তমদ্দুন মজলিস ও ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী

ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী | সোমবার , ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৮:২৯ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

() ছাত্রীদের মিছিলে অন্তর্ভুক্তকরণ: ১৯৫২এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় যখন গুলি চালানো হয়, তার প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামে পরের দিন যে মিছিল ও বিক্ষোভসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় তাতে চট্টগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা ছিল বদিউল আলম চৌধুরীর। তিনি ডা. খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে ছাত্রীদের মিছিলে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন। এ বিষয়টি জানা যায় বিশিষ্টজনদের বিভিন্ন লেখা পর্যালোচনায় [সূত্র: ‘কথামুখ, মুহাম্মদ নিযামুদ্দিন সম্পাদিত বদিউল আলম চৌধুরী স্মারক সংকলন, বদিউল আলম চৌধুরী মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, ২০১৪]। উল্লেখ্য, এক প্রবন্ধ পর্যালোচনায় চট্টগ্রামের প্রথমবারের মত স্কুলকলেজের ছাত্রীদের ট্রাকে চড়ে মিছিল করে শহর প্রদক্ষিণ করার বিষয়টি জানা যায়, …সেদিন বিকেলেই (মতান্তরে পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি) ঢাকায় হতাহতের খবর চট্টগ্রামে পৌঁছে যায়। উত্তাল হয়ে ওঠে সমগ্র চট্টগ্রাম। শত শত ছাত্রতরুণসহ অসংখ্য জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে রাস্তায় নেমে আসে। সংগ্রাম পরিষদের আহ্‌বায়কের অনুপস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন যুগ্ম আহ্‌বায়ক আজিজুর রহমান ইঞ্জিনিয়ার। লালদীঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদ সভা ও বিশাল প্রতিবাদী মিছিল। একনাগাড়ে হরতাল ধর্মঘটের মত কর্মসূচি পালিত হয় চট্টগ্রামে। ……মিছিলে শরীক হন চট্টগ্রামের স্কুলকলেজের ছাত্রীরা। এই প্রথমবারের মত ছাত্রীরা ট্রাকে চড়ে মিছিল করে শহর প্রদক্ষিণ করে। ভাষা আন্দোলনের ঢেউ শহর ছাড়িয়ে সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, সাতকানিয়া, পটিয়া, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন থানা ও গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।……তমদ্দুন মজলিস ও প্রগতিশীল ছাত্রযুবকর্মীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মীর উপস্থিতি ও সক্রিয় অংশগ্রহণে ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে” [সূত্র : ‘তাহারেই মনে পড়ে, আহমেদ মমতাজ, বদিউল আলম চৌধুরী স্মারক সংকলন ২০১৪]

() চট্টগ্রাম কলেজে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে সম্পৃক্ততা: বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ট্রাজেডির পর চট্টগ্রাম কলেজে প্রথম যে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয় তার সাথে ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন [সূত্রঃ দৈনিক আজাদী, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ তারিখের একুশের বিশেষ সংখ্যা]। এ বিষয়টি ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী তাঁর সাক্ষাৎকারেও উল্লেখ করেনপ্রথমে আমরা চট্টগ্রাম কলেজে শহীদ মিনার গড়ে তুলি। শহীদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে শহীদ মিনারে ফাতেহা পাঠ করা হতো” [সূত্র: () ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরীর সাক্ষাৎকার– ‘স্মৃতিচারণ (একুশের সৈনিক), মাসিক চাটগাঁ ডাইজেস্ট, ৬ষ্ঠ বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ২০০০ এবং () এম আর মাহবুব সম্পাদিত ‘ভাষা সংগ্রামের স্মৃতি, ভাষা আন্দোলনের গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘর, ২০১৬]

(১০) হুলিয়া মাথায় নিয়ে ভাষার দাবী আদায়ে অবিচল সংগ্রামে অংশগ্রহণ: বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক ও কলামিস্ট সাখাওয়াত হোসেন মজনু তাঁর এক বক্তব্যে বলেনভাষা আন্দোলনে বদিউল আলম চৌধুরী অসামান্য অবদান রেখেছেন। হুলিয়া মাথায় নিয়ে তিনি ভাষার দাবী আদায়ে অবিচল সংগ্রাম চালিয়েছেন” [সূত্র : ‘ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী ক্ষমতার মোহে রাজনীতি করেননি, দৈনিক আজাদী, ১১ অক্টোবর ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ]। তিনি তাঁর ‘সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকিপ্রবন্ধে বলেন– “……ভাষা সংগ্রামের একজন ত্যাগী কর্মী ছিলেন কাট্টলী নাজির বাড়ীর সন্তান বদিউল আলম চৌধুরী। সে সময় তিনি ছিলেন ছাত্র। বয়স তো খুব বেশি ছিলোনা। তবে রাজপথে ছিলেন কঠিন ব্রত নিয়ে” [সূত্র: ‘সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি, সাখাওয়াত হোসেন মজনু, দৈনিক আজাদী, ১০ অক্টোবর ২০১৬]

চট্টগ্রাম অঞ্চলে বদিউল আলম চৌধুরী এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের নাম। ভাষার প্রতি, দেশের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসার জন্যে ভাষা আন্দোলন হতে শুরু করে একাত্তরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের প্রতিটি আন্দোলনে বদিউল আলম চৌধুরী সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। ভাষার প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা ও দেশপ্রেম পরিস্ফুট হয়ে ওঠে ফেব্রুয়ারি/১৯৭০ মাসে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে লেখা এক দিনলিপিতে তাঁর ব্যক্ত অনুভুতিতে, “…১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্ত স্বাক্ষরে লেখা দিন, যা বহু বিশেষণ দিয়েও মূল্যায়ন করা সম্ভবপর নয়। এই দিনকে বলা যায় একটি ভাষার মানুষের ইতিহাসে চিরন্তন আলোকস্তম্ভ, যে আলোকস্তম্ভ সে ভাষার মানুষদের ইতিহাসের গতি নির্ধারণ করবে চিরদিনের জন্যে। এই দিন সে দেশের সাহিত্য, শিল্প, সমাজ চেতনা, রাজনীতি এবং জীবনের সকল প্রকার বোধ ও পদ্ধতির সামনে চিরসবুজ অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। এই দিন বাংলাভাষীদের জীবন ও ইতিহাসে সাহস ও সচেতনতার পটভূমি হয়ে থাকবে আবহমানযে পটভূমি কখনো মলিন হবেনা, বিপর্যস্ত হবে না, চোখের সামনে থেকে সরে যাবে না। ১৯৫২ সালের পর এদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক, সাহিত্য ও শিল্প, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের দিকে চোখ রাখলেই উপলব্ধি করা যায়। অপরিসীম পরিবর্তনের প্রভাব এই দিনের। এই দিন কেবল মায়ের ভাষা বাংলাকে চিরদিনের জন্যে যে কোন প্রকার অশুভ ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করার একটি অজেয় প্রাচীর সৃষ্টি করেনি, এই দিন মাটি, মা ও মায়ের ভাষাকে এক নতুন দৃষ্টিকোণে ও উপলব্ধির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেছে। এই দিন বাংলা ভাষীদের মনে চিরদিনের জন্যে একটি ক্ষতচিহ্ন, সেখানে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ পড়লেই বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাবে, এই দিন ভাই হারানোর অনন্ত দুঃখের দিন, এই দিন বাংলা ভাষার ইতিহাসে সবচেয়ে পবিত্র দিন, একটি দিন সব দিন চিরদিন” [সূত্র: ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরীর ‘উল্লেখযোগ্য দিনলিপি, বদিউল আলম চৌধুরী স্মারক সংকলন ২০১৪]। দৈনিক পূর্বকোণে ১৫ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে ‘ভাষা শিক্ষা সমাজসেবায় বদিউল আলম চৌধুরীর অবদান স্মরণীয়শীর্ষক প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভাষা, শিক্ষা ও সমাজসেবায় ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী যে অবদান রেখে গেছেন তা ইতিহাসে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তমদ্দুন মজলিসের মাধ্যমে সম্মুখভাগে থেকে তিনি ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে ইতিহাসে একজন ক্ষণজন্মা কৃতিপুরুষ হিসেবে অমর হয়ে আছেন। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে”।

লেখক: মরহুমের কন্যা, সরকারি কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখুরশীদ আনোয়ারের সংগীত গ্রন্থ ‘গানের সিন্দুক’
পরবর্তী নিবন্ধবেবি-বুমার প্রজন্ম :‘ফিফটি ফাইভস্‌’ দ্য প্রবলেম জেন