ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সম্প্রসারণ ও রেল ব্যবস্থা উন্নয়ন সময়ের দাবি

মিঞা মোহাম্মদ জামশেদ উদ্দীন | শনিবার , ১৮ অক্টোবর, ২০২৫ at ৭:২০ পূর্বাহ্ণ

মর্মান্তিক ঘটনা। একেবারে আমাদের নাগালে, সীতাকুণ্ড পৌর সভার মৌলভী পাড়ায় ঘটনাটি ঘটে। গ্রামটির বিপরীতে আমাদের দোয়াজীপাড়া গ্রাম। দুর্ঘটনায় কবলিত মা মাকছুদা খাতুন (৪৮), মেয়ে সানজিদা আক্তার (২৪) প্রাণ হারালো। তারা ২১০২০২৫ শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে এক আত্মীয়ের জানাজা শেষে বাড়িতে ফিরছিলেন। পথে তাদের বাহন (অটোরিক্সা) গ্রামের রেললাইনের ক্রসিং পার হতে গিয়ে এ দুর্ঘটনায় কবলিত হয়। দুর্ঘটনায় অটোরিক্সা চালক এবং নিহতদের অপরাপর আরোহীরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। এসব দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যারা বেঁচে যান তাদের বেলায় সান্ত্বনা স্বরূপ আমরা বলি ভাগ্যক্রমে বা হায়াত আছে বলেই তারা বেঁচে যান; ব্যাস। এই টুকুতেই সান্ত্বনাসহ অন্যান্য কার্যাদি শেষ হয়। অথচ নিহতদের অনাগত ভবিষ্যৎ, সংসারসন্তানসন্ততিসহ অপূরণীয় ক্ষতি হয়।

প্রথমত বলতে হয় মহাসড়ক বা হাইওয়ে সড়কে অটোরিক্সা, ব্যাটারিচালিত রিক্সা, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, রিক্সাসহ তিন ও দুই চাকার যান চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ দুর্ঘটনায় কবলিত অটোটি নিষিদ্ধ হাইওয়ে সড়ক মাড়িয়ে অরক্ষিত রেলক্রসিং অতিক্রম করছিল। যেহেতু ওই রেলক্রসিংয়ে নিরাপত্তাপ্রহরীর নিয়োগ নেই, সেহেতু এটি অরক্ষিত। তাছাড়া রেল লাইনে উপর সর্বদা বলবৎ রয়েছে ১৪৪ ধারা। অর্থাৎ রেল লাইনে জন ও পরিবহন চলাচল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে। এটি বৃটিশ আমলের আইন। এরপরও কোন কিছুকে তোয়াক্কা না করে পরিবহনসহ জন চলাচলসহ রেল লাইনে অযথা ঘোরাফেরা বা অবস্থান করা, এমনকি রাতভর রেল লাইনের ওপর বাজে আড্ডা দেয়ার প্রবণতা হরদম চলে। অনেকে আবার কানে হেডফোন লাগিয়ে মোবাইলে টিপাটিপি করতে দ্বিধাবোধ করে না। এতে করে ক্রমাগত রেল লাইনে দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। এসব দুর্ঘটনায় কবলিতদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যা বেশি।

স্থানীয়ভাবে এক হিসেবে দেখা গেছ, দুর্ঘটনা কবলিত এলাকার মৌলভীপাড়ার এক কিলোমিটারের মধ্যে ৭টি ঝুঁকিপূর্ণ রেলক্রসিং রয়েছে। তারমধ্যে একমাত্র সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেন রেল ক্রসিংয়ে গেটম্যান নিয়োগ রয়েছে। তাও আবার এ বোটানিক্যাল গার্ডেন প্রতিষ্ঠার ২৩ বছরের পর রেল গেট ম্যান নিয়োগ দেয়া হয়। যা কিনা ওই রেল ক্রসিংস্থলে বড় ধরণের একটি দুর্ঘটনা ঘটার পরই। ওই দুর্ঘটনায় একটি দ্রুতগামী ট্রেনের ধাক্কায় একটি মাইক্রোবাস পুরোপুরি দুমড়েমুচড়ে যায়। এতে অন্তত ১১ জন মাইক্রোবাসযাত্রী মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারায়। ১৯৯৮ সালের দিকে সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইকোপার্কের এ রেলক্রসিংস্থলে সংঘটিত এ দুর্ঘটনার আরো কয়েক বছর পর ফকিরহাট রেলক্রসিং এলাকায় অনুরূপ একটি দুর্ঘটনায় তিন গ্রামবাসী প্রাণ হারায়। অথচ ওই রেলক্রসিং এলাকায় এখনও গেটম্যান নেই। তারপর বারইপাড়া, ভূঁইয়া পাড়া, মৌলভীপাড়ার উত্তর ও দক্ষিণে দুটি সহ হাসানগোমস্তা রেলক্রসিংয়ে কোন গেটম্যান নেই। এককথায় বলতে হয় যে হারে যত্রতত্র রেলক্রসিং সৃষ্টি হচ্ছে, যেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করাও দায় হয়ে ওঠেছে। আমাদের সমাজ সংস্কারক ও সমাজ সেবকগণ এসব বিষয়ে মোটেই খেয়াল রাখছেন না; দেখা যায় একদিকে গড়ে উঠছে নতুন নতুন আবাসন। অন্যদিকে এসব জনবসতিতে অতি জরুরি হয়ে পড়ছে জনচলাচল ও পথঘাট ঠিকঠাক করা। এতে কিন্তু বেশ কিছু সমস্যাও সৃষ্টি হচ্ছে। যা পরবর্তিতে রাষ্ট্রকে বহন করতে হয়, অর্থাৎ রক্ষণাবেক্ষণের বিশাল চাপও বাড়ছে।

দ্বিতীয় যে সমস্যাটি হলো নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা অতি জরুরি হয়ে পড়ে। আগে দেখা যেতো আশির দশকে সদর স্টেশন থেকে রেলওয়ে পুলিশ বিশেষ ব্যবস্থায় রেল লাইনে টহল দিতো। সঙ্গে তারা লাইনের ভাঙাচোরা দেখভালসহ রেললাইনে অযাচিত জন চলাচল নজরে রাখতো। প্রয়োজনে এ ধরনের অযাচিত ব্যক্তিদের আটক করে জেলজরিমানাসহ শাস্তির ব্যবস্থা করা হতো। এ ক্ষেত্রে এসব জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হতো। এতে করে জন সচেতনাসহ অপরাধ প্রবণতা কমে আসতো। কিন্তু বিগত অর্ধশতক ধরে রেল প্রশাসনের এ ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। যার ফলে হরহামেশাই রেললাইনে উপর ঘটছে এসব দুর্ঘটনা। এমনকি চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের প্রবণতাও বেড়ে চলেছে। এসব ঘটনায় অসংখ্য যাত্রী আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।

কথা হলো, এখন জনসংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। তাই রেল লাইন ঘেঁষে রাস্তা ও পারাপারে রাস্তাঘাট নির্মাণের হিড়িকও বেড়েছে। এ অবস্থায় যুগের চাহিদা মিটাতে রেল কর্তৃপক্ষকে বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজতে হবে। প্রয়োজনে ঢাকাটু চট্টগ্রামে পাতাল রেল লাইন স্থাপন করা এটি বাস্তবায়নে খণ্ড খণ্ড প্যাকেজ প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্যোগ নিতে হবে।

একই সঙ্গে মহাসড়কে দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে। ৩১০২০২৫ইং রোববার ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশে দ্রুতগামী একটি বাসের ধাক্কায় আব্দুল খালেদ নামে এক সাইকেল আরোহী প্রাণ হারায়। এভাবে আশঙ্কাজন হারে ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। এসব দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হলো, ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কের ১৯২ কিলোমিটার দীর্ঘ ৪ লেন সড়কের ধারণ ক্ষমতা হারাতে বসেছে। সঙ্গে সড়ক ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ ও ট্রাফিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বেড়েছে ফিটনেস বিহীন গাড়ি ও লাইসেন্স বিহীন চালকের সংখ্যাও। তার সাথে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিংসহ নিষিদ্ধ তিন ও টু হুইলার গাড়ি চলাচল। এসব কারণে মহাসড়কে প্রাণহানি ঘটনার পাশাপাশি তীব্র যানজট দেখা দেয়। ইদানীং রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে একাধিক দুর্ঘটনাও ঘটে চলছে। সীতাকুণ্ডে টেরিয়াল এলাকায় এক ছাত্র রাস্তা পার হতে গিয়ে প্রাণ হারায়। অথচ ওইস্থলে রাস্তা পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। এখন যা দেখা যাচ্ছে ফুটওভার ব্রিজে সাধারণ পথচারীরা চলাচল না করে এলোপাতাড়ি রাস্তা পারাপার হয়। এতে দুর্ঘটনায় কবলিত হচ্ছে স্কুলগামী ছাত্রসহ এলাকাবাসী। অথচ মহাসড়কের যেসব স্থানে ওভার ব্রিজ রয়েছে, ওইগুলো অনেকটা অলস অবস্থায় পড়ে আছে। নগরীর মিউনিসিপ্যাল স্কুলের সামনে ও স্টেশন রোডে ফুটওভার ব্রিজ পুরোটা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। এ সকল ফুটওভার ব্রিজ এখন অসামাজিক কাজে জড়িত ব্যক্তি ও নেশা খোরদের নিরাপদ স্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে কর্নেলহাট ফুটওভার ব্রিজটি কিছু সচল রয়েছে। মহাসড়কের অপর ফুটওভার ব্রিজগুলোও সময়োপযোগী করে পুনরায় স্থাপন করতে হবে। প্রয়োজনে এসব ব্যবহারে আরো জনসচেতনতামূলক উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে স্কুল ছাত্রদেরও উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

চলতি বছরের ২০ অক্টোবর বাড়বকুণ্ডে অনুরূপ একটি জনসচেতনতাূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করে বারআউলিয়া হাইওয়ে থানা। পরে ওসি আব্দুল মমিন এলাকাবাসীর উপস্থিতে বাজারে পার্কিংস্থল নির্ধারণ করে দেয়। এরপূর্বে গত ২৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলার বিআরটিএর উদ্যোগে অপর একটি জনসচেতনতামূলক অনুষ্ঠান হয়। এতে সাম্প্রতিক মহাসড়কে দুর্ঘটনায় নিহত পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিপূরণের অর্থ বিতরণ করা হয়।

এতসব পরেও বলতে হয় মহাসড়কের ৪ লেন স্থলে ৬ লেনে উন্নীত করা, পারাপারে আন্ডার বাইপাস সড়কসহ ১৯২ কিলোমিটারের এ দীর্ঘ মহাসড়কে উড়াল সড়ক নির্মাণ করে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরো নিরবচ্ছিন্ন করে গড়ে তুলতে হবে।

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবনে নিজের পরিচয় তৈরি করা
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে