি দেশের উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষায় এই মতাদর্শগত পার্থক্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। তরুণ সমাজ এই পার্থক্যের উর্ধে উঠে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে তৎকালীন শাসন ব্যবস্থায় মতের আদর্শকে শাসকগোষ্ঠী গুরুত্ব না দিলেও তরুণ সমাজ বিভিন্ন মতাদর্শ কখনো উপেক্ষা করেনি বরং নেতৃত্বের মতাদর্শকে তারা মেনে নিয়েছে এবং তা থেকে তারা বিচ্যুত হয়নি। যেমনটি তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের দিকে অগ্রসর হয়েছে।

মতাদর্শের সাথে মুক্তচিন্তারও একটা যোগসূত্র আছে। মুক্তচিন্তা বা চিন্তার স্বাধীনতা মূলত মতাদর্শের প্রকাশের পূর্বশর্ত হয়ে দাঁড়ায়। এই মুক্তচিন্তা প্রকাশে নির্ভীকতা একটি অন্যতম শর্ত। একজন মানুষ তার মতের আদর্শকে তখনই প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হন যখন তিনি নির্ভয়ে এগিয়ে যান। ধর্মীয় সংকীর্ণতা কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু তা একেবারে মুক্তচিন্তাকে গ্রাস করতে পারে না। তারুণ্যের মুক্তচিন্তা যখন একটি দেশের উন্নয়নের নিয়ামক শক্তি হয়ে দাঁড়ায় তখন একে একেবারেই উপেক্ষা করা যায় না। অগ্রগতির প্রকাশ্য শক্তি যখন চিন্তার স্বাধীনতা, তখন নির্ভীকতা এ ক্ষেত্রে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। মুক্তচিন্তার পথে যদি রাষ্ট্র বাধা হয়ে না দাঁড়ায় তবে তরুণদের এগিয়ে যাওয়ার পথও রুদ্ধ হয় না। রাষ্ট্র মানে শুধু সরকারি দল নয়, বিরোধী দল, সামরিক বাহিনী, সিভিল সোসাইটি, পুলিশ, আমলা তন্ত্র, আইন আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় নেতা, গণমাধ্যম সবকিছুর সমষ্টি। এই সমষ্টির কোনও একটি অংশ যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায় তবে এগিয়ে চলার পথ বাধাগ্রস্ত হয়। কাজেই উদারমনা জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ অবশ্যম্ভাবী।

স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের অগ্রগতি ধাপে ধাপে অনেকটাই উন্নত হয়েছে বলা যায়। জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ শতাংশের বেশি। শিক্ষাখাত, স্বাস্থসেবা, নারী ও শিশু উন্নয়নে প্রভূত অর্জন সাধিত হয়েছে। এমডিজি অর্জনে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশ। এসডিজি অর্জনের বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের লক্ষণীয় অর্জন হয়েছে। পদ্মা বহুমুখী সেতু এবং কর্ণফুলী টানেলের মত বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এগিয়ে যাবে। তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়েছে যারা, তারা কখনো পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখেনি, দেখেছে চিন্তার স্বাধীনতাকে কিভাবে অগ্রসরমান করা যায় সেই ভাবনাকে। খেলাধুলার ক্ষেত্রে তারুণ্যের জয়গান এখন বিশ্বপ্রশংসিত।

সমাজ রাজনীতি অর্থনীতি সবই তো তারুণ্যের শক্তিতে গতিপ্রাপ্ত হয়। তারা জাগ্রত চিত্তের সৈনিক। তরুণরা সত্য জানে, জানতে চায়, জানাতে চায়। তারা যুক্তিবাদী, যুক্তি দিয়ে প্রতিটি ঘটনার কারণ জানতে চায়। যুক্তি দিয়ে প্রচলিত বিশ্বাসের রহস্য উদঘাটন করতে চায়। তরুণরা যে স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্নকে চ্যালেঞ্জ নিয়ে হলেও বাস্তবায়ন করতে পিছপা হয় না। বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন, ২০৫০ সাল নাগাদ বর্তমানে থাকা ৩০ শতাংশ তরুণের সংখ্যা ১০ থেকে ১৯ শতাংশে নেমে আসবে। তাই বিশাল এবং কর্মক্ষম তরুণদের এখনই আমাদের কাজে লাগাতে হবে। তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে দেশপ্রেমে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান হতে হবে এবং করতে হবে উদ্যমী। শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সঠিক নির্দেশনার মাধ্যমে তাদের দেশ গড়ায় নিয়োজিত করতে হবে। কোনও মৌলবাদী চিন্তাভাবনার মাধ্যমে তাদের আটকে রাখা যাবে না। তরুণদের কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি অংশের দায়িত্ব বাড়াতে হবে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে অগ্রগতির ধারায় তরুণদের সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে।

গত ৫০ বছর ধরে তরুণদের প্রজ্ঞা এবং চিন্তার প্রখরতাকে ছোট করে দেখা যায় না। অনেক বাধা বিপত্তি এসেছে, তা সত্ত্বেও এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে উদ্যমী হয়েছে তরুণ সমাজ। তরুণদের শুধু শিক্ষিত হলেই হবে না, তাদের ভিতরের সৃষ্টিমূলক ভাবনাকে আরো বিকশিত করতে হবে। এই বিকাশে বুদ্ধির মুক্তি অবশ্যই প্রয়োজন। আর মুক্ত বুদ্ধির চর্চা করতে গিয়ে সব কুসংস্কারের উর্ধ্বে ওঠা জরুরি। পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা তারুণ্যের শক্তিকে অনেকটাই মজবুত করে। সমাজের বিশিষ্টজনদের ইতিবাচক ভূমিকা তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে, তাদের এগিয়ে চলার পথকে অনেকটাই সাবলীল করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিজেদের সমৃদ্ধ করা এবং অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় তরুণ সমাজের ভিতর থাকা দরকার। নিজেদের ভেতর সততা, মূল্যবোধ, দক্ষতা এ বিষয়গুলো ধারণ করার অঙ্গীকার থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে একটি আলোকময় বাংলাদেশ গড়ার শপথে বলীয়ান হতে হবে আমাদের তরুণ সমাজকে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, আবৃত্তিকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধ২০২৩ সালে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় থাকুক