বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা‘ প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার মর্যাদা ও অধিকারের দাবীতে একটি ধারাবাহিক রক্তাক্ত লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন–সার্বভৌম বাংলাদেশ। সেই রক্তাক্ত লড়াইয়ের ভিত রচনা করেছে ভাষা আন্দোলন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। এ ঐতিহাসিক ও বৈপ্লবিক অধ্যায়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে বিপ্লবী সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমদ্দুন মজলিস‘ এর নাম। উল্লেখ্য শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা লালন–পালন ও সংরক্ষণ যাতে যথাযথভাবে পরিচালিত হয় সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েই গঠিত হয় এই সংগঠন। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব প্রদানকারী সংগঠন– ‘তমদ্দুন মজলিস’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে ৩ (তিন) সদস্য বিশিষ্ট ‘তমদ্দুন মজলিস‘ ১৯৪৭ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর ভাষা আন্দোলনের গোড়াপত্তন করে এবং ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ ও অধ্যাপক আবুল কাশেমের তিনটি প্রবন্ধ নিয়ে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা– না উর্দু‘ শীর্ষক প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আহ্বান জানানো হয়। তখন থেকেই সাংগঠনিক ও আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয়। আর এ কারণেই ‘তমদ্দুন মজলিস‘ ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন হিসেবে সর্বজনবিদিত। উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে তমদ্দুন মজলিস এর ‘আট দফা দাবি, নিয়ে সর্বপ্রথম গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।‘ পরবর্তীতে এই সংগঠনের সাথে অন্যান্য ছাত্র সংগঠন মিলে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।‘ ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে তমদ্দুন মজলিস আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সংগঠনটির ঢাকা কেন্দ্র ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা থেকে তাৎক্ষণিকভাবে একটি বিবৃতি প্রচার করা হয়। উল্লেখ্য, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণে শহীদদের মধ্যে শহীদ আবুল বরকত ছিলেন তমদ্দুন মজলিসের অন্যতম সদস্য এবং প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে তমদ্দুন মজলিস ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রদের অবদান অনস্বীকার্য [সূত্র : মোঃ রফিক ভূঁইয়া খোকা, তমদ্দুন মজলিসকর্মী]। ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী এই তমদ্দুন মজলিসের মাধ্যমেই ভাষা আন্দোলনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। তমদ্দুন মজলিসের সাথে ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরীর সম্পৃক্ততা ও ভাষা আন্দোলনে তাঁর সরাসরি অবদানের কিছু বিষয় নিচে উপস্থাপন করা হলো :
(১) ‘তমদ্দুন মজলিস‘ এর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ততা: ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারী সংগঠন– ‘তমদ্দুন মজলিস‘ এর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী তমদ্দুন মজলিসের একজন নিষ্ঠাবান কর্মী হিসেবে নিজেকে সম্পৃক্ত করে রাষ্ট্রভাষার দাবীতে সোচ্চার হন। ‘তমদ্দুন মজলিস‘ এর সাথে তাঁর সরাসরি সম্পৃক্ততার বিষয়ে তিনি বিভিন্ন সময়ে তাঁর সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন [সূত্র : (১) ‘ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম: ৪৮–৫৪, সিরাজুল করিম মানিক, মাসিক চাটগাঁ ডাইজেস্ট, ৫ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ১৯৯৯; (২) ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরীর সাক্ষাৎকার– ‘স্মৃতিচারণ (একুশের সৈনিক), মাসিক চাটগাঁ ডাইজেস্ট, ৬ষ্ঠ বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ২০০০; (৩) ‘চাটগাঁর আজিজ, আহমদ মমতাজ, দৈনিক আজাদী, ২২ জুলাই ২০১১; (৪) এম আর মাহবুব সম্পাদিত ‘ভাষা সংগ্রামের স্মৃতি, ভাষা আন্দোলনের গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘর, ২০১৬]। উল্লেখ্য, ‘তমদ্দুন মজলিস’ এর শুরু হতে ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরীর সম্পৃক্ততার বিষয়টি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণাকেন্দ্র থেকে প্রকাশিত ও মুক্তিযুদ্ধ ই–আর্কাইভে সংরক্ষিত বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ডাঃ মাহফুজুর রহমান এর ‘বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম (১৯৯৩)’ গ্রন্থটি পর্যালোচনায়ও পাওয়া যায়। এ গ্রন্থের ‘চট্টগ্রাম পর্ব’ অধ্যায়ের ‘৪৭ পরবর্তী চট্টগ্রামের সংগঠন চিত্র‘ অংশের ২৪৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত ‘তমদ্দুন মজলিস‘ অনুচ্ছেদের ৫ম লাইনে ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরীর নাম রয়েছে।
(২) তমদ্দুন মজলিস কর্তৃক আয়োজিত কেন্দ্রীয় ক্যাম্পে যোগদান ও ভাষা আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ততা: ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের কৈবল্যধাম পাহাড়ে তমদ্দুন মজলিস কর্তৃক আয়োজিত তিন দিনব্যাপী কেন্দ্রিয় ক্যাম্পে যোগদানের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনে তিনি সরাসরি নিজেকে সম্পৃক্ত করেন [সূত্র: (১) ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরীর সাক্ষাৎকার– ‘স্মৃতিচারণ একুশে ফেব্রুয়ারি– ১৯৫২, মাসিক চাটগাঁ ডাইজেস্ট, ৬ষ্ঠ বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ২০০০ এবং (২) এম আর মাহবুব সম্পাদিত ‘ভাষা সংগ্রামের স্মৃতি, ভাষা আন্দোলনের গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘর, ২০১৬]। উল্লেখ্য, বদিউল আলম চৌধুরীর তমদ্দুন মজলিস কর্তৃক আয়োজিত বর্ণিত ক্যাম্পে যোগদানের বিষয়টি প্রবীণ ভাষাসৈনিক, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল গফুরের স্মৃতিচারণে উঠে আসে– -“ঊনিশ শ‘ আটচল্লিশ কি ঊনপঞ্চাশ সালের কথা। তমদ্দুন মজলিসের প্রথম শিক্ষা ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম শহরের কাট্টলীর কাছে কৈবল্যধামে। সে ক্যাম্পে সে যোগ দিয়েছিল। ছোট খাট উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের কিশোর …..অবাক বিস্ময়ে দেখছিল আমাদের কর্মকাণ্ড। আর অধিকাংশ সময় চুপচাপ বসে শুনছিল আমাদের আলোচনা। মাঝে মাঝে এটা–ওটা প্রশ্নও করছিল আলোচ্য বিভিন্ন বিষয়ে। সেই শুরু। এরপর এক পর্যায়ে তমদ্দুন মজলিশের নিবেদিত প্রাণ কর্মী হয়ে ওঠে। চট্টগ্রামে তমদ্দুন মজলিশের নেতৃস্থানীয় কর্মীদের অন্যতম হয়ে ওঠে কাট্টলীর সেদিনের কিশোর বদিউল আলম চৌধুরী। …….বদিউল আলম চৌধুরীর কথা উঠলেই মনে পড়ে তমদ্দুন মজলিসের সেই প্রথম ক্যাম্পের কথা, যে ক্যাম্পে তাকে প্রথম দেখেছিলাম। তখন মজলিসের শিক্ষা ক্যাম্পের নাম ছিল তাঁবু জীবন (টেন্টলাইফ)। আর টিমের সাথে ঠিক রেখে ক্যাম্পের জন্যে ব্যবস্থা থাকতো একাধিক তাঁবুর” [সূত্র: ‘স্মৃতির দর্পণে বদিউল আলম চৌধুরী, অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল গফুর, মুহাম্মদ নিযামুদ্দিন সম্পাদিত বদিউল আলম চৌধুরী স্মারক সংকলন, বদিউল আলম চৌধুরী মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, ২০১৪]। এই ক্যাম্পগুলোতে বদিউল আলম চৌধুরীর উজ্জ্বল উপস্থিতির কথা স্মৃতিচারণে তুলে ধরেন ভাষাসৈনিক অধ্যাপক চৌধুরী শাহাবুদ্দিন আহমেদ খালেদ [সূত্র : (১) শাহেদ আলী স্মারক গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৮১, ২০০২ এবং (২) ‘বদিউল আলম চৌধুরী :দেশ দরদের দৃষ্টান্ত, মুহাম্মদ নিযামুদ্দিন, দৈনিক আজাদী, ১০ অক্টোবর ২০১৫]। ক্যাম্পে যোগদানের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনে ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী সরাসরি সম্পৃক্ততার বিষয়ে তিনি তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারেও উল্লেখ করেন [সূত্র: (১) ‘ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রামঃ ৪৮–৫৪, সিরাজুল করিম মানিক, মাসিক চাটগাঁ ডাইজেস্ট, পৃষ্ঠা ১০, ৫ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ১৯৯৯; (২) ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরীর সাক্ষাৎকার– ‘স্মৃতিচারণ (একুশের সৈনিক)’, মাসিক চাটগাঁ ডাইজেস্ট, পৃষ্ঠা ৮, ৬ষ্ঠ বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ২০০০; (৩) ‘চাটগাঁর আজিজ, আহমদ মমতাজ, দৈনিক আজাদী, ২২ জুলাই ২০১১; (৪) এম আর মাহবুব সম্পাদিত ‘ভাষা সংগ্রামের স্মৃতি’ পৃষ্ঠা ২৫১–২৫৩, ভাষা আন্দোলনের গবেষনা কেন্দ্র ও জাদুঘর, ২০১৬]
(৩) তমদ্দুন মজলিসের উঠতি ছাত্রনেতা: ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী ছিলেন বাংলা ভাষা আন্দোলনের চট্টগ্রামের প্রধান সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের উঠতি ছাত্রনেতা [সূত্র: দৈনিক আজাদী, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ তারিখের একুশের বিশেষ সংখ্যা (পৃষ্ঠা–৭)]। উল্লেখ্য, এ বিষয়টি ভাষাসৈনিক, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল গফুরের স্মৃতিচারণে উঠে আসে-“… এক পর্যায়ে তমদ্দুন মজলিশের নিবেদিত প্রাণ কর্মী হয়ে ওঠে। চট্টগ্রামে তমদ্দুন মজলিশের নেতৃস্থানীয় কর্মীদের অন্যতম হয়ে ওঠে কাট্টলীর সেদিনের কিশোর বদিউল আলম চৌধুরী ” [সূত্র: ‘স্মৃতির দর্পণে বদিউল আলম চৌধুরী, অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল গফুর, বদিউল আলম চৌধুরী স্মারক সংকলন ২০১৪]। এ সংক্রান্তে উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় এক স্মৃতিচারণেও। উক্ত স্মৃতিচারণে ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরীর ছাত্র অবস্থায় ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ সংক্রান্তে তথ্য পাওয়া যায়, “বদিউল আলম চৌধুরীর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ১৯৫১ সালে। আমি তখন চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুলের ছাত্র। আর বদিউল আলম চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র। ……পাকিস্তান ছাত্রশক্তি (তমদ্দুন মজলিসের ছাত্রফ্রন্ট) ও পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের সাথে আমরা দুজনেই সম্পৃক্ত ছিলাম। ভাষা আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আমরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলাম।……মরহুম চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের ভাষা আন্দোলনের একজন অন্যতম সৈনিক। ভাষা আন্দোলনের রূপকার প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের সাথে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের সুযোগ আমাদের দুজনেরই রয়েছে” [সূত্র: ‘একে একে নিভেছে দেউটি‘, মুহাম্মদ নূরউল্লাহ, বদিউল আলম চৌধুরী স্মারক সংকলন ২০১৪] (চলবে)
লেখক: মরহুমের কন্যা, সরকারি কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক।