ফসলি জমির মাটির ঊর্বরতা নষ্ট হওয়া, কায়িক শ্রমের বিনিময়ে যথাযথ পারিশ্রমিক না পাওয়া, একনাগাড়ে কর্মরত থাকার কারণে নানা রোগে আক্রান্তের ঝুঁকিসহ পরিবেশ ধ্বংস হওয়া, সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড়ের পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর গ্রেডিং প্রতারণায় চাষিদের আর্থিক ক্ষতিসহ নানা সমস্যা থাকলেও কমেনি তামাকের আবাদ। উপরন্তু এত এত সমস্যার পরও বেড়েই চলেছে তামাক আবাদের পরিধি।
কাগজে–কলমে সরকার তামাক চাষকে নিরুৎসাহিত করে যাচ্ছে, এমন কথা গণমাধ্যমে দেখা গেলেও বাস্তবতা হচ্ছে তার উল্টো। এবারের তামাক উৎপাদন মৌসুমেও (জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত) প্রতিবারের মতোই কক্সবাজার এবং বান্দরবানের প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছে তামাকের। নীল চাষের মতোই তামাকের ভয়াবহ আগ্রাসনে বাদ পড়েনি তিন ফসলি জমি, মাতামুহুরী, সাঙ্গুসহ পার্বত্য অঞ্চলের নদীতীরের খাস জমি, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সমতল ভূমিও। যেদিকে চোখ যায় সেদিকে শুধুই তামাক আর তামাক ক্ষেত।
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় এবারের তামাক উৎপাদন মৌসুমে অন্তত দুই হাজার হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে মাঠে নামেন চাষিরা। তন্মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন ফসলি জমি, বনবিভাগের সমতল ভূমি ও মাতামুহুরী নদীর দুই তীরের খাস জমিও রয়েছে। সরজমিন উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের মধ্যে অন্তত ৯টি ইউনিয়নে তামাক আবাদ শুরু করা হয়। গাছে গাছে পাতা যখন পরিপূর্ণতা পায় তখনই সেই পাতা সংগ্রহের পর তা কিউরিং (শোধন) করার জন্য নির্মিত স্থায়ী এবং অস্থায়ী চুল্লিতে আঁটি বেঁধে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়। এর পর চুল্লিতে বড় বড় গাছের গুঁড়ি দিয়ে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শোধন করা হয় উৎপাদিত তামাক পাতা। এজন্য রক্ষিত ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে অবৈধভাবে সংগৃহীত কোটি কোটি মণ লাকড়ির জোগান দিতে হয়।
সরজমিন তামাক উৎপাদনকারী ইউনিয়নগুলোতে দেখা গেছে, বর্তমানে তামাক উৎপাদনের জমিতে গোড়ালিসহ তামাক গাছ, তামাকের উচ্ছ্বিষ্ট পড়ে রয়েছে। সেই গাছ ও উচ্ছ্বিষ্ট বৃষ্টির পানিতে ভিজে পঁচে–গলে মাটিতে মিশছে। আবার ভারি বর্ষণ শুরু হলে সেই তামাকের উচ্ছিষ্ট এবং গাছ বিভিন্ন ছড়াখাল বেয়ে গিয়ে সরাসরি মিশছে পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরীসহ বিভিন্ন নদীতে। এতে মিঠাপানির মৎস্যভাণ্ডারও তছনছ হচ্ছে।
দেড় যুগ আগে থেকে তামাকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ) দাবি করেছেন– কঙবাজার এবং বান্দরবানের প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে তামাকের ভয়াবহ আগ্রাসন শুরু হয় চলতি বছরের শুরুতে। এই দুই জেলার বিভিন্ন উপজেলায় এই আগ্রাসন চলে।
গবেষণাকারী এই সংস্থাটি জানায়, উৎপাদিত তামাক শোধনের জন্য আগে থেকেই জ্বালানি হিসেবে লাকড়ি সংগ্রহের পর মজুদ করার জোর তৎপরতা শুরু হয় চাষিদের। আর এসব জ্বালানি সংগ্রহ করতে গিয়ে উজাড় করা হয় রক্ষিত ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল। কাটা পড়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগানের লাখ লাখ গাছও।
অপরদিকে তামাক পাতা শোধনের জন্য বাড়ির উঠান, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে নির্মিত চুল্লিগুলোও সংস্কারের কাজ চলে। এতে তামাক পোড়ার নিকোটিনের উৎকট গন্ধে ঘুম হারাম হয়ে যায় দুই জেলার বাসিন্দাদের।
চকরিয়া কৃষি বিভাগ জানায়, চকরিয়া উপজেলায় প্রায় ২২ হাজার হেক্টর আবাদি জমি রয়েছে। এর মধ্যে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও তামাক আবাদ হয়েছে ৬২০ হেক্টর জমিতে। বাকি জমিতে বোরো ধান, রবিশস্য, রকমারি শাকসবজির উৎপাদন হয়। তবে উবিনীগ এবং কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্যে ফারাক রয়েছে।
সুরাজপুরের তামাক চাষি মাহফুজুর রহমান, কাকারার এস এম চরের তৌহিদুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন তামাক চাষি জানান, সরকারিভাবে তামাক চাষকে নিষিদ্ধ না করলে প্রতিবছরই বাড়তে থাকবে তামাক আবাদের পরিধি। যেহেতু এ নিয়ে কড়াকড়ি নেই, সেহেতু দিন দিন বাড়তে থাকবেই তামাক চাষ।
তামাক চাষ করেন না এমন কয়েকজন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘তামাক চাষে ব্যাপকহারে সার–কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। আর সেই উপাদান কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে সরবরাহ দেওয়া হয়ে থাকে। এ নিয়ে তামাক চাষিদের কোনো মাথাব্যাথা করতে হয় না। এতে করে প্রতিবছর ফসলি জমিতে ব্যাপক হাতে সার–কীটনাশকের ব্যবহার বাড়তে থাকায় দিন দিন জমির ঊর্বরতা শক্তিও কমে যাচ্ছে।’
এ বিষয়ে সুরাজপুর–মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক বলেন, ‘দুই যুগের বেশিসময় ধরে এই ইউনিয়নে তামাক চাষ হচ্ছে। এর আগে চাষিদের নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলাম, কিন্তু তামাক কোম্পানির লোভের ফাঁদে পড়ে প্রান্তিক চাষিরা তামাক চাষ বাদ দিতে পারছে না। যদি তামাক চাষ সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলেই এটা থামানো সম্ভব।’
উবিনীগ কঙবাজারের আঞ্চলিক সমন্বয়ক মো. জয়নাল আবেদীন খান দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘তামাক চাষের কারণে যেমন জমির ঊর্বরতা কমে যাচ্ছে, তেমনি চাষি এবং পরিবারের সদস্যসহ আশপাশের মানুষ প্রতিবছর নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া তামাক শোধন করতে গিয়ে প্রতিবছর কঙবাজার ও বান্দরবানের প্রায় ১০ হাজার চুল্লিতে অন্তত ১০ কোটি টাকার কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে এই তামাক চাষ।’
চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম নাসিম হোসেন বলেন, ‘তামাক চাষের কুফল ও ভয়াবহতার কথা অনুধাবন করে প্রান্তিক চাষিদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর কার্যক্রম হাতে নিতে পারে সরকার।’