‘অসম্ভবের অভিযানে এরা চলে,/ না চলেই ভীরু ভয়ে লুকায় অঞ্চলে!/ এরা অকারণ দুর্নিবার প্রাণের ঢেউ,/ তবু ছুটে চলে যদিও দেখেনি সাগর কেউ।’ এভাবেই তারুণ্যের জয়গান করেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যুগ যুগ ধরে জয়ধ্বনি হয়ে আসছে তারুণ্যের। তারুণ্যের সাহস, শৌর্য–বীর্য ও বীরত্বের প্রশংসা হয়েছে সর্বকালে। কারণ ‘দুনিয়া বদলাতে বৃদ্ধের অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের শক্তি দুটোই দরকার’।
নগরে চলছে বইমেলা। সেখানেও জয়গান হয়েছে তারুণ্যের। তার অংশ হিসেবে গতকাল মেলামঞ্চে আয়োজন করা হয় তারুণ্যের উৎসবের। বই এবং উৎসব, দুয়ের টানে এদিন ছুটে আসা তরুণদের ঢল নামে মেলা প্রাঙ্গণ সিআরবি শিরীষতলায়। তরুণদের সরব উপস্থিতিতে আরো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বইমেলা। কেবল মেলায় আসার উচ্ছ্বাসের আবহ নিয়ে ঘরে ফিরেননি তরুণরা। সাথে নিয়েছেন নতুন কেনা বইয়ের প্যাকেটও। এতে সন্তোষ প্রকাশ করেন প্রকাশকরাও।
ত্রিশোর্ধ্ব তরুণ শাহরিয়ার পারভেজ শাকিল চাকরি করেন ওয়ান ব্যাংকে। সন্ধ্যায় প্রথমা প্রকাশনার স্টলে সাজিয়ে রাখা বই দেখছিলেন মনোযোগ দিয়ে। পরে পছন্দ হওয়ায় কিনলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের ‘রক্তাক্ত দিনগুলো ১৯৭৫–৮১’। আজাদীকে তিনি বলেন, ১৯৭৫ পরবর্তী সময়গুলো নিয়ে জানার আগ্রহ আছে আমার। ওই সময় অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান হয়। তার সঠিক ইতিহাস জানার কৌতূহল রয়েছে। ‘রক্তাক্ত দিনগুলো ১৯৭৫–৮১’–এ এ সংক্রান্ত কিছু ধারণা পাব বলে বিশ্বাস থেকে বইটি কিনলাম।
খড়িমাটির স্টলের সামনে কথা হয় জ্বালানি সেক্টরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রবিন কিশোর রানার সাথে। তিনি আজাদীকে বলেন, বইমেলার জন্য শিরীষতলা চমৎকার জায়গা। এখানকার পরিবেশের সঙ্গে বইমেলা মানানসই। এসে ভালো লাগছে। পছন্দের লেখকের বই পেলে কিনব।
সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় গতকালও মেলায় নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ এসেছেন বইমেলায়। ফলে এদিনও ভিড় ছিল দিনভর। পাঠক–দর্শনার্থীর উপস্থিতির সঙ্গে বেড়েছে বেচাকেনাও। বিকালে আদর্শের স্টলে দেখা গেছে, খুদে লেখক উম্মে মাইসুনকে দেখতে ভিড় করেন তার ভক্তরা। স্টলটিতে বিক্রি হচ্ছিল তার লেখা তিনটি বই।
জলধি প্রকাশনের ইমরুল ইয়ামিন মাহীন বলেন, বেচাকেনা মোটামুটি হচ্ছে। বেশিরভাগ নতুন লেখকের বই রয়েছে আমাদের স্টলে। স্বাধীন প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী হৃদয় হাসান বাবু বলেন, প্রতিদিনই তারুণ্যের সরব উপস্থিতি থাকে মেলায়। আজ (গতকাল) তারুণ্যের উৎসব থাকায় ভিড় একটু বেড়েছে। বেচাকেনাও খারাপ হয়নি।
গতকাল ছিল মেলার ৮ম দিন। মেলা চলবে আগামী ২ মার্চ পর্যন্ত। মেলা প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা ও ছুটির দিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
নতুন বইয়ের খবর : বইমেলায় নতুন আসা বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম নিপুর ‘৬৯ থেকে ৭১’, অঞ্জন নন্দীর ‘আপ শান্তিপুর লোকাল’, মুস্তফা নঈমের ‘স্মৃতি বিস্মৃতির কানুনগোপাড়া’, সাবিনা পারভীন লীনা সম্পাদিত ‘শহিদ কবি মেহেরুন্নেসা সূর্যজ্যোতির পাখি’ ও বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘অভিযুক্ত’।
‘আপ শান্তিপুর লোকাল’ এর ফ্ল্যাপে লেখা আছে, মানুষ যদি জানতে পারে, তার কোনো জন্মপরিচয় নেই, তখন তার মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে? আর কেউ যখন জানতে পারে, সে আসলে ১৯৭১–এর মুক্তিযুদ্ধের পাকিস্তানি সৈন্যদের পাশবিক অত্যাচারের ফসল, তখন? আপ শান্তিপুর লোকালের নায়ক (নাকি খলনায়ক) একটা পর্যায়ে জানতে পারে সে ‘যুদ্ধশিশু’। স্বীকৃতি তো দূরের কথা, যাদেরকে গভীর ভালোবাসা দিয়ে কেউ বলে না তোমরা এই দেশের রক্তাক্ত জন্ম প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ, তোমরা এই দেশের সন্তান, আমাদের আপনজন। যুদ্ধশিশুদের মা, যারা বীরাঙ্গনা, তারাও এই সন্তানদের পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত। সে এক করুণ ইতিহাস, বড়ো বেদনার মূর্ছনা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যুদ্ধশিশুদের কথা খুব কমই উচ্চারিত হয়। মায়ের উপর অত্যাচারের প্রতিশোধের আগুনে পুড়তে থাকে সন্তানের হৃদয়। সেকি পারবে প্রতিশোধ নিতে? সেকি তথাকথিত ভদ্র সমাজে কখনো নিজের অধিকার ফিরে পাবে! নাকি লাল–সবুজ পতাকা বুকে ধারণ করেও বলতে হবে ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ!
শাহ আলম নিপু তার ‘৬৯ থেকে ৭১’ গ্রন্থ সম্পর্কে বলেন, ৭১–এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ দেশমাতৃকার জন্য আমার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। আন্দোলন–সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে আমার সম্পৃক্তি ছিলো চট্টগ্রাম শহর ও নিজ এলাকা মীরসরাইকেন্দ্রিক। সে সময়ে নিজের তোলা ছবি, দৈনন্দিন ডায়েরির পাতা ও স্মৃতির উপর নির্ভর করে ‘৬৯ থেকে ৭১’ রচিত। বয়স ও দীর্ঘসময় অতিক্রমের কারণে বইটি রচনা করতে গিয়ে স্মৃতির কাছে পরাজিত হয়েছি। তবুও চেষ্টা করেছি সত্য, সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ ঘটনাবলি তুলে ধরতে। আমি মনে করি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ইতিহাসের পাতায় আমার এ প্রয়াস একটি ক্ষুদ্রতম সংযোজন। অনাকাঙ্ক্ষিত তথ্য–ঘটনা বিচ্যুতির জন্য সহযোদ্ধাসহ সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থী।
মুস্তফা নঈম তার ‘স্মৃতি বিস্মৃতির কানুনগোপাড়া’ গ্রন্থ সম্পর্কে বলেন, আমার বেড়ে ওঠার প্রিয় প্রাঙ্গণ কানুনগোপাড়া এবং বোয়ালখালী নিয়ে যে স্মৃতির গল্পকথা সাজানোর চেষ্টা করেছি ‘স্মৃতি বিস্মৃতির কানুনগোপাড়া’য়। এতে অনিবার্যভাবেই ইতিহাস নির্ভর কিছু ঘটনা, ব্যক্তি উঠে এসেছে। একই সঙ্গে এই মাটির কীর্তিমান সন্তানদের মুখ তুলে ধরার চেষ্টা ছিল। এটা নিছক স্মৃতিচারণমূলক একটা লেখা। তারপরও এই জনপদ ও তার আশপাশের কিছু মানুষকে কেন্দ্র করে যেসব ঘটনা আবর্তিত হয়েছে তা লিপিবদ্ধ না হলে আমার লেখা অপূর্ণাঙ্গ থেকে যাবে। স্মৃতির সঙ্গে ইতিহাসের ঘটনার সন্নিবেশ ঘটেছে এখানে। প্রয়োজনের তাগিদেই যা হয়েছে। একই সঙ্গে এই জনপদের রত্ন সন্তান যাঁরা ধুলোর আস্তরণে ঢাকা পড়ে গেছেন বা যাচ্ছেন সেই ধুলো সরিয়ে কিছুটা আলোয় নিয়ে আসার একটা প্রয়াস রয়েছে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে তাদের পূর্বজনদের মুখচ্ছবি নতুন করে তুলে ধরার পাশাপাশি সমসাময়িক কালের কৃতী সন্তানদেরও তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। হয়তো সব প্রজন্মের সবাইকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। তারপরও চেষ্টা ছিলো। আগামীতে কেউ যদি এ নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হয় হয়তো তার কাজে আসতে পারে আমার এ প্রচেষ্টা।
‘শহিদ কবি মেহেরুন্নেসা সূর্যজ্যোতির পাখি’ গ্রন্থে শহিদ কবি মেহেরুন্নেসার জীবন ও কবিতা নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখা সংকলিত হয়েছে। কবি মনিরুল মনির বলেন, মেহেরুন্নেসা শুধু একজন কবি নন, সংগ্রামের আদর্শ প্রতীক রূপে বেঁচে থাকবেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াইয়ে জীবন উৎসর্গ করা মানবিক মানুষের চর্চায় তাঁদের জীবনপাঠ জরুরি।
তারুণ্যের উৎসব : বইমেলা মঞ্চে তারুণ্যের উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমদ। তারুণ্যের উৎসব উদ্বোধন করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত গুণীজন চিত্রনাট্যকার কাওসার চৌধুরী। ফেরদৌস আহমেদ বলেন, পৃথিবীর চারদিকে আজ তারুণ্যের জয় রব ধ্বনিত হচ্ছে। যারা তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে ভরপুর হতে পারেননি, তারা পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। বইমেলার প্রাণ হচ্ছে তরুণ–তরুণীরা। বই আত্মাকে পরিপুষ্ট করে, জ্ঞানকে করে সমৃদ্ধ। বই হচ্ছে মানুষের সত্যিকার বন্ধু। যা মানুষের বুকের ভিতর সযত্নে লালন করা স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিতে পারে।
কাওসার চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন দিবসে উপহার হিসেবে আমরা ফুল কিংবা অন্য কোনো সামগ্রী দিই। বাংলার প্রতি সম্মান দেখিয়ে প্রিয়জনকে বই উপহার দেওয়ার অভ্যাস করতে হবে। তাহলে একুশের প্রকৃত উদ্দেশ্য সফল হবে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বই মেলা কমিটির আহ্বায়ক কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সহসভাপতি চৌধুরী ফরিদ, কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন ও চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা লতিফুল হক কাজেমী।