তাকাও, দেখবে। একটি কবিতার নাম। একটি কবিতার বইয়ের নাম। চিরন্তন সরল দুইটি শব্দ। সাধারণ দৃষ্টিতে এই শব্দ যুগল দুটিকে মনে হয় নিষ্প্রান,উচ্ছলতাহীন, বেগহীন। রবিঠাকুরের ভাষায়– “যে সংসারে প্রথম চোখ মেলেছিলুম সে ছিল অতি নিভৃত”। তাকাও, দেখবে এই শব্দদ্বয়ও তেমন যেন নিভৃত। ভাবাবেগের একধরনের যে উদবেলতা আছে তা যেন অনুপস্থিত। কিন্তু একটু দৃষ্টিপাত করলেই দেখা যায় প্রাণের ধারটাই যেন এই শব্দদ্বয়ের মধ্যে ফুলিয়া উঠিয়া ছাপাইয়া পড়ে। তাকাও, দেখবে কবি মোজাম্মেল মাহমুদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। তাকাও, দেখবে এই শব্দযুগলের মধ্য দিয়ে কবি মোজাম্মেল মাহমুদ সুনিপুন সুচারু কবিত্বের সুক্ষ্ম বুননের বিস্তার ঘটিয়েছেন। এই শব্দদ্বয়ের ভেতর দিয়েই লালন করা হয়েছে কবির নিজস্ব জীবন অনুভূতি। ঘটিয়েছেন নিজস্ব বোধের বিস্তার। প্রাণ জাগিলেই মানুষ পথ চলিতে প্রবৃত্ত হয়। কবির প্রাণ জেগেছিল তাইতো তার নিজস্ব শব্দ নৃত্যের অনুরণনগুলো, ভাবনাগুলো নিজস্বতার বলয় ছাড়িয়ে গিয়ে হয়ে উঠেছে সর্বোপরি সকল মানুষের তত্ত্বকথা। তাকাও, দেখবে কবিতার বইয়ের প্রতিটি চরণে এমন একটি অদ্ভুত যাদু আছে যাতে ভাবনাগুলো এতটাই প্রাণবান যে, বইটি পাঠে সেটা প্রমাণিত হয়। কিছু কবিতায় কবি নৈরাশ্যকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন তাতেও প্রাণের বেগে একটু একটু করে উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছে। কবির পাতাবন্দনা কবিতার প্রথম দুটি লাইন–
“যে সব শুকনো পাতা একদা সজীব ছিল
আমাদের কালে তারা জীবাশ্মপ্রতিম”
এই লাইনগুলো ভাবনার স্থিরতাকে আঘাত করে ভাবতে পুনরায় বাধ্য করেআমাদের জীবনের হিরন্ময় সময়ের কথা। যেন নাটাই থেকে সুতো ছিঁড়ে যাওয়া রং বেরংয়ের ঘুড়ির মতো নীল আকাশে জীবনের সরলীকরণ মায়াটাই হারিয়ে গেছে হাওয়ার অনুরণনে। জীবনের প্রভাতে যে পথে পথে আমরা যে পদচিহ্ন এঁকেছি অপরাহ্নের বিশ্রামগাওে বসে দিবাবসনের আলোকে পুরো ছবিটা যখন উঠে আসে অতীতজীবনের প্রতি একটি মমত্বজনিত ব্যাধি জীবাশ্মপ্রতিম হয়েই জীবাশ্মরূপে ফিরে আসে। এখানে কবি হয়তো জীবনবৃত্তান্তের একটা ছাপ এঁকেছেন। স্মরণ করিয়েছেন আমাদের জীবনের অমোঘ সত্যটাকে।
আত্নরতি কবিতায় জ্যোতিষী যেন অন্তদেবতার ভূমিকায় তত্ত্ববিদ্যার একচেটিয়ে অধিকারী। কবি আত্নরতি কবিতার মাধ্যমে আমাদের দেখিয়েছেন আমরা সমাজ আর রাষ্ট্রের এক শ্রেণীর জ্যেতিষীর কাছে আমরা আমাদের অনাদি অতীত আর অনন্ত ভবিষৎ পরিপ্লুত করে আছি। বোধের বিসর্জনে ভোগের চিত্রনাট্যে সমস্ত আলো অন্ধকারের ছায়া খেলা তারা খেলছে। কিন্তু সেই উপলব্ধিবোধ সমাজ রাষ্ট্রের জ্যেতিষীরা যেন নিজেরাই দেখতে পায় না। তাই কবিতার শেষ চরণে কবি স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন–
“জ্যেতিষীর হস্তরেখা স্বভাবত অস্পষ্ট হয়।”
দৃশ্যত সম্ভাবনা নেই কবিতায় চিরন্তন এক সত্যের কথা বলেছেন। মৃতলোকের গল্প কবিতায় কবি একটি রূপক অস্পষ্ঠতা রেখেছেন। যা একজন পাঠককে অবশ্যই ভাবিয়ে তুলবে। পরমাকে পরম জেনেছি কবিতায় কবির প্রেমিক সত্তার খোঁজ পাওয়া যায়। কবিতায় সন্ধ্যার বৃষ্টি, প্রেমিকার মুখে গান শোনা, চড়ুই স্বভাবে লেপ্টে থাকা আদুরে মুহূর্ত সবকিছুই যেন আমাদের ছায়াজীবন। যা কবিকে নস্টালজিক করেছে। কিংবা ফুলবউ কবিতায়–
“দেয়ালে সিঁদুরের ফোঁটা
মন্ত্রপড়া বিকেলে জল নিয়ে খেলা করে ফুলবউ
চতুর চড়ুই পাখি
নাচে গায় একলা একলা…
তুলসীতলায় আজ বড় বেশি হাওয়া ”
কি এক তীব্র ব্যাকুলতা! প্রেমের স্বকীয় সত্তা ভালোবাসা তো সময়ের গভীরে আত্মাকে হারিয়ে ফেলা। এভাবেই কবি প্রেমের হুইসেল বাজিয়ে গেছেন। প্রেম এমন এক মানসাবস্থা যেখানে প্রিয় মানুষের জন্য আকুলতা– ব্যাকুলতা তীব্র হয়ে ওঠে।
অসংগতি কবিতায় দেখা যায় কবির সাহসী উচ্চারণ–
“কপালে যা লেখা হবে হোক
বৃষ্টিতে ঘর ছেড়ে পালাবই
দূরে,গির্জার ঢং ঢং বাজবে বাজুক
এক–দুই–তিন–চার–যেতে যেতে যেখানেই ভোর হবে হোক
তখন হয়তো আমি তোমাদের সীমানা ছেড়ে স্পর্শের অতীত…।”
এই সাহসী উচ্চারণ যেন অলীক সত্ত্বা। পাঠকদের হৃদয় মানসপটে আঘাত করে যাবেই।
গোপন সমুদ্রদর্শন কবিতায় কবি পাঠকদের যেন ব্যক্তি জীবনের ব্যক্তিগত প্রতিবিম্ভের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে যায়–
“অনেকদিন ধরে একটা বড়সড় নৌকা কিনবো বলে
অনেক টাকাকড়ি জোগাড় করতে গিয়ে জটিল কর্মজজ্ঞে ব্যাপৃত হয়েছি
পরে দেখলাম এর–ওর এত এত
দাবি মেটাতে গিয়ে আমার যা–তা অবস্থা”
কবিতাটি পড়তে পড়তে পাঠক অবচেতন মনে থমকে যাবে। মনে হবে দৃশ্যমান বাস্তব পাঠকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। একটা গোপন ভারী দীর্ঘশ্বাস নেমে আসবে। লাইনগুলোর মধ্য দিয়ে কবি তুলে এনেছেন সাধারণ মানুষের গোপন হাহাকার। যে হাহাকার যাপিত যাপনের ছায়া হয়েই জড়িয়ে থাকে। তবু স্বপ্ন মানুষ মনের মধ্যে লালন করে ফিরে। তাই পরক্ষণে কবি আবার বলছেন–
“সমুদ্রের যে ছবিটা দেয়ালে টাঙানো আছে
কৌতূহল দেখিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই
এবং কেউ দেখে না মতো দ্রুত–সমুদ্রকে দেখে আসি”
কবির মতো সবাই হয়তো এই নিটোল সান্ত্বনাটুকু খোঁজে। গোপন সমুদ্রদর্শন কবিতাটি পড়তে পড়তে পাঠক নিজের অবয়বটুকু যেন নিজের সামনেই দেখতে পাবে। কবির সত্তা যেন এখানে সার্বজনীন সত্তায় প্রতীয়মান হয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থে অন্যান্য কবিতার মধ্যে রয়েছে– যে যখন বলে, ডিমের কুসুম ডিম্বাকৃতির হয় না, এক বিন্দু জল, যাদের স্বভাব চড়ুইয়ের মত,আয়ুর পরিধি,আমি আমাকে জাগিয়ে রাখি, এমন ভিড়ে, বাধ্য হয়ে বলি, তাকে বলি, আর কোন অভিঘাত. দৃশ্যত, পানপাত্র কবে থেকে, বিষপাতা, কুয়াশার পোর্ট্রেট, একদিন পরমার ডাকে, মেলা, আকালের কাল শেষে, মৎসগন্ধি, খিড়কিপথ, ঈশ্বরীর পাঠুনির নায়ে, অবৈষয়িক, তালাশ অথবা তালাশের প্রস্তুতি, অগোপন–গোপন, উপসংহার, অন্ধকারের ভেতর, ব লি হে পাখিরা, ক্যানভাসে ইকারুস, রূপবান মুড়ার সুহৃদ–সঙ্গিনী, প্রবল উত্তাপে তোমাকে ও, মিতালী,ক্লাইম্যাক্র এবং নাম ভূমিকার তাকাও,দেখবে কবিতাগুলো।
কবির কাজ পাঠকদের চৈতন্যকে উদ্দীপ্ত করা, পাঠকদের চিত্তকে আশ্লিষ্ট করা। এইসব মহিমার উপস্থিতি কবি মোজাম্মেল মাহমুদের তাকাও, দেখবে কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় যা ব্যাপক এবং গভীর। কবির কবিতাগুলো নির্মেদ,অপেক্ষাকৃত নিরাভরণ। পাঠকদের কবিতাপাঠের আনন্দ ছুঁয়ে যাবে পরিপূর্ণভাবে। কাব্যের মধ্যে আনন্দ আর প্রমোদের যত রকম সুর আছে এই কাব্যগ্রন্থে কবি শব্দের বীনায় তা তুলে আনার সুনিপুণ দক্ষতার প্রয়াস দেখিয়েছেন। তাকাও, দেখবে কাব্যগ্রন্থ পাঠে পাঠক খুঁজে পাবে শব্দ সুরের অসংখ্য বৈচিত্র্য যার ইঙ্গিত ছিলো ধ্রুবের দিকে। যাপিত জীবনের সুখের স্মৃতিচারণ। কিছু প্রশ্ন সংশয় আরো কিছু অবেদ্য প্রশ্নবাণে কবির সবাক পদচারণা ছিলো সাবলীল ঢঙ্গে। যা পাঠকদের মনের স্বচ্ছ উপলব্ধিবোধে স্পর্শ করবে। তাকাও, দেখবে কাব্যগ্রন্থটি পড়তে পড়তে মনে হতে পাওে ‘আরে! এ–তো আমারই কথা!’