পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়ন (রি-অ্যাসেসমেন্ট) কার্যক্রম শুরুর জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে ‘অনলাইন ভিত্তিক অটোমেশন পদ্ধতি চালুর’ শর্ত দিয়েছিল স্থানীয় সরকার বিভাগ। সাড়ে তিন বছর আগের সেই শর্ত এখনো পূরণ করতে পারেনি চসিক। এরপরও রি-অ্যাসেসমেন্ট কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে দুই দফা পত্র দিয়ে অনুমতিও চেয়েছে। তবে কোনো পত্রেই অটোমেশন কর্যক্রম সম্পন্ন না হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে নি। ফলে প্রশ্ন ওঠেছে তথ্য গোপন করেই রি-অ্যাসেসমেন্ট কার্যক্রম শুরু করতে চায় চসিক ?
অবশ্য চসিকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, অটোমেশন কার্যক্রম চলমান আছে।
এ বিষয়ে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক দৈনিক আজাদীকে বলেন, অটোমেশন কার্যক্রমের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী দুই মাসের মধ্যেই অনলাইনে পৌরকর আদায় করা যাবে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৬ নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা জরুরি বৈঠক করেন। বৈঠকে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তারা অংশ নেন। ওই বৈঠকে চসিকের রি-অ্যাসেসমেন্ট নিয়ে ওই সময় সাধারণ মানুষের আপত্তি ও বিক্ষোভ নিয়ে আলোচনা হয়। পরবর্তীতে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, সারা দেশের পৌরকর কার্যক্রমকে অটোমেশনের আওতায় আনা হবে। অটোমেশন কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত যে এসেসমেন্ট করা হয়েছে তা স্থগিত রাখা হবে।
এরপর একই বছরের ১০ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগের তৎকালীন উপসচিব মো. আবুল ফজল মীর চসিকে চিঠি দেন। এতে বলা হয়, ‘সিটি কর্পোরেশনের গৃহকর পুনর্মূল্যায়নের বিষয়টি সরকারের গোচরীভূত হয়েছে। ইতোমধ্যে সম্পন্ন পুনর্মূল্যায়ন (রি-এসেসমেন্ট) এর বিপরীতে বিপুল পরিমাণ আপিল দাখিল হয়েছে। বেশিরভাগ অভিযোগ বা আপিলই মূলত পুনর্মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট। পুনর্মূল্যায়ন প্রথাগত ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে অনুসরণ করার কারণেই এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।’
ওইপত্রে ‘সিটি কর্পোরেশনের গৃহকরের পুনর্মূল্যায়ন স্থগিত রাখার নির্দেশনা’ দেয়া হয়। একইসঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে অন-লাইন ভিত্তিক অটোমেশন পদ্ধতি চালু করে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ এর ধারা-৮২ অনুযায়ী সরকারের অনুমোদন নিয়ে গৃহকর পুর্নমূল্যায়ন কার্যক্রমর শুরু করতে বলা হয়েছে’।
এদিকে চসিক সূত্রে জানা গেছে, ‘আর্বান পাবলিক এনভায়রনমেন্টাল হেলথ সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ এর আওতায় চট্টগ্রাম, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেটে হোল্ডিং ট্যাক্স, রেইট নির্ধারণ ও আদায় কার্যক্রম অটোমেশন এর মাধ্যমে সম্পন্ন করার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল। প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবে চসিকের পৌরকর কার্যক্রম অটোমেশনে আসেনি। সর্বশেষ ‘এটিএন এন্ড আর কে’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে চসিক এক বছরের চুক্তি করে। প্রতিষ্ঠানটি অনলাইন ভিত্তিক পৌরকর আদায়ে ভবন মালিকদের ডাটা এন্ট্রির কাজ করছে। ইতোমধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ডাটা এন্ট্রি সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অর্থাৎ এখনো পৌরকর ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ অটোমেশন হয়নি।
দুই প্রস্তাবেই তথ্য গোপন : রি-অ্যাসেসমেন্ট কার্যক্রমে যে স্থগিতাদেশ ছিল তা প্রত্যাহারে চসিক থেকে মন্ত্রণালয়ে দুই দফা প্রস্তাব পাঠানো হয়। ২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রথম প্রস্তাব এবং গত ৩ জুন দ্বিতীয় প্রস্তাব পাঠানো হয়।
প্রথম প্রস্তাব পাঠান চসিকের তৎকালীন প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। এতে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে স্থগিত হওয়া পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়ন এর আলোকে পৌরকর আদায়ের অনুমতি চাওয়া হয়। তবে সেখানে অটোমেশন কার্যক্রম সমাপ্ত না হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। বরং তিনি লিখেন, ‘২০১৬-২০১৭ সালে চসিক পুনর্মূল্যায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করলেও কর আদায়ের প্রাক্কালে বিভিন্ন মহলের বিরোধিতার কারণে মন্ত্রণালয় গৃহকর কার্যক্রম পুনর্মূল্যায়ন স্থগিত রাখার নির্দেশনা দেয়। তাই সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।’ সুজনের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ২৫ অক্টোবর সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারও করে নেয় মন্ত্রণালয়।
সর্বশেষ গত ৩ জুন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হকের স্বাক্ষরে আরেকটি চিঠি পাঠিয়ে দুটো প্রস্তাব দেয়া হয়। প্রস্তাবগুলো হচ্ছে- ব্যক্তি মালিকানাধীন বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হোল্ডিংয়ের বিপরীতে পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়নের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে কর আদায়। অথবা স্থগিতকৃত পুনর্মূল্যায়ন বাতিল করে নতুন করে এসেসমেন্ট করা। এ চিঠিতেও অটোমেশন কার্যক্রম সমাপ্ত না হওয়ার তথ্যটি গোপন রাখা হয়। এ অবস্থায় তথ্য গোপন রেখে মন্ত্রণালয়ে চসিকের প্রস্তাবনার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন করদাতারা।
প্রসঙ্গত, সিটি কর্পোরেশন অ্যাক্ট ২০০৯ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই চসিক মোট ১৭ শতাংশ পৌরকর আদায় করে থাকে। তার মধ্যে ৭ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স (গৃহকর), ৩ শতাংশ বিদ্যুতায়ন রেইট এবং ৭ শতাংশ আবর্জনা অপসারণ রেইট রয়েছে। দি সিটি কর্পোরেশন ট্যাক্সেশান রুলস অ্যাক্ট ১৯৮৬ এর ২১ ধারা মতে, সিটি এলাকায় প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সকল প্রকার স্থাপনার পরিমাপ ও সংশ্লিষ্ট তথ্য সরেজমিন সংগ্রহ করে পৌরকর নির্ধারণ করা হয়। আইনটির আলোকে ২০১৬ সালে গৃহ ও ভূমির পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়ন করে চসিক। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ২০ মার্চ প্রথম দফায় নগরের ১১টি ওয়ার্ডে অ্যাসেসমেন্ট শুরু করে। একই বছরের ২০ জুন শেষ হয়। দ্বিতীয় দফায় একই বছরের ১৮ অক্টোবর বাকি ৩০টি ওয়ার্ডে অ্যাসেসমেন্ট শুরু করে এবং তা শেষ হয় ২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারি। পুনর্মূল্যায়ন শেষে তা ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়। এতে নগরের ১ লক্ষ ৮৫ হাজার ২৪৮টি হোল্ডিংয়ের বিপরীতে ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে ৮৫১ কোটি ৩০ লাখ ৬৪ হাজার ৫৫৯ টাকা পৌরকর আদায়ের প্রস্তাব করে চসিক। যা পূর্বের অর্থ বছরে ছিল ১০৩ কোটি ৪৪ লাখ ১৮ হাজার ৫৩৭ টাকা।