পাপের সাগরে ডুবে থেকে মাঝে মধ্যে মানুষ ভুলেই যায় যে একদিন তাকে আল্লাহতায়ালার সামনে দাঁড়াতে হবে। স্বীকার করতে হবে জীবনের সব কৃতকর্ম। বান্দা যখন আল্লাহর দ্বারস্থ হয় তখন তিনি ক্ষমা ও দয়ার কুদরতি হাত প্রসারিত করেন। বান্দা ইস্তিগফার করলে আল্লাহ আজাব দেন না। আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল। তিনি বান্দাকে ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। ক্ষমা করার নানা অজুহাত খোঁজেন। গুনাহের একমাত্র প্রতিকার হচ্ছে তাওবা ও ইস্তেগফার। মানুষ যত গুনাহই করুক না কেন সঠিক পন্থায় তাওবা করলে আল্লাহতাআলা তার সব গুনাহই মাফ করবেন। তাওবা ও ইস্তেগফার দ্বারা পেরেশানি দূর হয় বিপদ থেকে মুক্ত লাভ হয় এবং রিযিক বৃদ্ধি পায়।
ছগিরা গুনাহ বা ছোট পাপ হলো : যেসব আদেশ নিষেধের লঙ্ঘনে বিশেষ নির্দিষ্ট শাস্তির কথা উল্লেখ হয়নি। এই সব কাজ মাকরুহ বা অপছন্দনীয়। ছগিরা গুনাহ যে কোনো নেক আমল দ্বারা মাফ হয়ে যায়। এর জন্য বিচারে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না। কোরআনে পাকে আল্লাহতাআলা বলেন তোমাদিগকে যা নিষেধ করা হয়েছে তার মধ্যে যা গুরুতর তা থেকে বিরত থাকলে তোমাদের লঘুতর পাপগুলো (ছগিরা গুনাহসমূহ) মোচন করব এবং তোমাদিগকে সম্মানজনক স্থানে দাখিল করব। (সুরা–৪ নিসা : আয়াত : ৩১)।
কবিরা গুনাহ বা বড় অপরাধ হলো : সে সব আদেশ নিষেধের লঙ্ঘনে জাহান্নাম, আগুনের শাস্তি বা নির্দিষ্ট আজাবের সাবধানবাণী রয়েছে। এই সব কাজ হারাম। কবিরা গুনাহ তওবাহ দ্বারা ক্ষমা পাওয়া যায়। কবিরা গুনাহের শাস্তির বিষয়ে পবিত্র কোরআনে যেসব স্থানে জাহান্নামে ‘চিরস্থায়ীভাবে’ থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে সেগুলোর বিপরীত বিবরণও কোরআন সুন্নাহতে বিদ্যমান থাকায় মুজতাহিদগণ বলেছেন ‘চিরস্থায়ীভাবে’ অর্থ হবে দীর্ঘকাল; অনন্তকাল নয়। কোরআন ও হাদিসে এমন কিছু আমলের কথা বর্ণিত হয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে মানুষের অনেক গুনাহ মাফ হয়ে যায়। গুনাহ মাফের কিছু আমল তুলে ধরা হলো–
বেশি বেশি তওবা করা: হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে এই দোয়া ইখলাছের সঙ্গে পাঠ করলে সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ গুনাহ থাকলেও তা মাফ হয়ে যাবে। আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়ুল কাইয়ুমু ওয়া আতুবু ইলাইহি। অর্থাৎ, আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই তিনি ব্যতীত কোনো মাবুদ নাই তিনি চিরঞ্জীব ও চিরন্তন এবং আমি তাঁর কাছে ফিরে আসি।
নেক আমল করা : নেক আমল মুমিনের সর্বোত্তম সম্পদ। আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) এর নির্দেশিত পথে চলার মাধ্যমেই মানুষ নেক আমল ও সওয়াব অর্জন করে। মুমিনের জীবনে নেক আমলের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন নিশ্চয়ই নেক আমলকারীরা থাকবে সুখ–স্বাচ্ছন্দ্যে। আর বদ আমলকারীরা থাকবে জাহান্নামে। (সুরা ইনফিতার : ১৩–১৪)। দৈনন্দিন কিছু নেক কাজের মাধ্যমে সগিরা গুনাহ থেকে মাফ পাওয়া যায়। কিন্তু কবিরা গুনাহ থেকে ক্ষমা পাওয়ার জন্য অবশ্যই তওবা করতে হবে। নেক কাজ নানাভাবে করা যেতে পারে। মানুষকে সালাম দেওয়া, দান–সদকা করা, অন্যকে সহযোগিতা করা এবং সর্বদা সত্য কথা বলার মাধ্যমে আমরা নেক কাজ করতে পারি।
শিরকমুক্ত আমল করা : শিরকের অর্থ হলো আল্লাহর সঙ্গে সত্তা, গুণ ও ইবাদতে অন্য কাউকে শরিক বা অংশীদার করা। শিরক মারাত্মক কবিরা গুনাহ। এটি করার পর আমলনামায় আর কোনো সওয়াব অবশিষ্ট থাকে না। শিরক করার সঙ্গে সঙ্গে আমলনামায় আগে যে সওয়াব ছিল সে সওয়াবগুলো মুহূর্তেই বরবাদ হয়ে যায়। শিরককারীদের কোনো আমল গ্রহণ করা হবে না। আল্লাহতায়ালা বলেছেন আর তারা যদি শিরক করত তাহলে তারা যা আমল করেছিল তা অবশ্যই বরবাদ হয়ে যেত। (সুরা আনআম : ৮৮)
সৃষ্টিজগতের প্রতি সদয় হওয়া: সৃষ্টিজগতের প্রতি সদয় আচরণ করার দ্বারাও গুনাহ মাফ হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, একজন লোক রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে তার ভীষণ পিপাসা লাগল। সে কূপে নেমে পানি পান করল। এরপর সে বের হয়ে দেখতে পেল যে একটি কুকুর হাঁপাচ্ছে এবং পিপাসায় কাতর হয়ে মাটি চাটছে। সে ভাবল কুকুরটারও তার মতো পিপাসা লেগেছে। সে কূপের মধ্যে নামল এবং নিজের মোজা ভরে পানি নিয়ে মুখ দিয়ে সেটি ধরে ওপরে উঠে এসে কুকুরটিকে পানি পান করাল। এতে আল্লাহতায়ালা তার আমল কবুল করেন এবং তার গুনাহ মাফ করে দেন। রাসুল (সা.) বলেন প্রত্যেক প্রাণীর উপকার করাতেই নেকি আছে।
ঈমান আনা এবং সৎকর্ম করা: ঈমান আনা এবং সৎকাজ করা ছাড়া প্রকৃত মুসলিম হওয়া যায় না। ঈমান ও সৎকাজ একটি অপরটির পরিপূরক। ঈমান ছাড়া সৎকাজ যেমন মূল্যহীন সৎকাজ ছাড়া ঈমানও তেমনি প্রাণহীন। আর যারা এই দুটি কাজ করতে পারে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতসহ অসংখ্য পুরস্কার। এর মধ্যে অন্যতম পুরস্কার হচ্ছে গুনাহ মাফ হওয়া। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন আর যারা ঈমান আনে সৎকাজ করে অবশ্যই আমি তাদের পাপসমূহ মার্জনা করে দেব এবং অবশ্যই তাদের উত্তম আমলের প্রতিদান দেব যা তারা করত। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন আর যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে এবং সৎকাজ করবে তিনি তার সমস্ত পাপ মোচন করে দেবেন এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশ দিয়ে ঝরনাধারা প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। এটিই তো মহাসাফল্য। (সুরা তাগাবুন : ৯)
আল্লাহভীতি অবলম্বন করা : আল্লাহর ভয়ে নিষিদ্ধ বস্ত থেকে দূরে থাকা বা যে কাজ করার কারণে মানুষকে আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন হতে হয় তা থেকে নিজেকে রক্ষা করা হচ্ছে আল্লাহভীতি। গুনাহ থেকে বাঁচার সর্বোত্তম উপায় হলো আল্লাহতায়ালার ভয়। আল্লাহভীতি মুমিন জীবনের মূলভিত্তি। মহান আল্লাহ যেমন ক্ষমাশীল তেমনি কঠোর শাস্তিদাতা। তাই অন্তরে সর্বদা আল্লাহর ভয় ধারণ করতে হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন হে ঈমানদানরা! তোমরা আল্লাহকে যথাযথ ভয় করো। আর মুসলমান না হয়ে কেউ মৃত্যুবরণ করো না। (সুরা আলে ইমরান: ১০২) এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে আল্লাহকে যথার্থরূপে ভয় করতে হবে।
বিপদাপদে গুনাহ মাফ হয় : বিপদাপদ মানবজীবনের অপরিহার্য অংশ। একজন মুমিন যে কোনো বিপদে আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে ধৈর্য ধারণ করে। তাই একজন মুমিনের ওপর আপতিত বিপদসমূহ তার জন্য কল্যাণই বয়ে আনে। এতে করে তার গুনাহসমূহ দূর হয়ে যায়। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন কোনো মুসলিমের ওপর কোনো যন্ত্রণা, রোগ–ব্যাধি বা এ ধরনের কোনো বিপদ আপতিত হলে এর দ্বারা আল্লাহ তার গুনাহগুলোকে ঝরিয়ে দেন যেভাবে গাছ তার পাতাগুলো ঝরিয়ে ফেলে। মুমিন কখনো বিপদে পড়লে তাতে সে যে কষ্ট অনুভব করে তার জন্য তার কিছু গুনাহ মাফ করা হয়। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন কোনো মুসলিম ব্যক্তি মানসিক বা শারীরিক কষ্ট পেলে কোনো শোক বা দুঃখ পেলে অথবা চিন্তাগ্রস্ত হলে সে যদি ধৈর্যধারণ করে তাহলে আল্লাহ তার সব গুনাহ মাফ করে দেন।
নবীজী (সা.) বলেন সব মানুষই অপরাধী তাদের মধ্যে উত্তম হলো তওবাকারী। ক্ষমাপ্রার্থনার জন্য শ্রেষ্ঠ দোয়াটিকে সায়িদুল ইস্তিগফার অর্থাৎ প্রধান বা শ্রেষ্ঠ ক্ষমার আবেদন বলা হয়। আল্লাহুম্মা আনতা রব্বি লা ইলা–হা ইল্লা আনতা খালাক্বতানি ওয়া আনা আবদুকা ওয়া আনা আলা আহদিকা ওয়া ওয়াদিকা মাসতাত্বাতু আউজুবিকা মিন শাররি মা ছানাতু। আবুউ লাকা বিনিমাতিকা আলাইয়া ওয়া আবুউ বিজাম্বি ফাগফিরলি ফাইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজজুনুবা ইল্লা আনতা। ইস্তিগফার আল্লাহতায়ালার মাগফিরাত অর্জন করে জান্নাতে যাওয়ার একমাত্র উপায়। অতএব আপনি আমাকে ক্ষমা করুন ; গুনাহ মাফ করার ক্ষমতা আপনি ছাড়া আর কারও নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন যে ব্যক্তি দিনে এই ইস্তিগফার পাঠ করবেন সন্ধ্যার আগে তাঁর মৃত্যু হলে তিনি জান্নাতি ; যে ব্যক্তি রাতে এই ইস্তিগফার পাঠ করবেন সকালের আগে তাঁর মৃত্যু হলে তিনি জান্নাতি। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে বেশি বেশি তওবা করার তওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।