আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি সমাবেশ গত কয়েক মাসে হয়েছে অনেকগুলো। এক কিলোমিটারের মধ্যে দুই পক্ষ শান্তিপূর্ণ জমায়েত করার পর প্রশংসা করেছেন বিদেশিরাও। সরকারের পক্ষ থেকেও সহনশীল রাজনীতির উদাহরণ টানা হয়েছে। তবে আজ ২৮ অক্টোবরকে ঘিরে উদ্বেগের কারণ ১৭ বছর আগের এই দিনটির স্মৃতি। ২০০৬ সালের এই দিনটিতেও ঢাকায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের সমাবেশের ছিল পাশাপাশি এলাকায়, ঘটে যায় তুলকালাম। পরে সংঘাত সহিংসতার এক পর্যায়ে জারি হয় জরুরি অবস্থা।
নানা জল্পনা, কী হবে ২৮ অক্টোবর? ‘মহাযাত্রা’র বিএনপি কি রাজপথে বসে পড়বে? নাকি সমাবেশ করে চলে যাবে? আর আওয়ামী লীগ তাদের ‘বসে পড়তে দেবে না’। তাদের আছে পাল্টা কর্মসূচি।
এদিকে এক দফার আন্দোলনে থাকা বিএনপি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ২০ শর্তে তাদের পছন্দের জায়গায় অবশেষে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। আজ শনিবার বেলা ২টায় নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলটির মহাসমাবেশ শুরু হবে, যেখান থেকে তাদের আন্দোলনের ‘মহাযাত্রা’ শুরু হওয়ার কথা। এর পাল্টায় শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশের ডাক দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বেলা আড়াইটায় বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেইটে তাদের সমাবেশের সময় দেওয়া হলেও নেতাকর্মীদের বেলা ১১টা থেকেই জমায়েত হতে বলা হয়েছে। খবর বিডিনিউজের।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার গতকাল রাত ৮টার দিকে বলেন, ২০টি শর্তে বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির পাশাপাশি সমমনা দল ও জোটগুলোও যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে আজ ভিন্ন ভিন্ন স্থানে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। যুগপৎ আন্দোলনে না থাকলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে জামায়াতে ইসলামী। চাহিদামাফিক জায়গায় সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার কথা জানায়। তবে জামায়াতে ইসলামকে অনুমতি দেওয়া হয়নি।
বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, একই ধরনের শর্তে ২১টি দল আজ সমাবেশ করার অনুমতি পেয়েছে। তবে নিবন্ধনহীন জামায়াতে ইসলামীকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
পুলিশের চেষ্টা ব্যর্থ : ঢাকা মহানগর পুলিশ চেষ্টা করেছিল দুই দলকে রাজপথ থেকে সরিয়ে ময়দানে নিতে। বিকল্প দুটি স্থানের নাম চেয়ে চিঠি দেওয়া হয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে। কিন্তু দুই দলই পাল্টা চিঠিতে বলেছে, তাদের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। এখন আর পেছানো সম্ভব নয়। বিএনপি এক থেকে সোয়া এক লাখ এবং আওয়ামী লীগ দুই লাখ লোক জমায়েতের ঘোষণা দিয়েছে। এদিকে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ গেইটে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশের জন্য মঞ্চ তৈরির কাজ গতকাল সকালে মাঝপথে বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ।
কর্মীদের আগেই জড়ো করছে বিএনপি : বিএনপির এক নেতা বলেন, এবার জমায়েত বাড়াতে তারা পূর্বের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবেন। তিনি বলেন, দেখা গেছে, সমাবেশের আগে পুলিশ নেতাকর্মীদের আসতে নানা রকম বাধা দেয়। নেতাকর্মীদের আগমন যাতে পুলিশ বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, সেজন্য দুয়েকদিন আগে থেকেই ঢাকায় অবস্থান করছেন জেলা–উপজেলা পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মী। ইতোমধ্যে অনেকে অবস্থান নিয়েছেন।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, জনতার যে স্রোত নামবে, সেটা রোখা যাবে না। ভয়ভীতি, মামলা–গ্রেপ্তার করে লাভ হবে না। দিগন্তরেখায় গণতন্ত্রের মুক্তির সূর্য উঠতে শুরু করেছে।
এদিকে আজ ঢাকার ৯টি স্থানে ‘মহাসমাবেশ’ করার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোটগুলো।
মোকাবেলার প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের : বিএনপির মহাসমাবেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পাল্টা সমাবেশের পাশাপাশি যে কোনো ধরনের সহিংসতা এড়াতে সারা দেশে পাড়া মহল্লা, অলিগলিসহ রাজধানীর মোড়ে মোড়ে সতর্ক পাহারায় থাকার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আজ মূল দলের পাশাপাশি থাকবে যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগসহ সকল সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসানো হবে সতর্ক পাহারা। প্রতিটি পাড়া–মহল্লার মোড়ে এবং গুরুত্বপূর্ণ সড়কে প্যান্ডেল টাঙিয়ে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা সকাল থেকে অবস্থান নেবেন। দলীয় সংসদ–সদস্য ও কাউন্সিলররাও তাদের অনুসারীদের নিয়ে মাঠে থাকবেন।
এদিকে বায়তুল মোকাররম মসজিদ গেইটের সামনে আওয়ামী লীগের আজকের সমাবেশের তারিখ পরিবর্তনের যে খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে, সেটি ভুয়া বলে জানানো হয়েছে ক্ষমতাসীন দলটির পক্ষ থেকে।
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, বুধবার সন্ধ্যা থেকেই ঢাকার অলিগলিতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা অবস্থানে থাকছে। দেশের মানুষকে শান্তিতে রাখতে আমরা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সতর্ক অবস্থানে থাকব। আর সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই সতর্ক অবস্থানে থাকব।
নজর বিদেশিদেরও : বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সহিংসতাহীন নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসও এবার বেশ তৎপর। জানুয়ারির শুরুতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশিদের জন্য নতুন ভিসা নীতি আরোপ করে তার প্রয়োগও শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই নীতির আওতায় নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্তকারী ও তাদের নিকটাত্মীয়দের ভিসা দিচ্ছে না দেশটি।
সর্বশেষ সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেছেন, নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। সব পক্ষের শান্তিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করতে পারাটা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যার মধ্যে রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃক্সখলা বাহিনী, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যম এবং অতি অবশ্যই ভোটাররা।
বড় ঘটনার শঙ্কা নেই : পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বড় ধরনের কোনো ঘটনার আশঙ্কা করছেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক হারুন–অর–রশিদ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য বলেন, আমাদের উন্নয়ন সহযোগী যারা আছে, তারাও কোনো সহিংসতা চায় না। উন্নয়ন সহযোগীদের এই বক্তব্য নৈর্ব্যক্তিকভাবে নিয়ে সেটা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য যেমন প্রযোজ্য, বিএনপির জন্যও প্রযোজ্য।
বিএনপির এক দফা দাবি আদায়ের মতো সময় ও পরিস্থিতি এখন নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ কারণে তাদের উচিত নির্বাচনে এসে জনগণের কাছে যাওয়া। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশে এবার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। কারণ, ভিন্ন কিছু হলে সেটা হজম করতে পারবে না বাংলাদেশ।
জামায়াতে ইসলামী : সরকারের পদত্যাগ ও কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে আজ মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে জামায়াত। বিকালে এই সমাবেশ হওয়ার কথা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি না দিলেও দলটি কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
২০টি শর্তে যা আছে : এক দফার আন্দোলনে থাকা বিএনপি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ২০ শর্তে তাদের পছন্দের জায়গায় সমাবেশ করতে গতকাল অনুমতি দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। অনুমতির যে চিঠি বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে দেওয়া হয়েছে, দুই জায়গাতেই একই ধরনের ২০টি শর্ত রয়েছে। খবর বিডিনিউজের।
শর্তগুলো হচ্ছে : ১. এই অনুমতিপত্র স্থান ব্যবহারের অনুমতি নয়, স্থান ব্যবহারের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে অনুমোদন নিতে হবে। ২. স্থান ব্যবহারের অনুমতিপত্রে উল্লেখিত শর্তাবলী যথাযথভাবে পালন করতে হবে। ৩. অনুমোদিত স্থানের মধ্যেই সমাবেশ এর যাবতীয় কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। ৪. বেলা ১২টার আগে কোনোক্রমেই জনসমাগম করা যাবে না। ৫. নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক (দৃশ্যমান আইডি কার্ডসহ) নিয়োগ করতে হবে। ৬. নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সমাবেশে আগতদের হ্যান্ড হেল্ড মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে (ভদ্রোচিতভাবে) চেকিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. অনুমোদিত স্থানের বাইরে কোথাও লোক সমবেত হতে পারবে না। ৮. আজান, নামাজ ও অন্যান্য ধর্মীয় সংবেদনশীল সময়ে মাইক/শব্দযন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। ৯. ধর্মীয় অনুভূতির উপর আঘাত আসতে পারে এমন কোনো বিষয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন, বক্তব্য প্রদান বা প্রচার করা যাবে না।
১০. অনুমোদিত সময়ের মধ্যে (বেলা ২টা থেকে ৫টা) সমাবেশের সার্বিক কার্যক্রম অবশ্যই শেষ করতে হবে। ১১. সমাবেশ সমাপ্তির পর যাওয়ার সময় রাস্তায় কোথাও কোনো সংক্ষিপ্ত সমাবেশ বা অবস্থান করা যাবে না। ১২. আদালতে সাজাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি সমাবেশে বক্তব্য দিতে পারবে না বা তার কোনো বক্তব্য সমাবেশে প্রচার করা যাবে না।
১৩. রাস্তার বাম লেন ন্যূনতম ব্যবহার করে সমাবেশ করতে হবে এবং অন্য লেনসমূহ কোনোক্রমেই ব্যবহার করা যাবে না। ১৪. আইন–শৃক্সখলা পরিপন্থী ও জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কার্যকলাপ করা যাবে না। ১৫. রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কার্যকলাপ ও বক্তব্য প্রদান করা যাবে না। ১৬. উসকানিমূলক কোনো বক্তব্য প্রদান বা প্রচারপত্র বিলি করা যাবে না।
১৭. সমাবেশে ব্যানারের আড়ালে কোনো ধরনের লাঠিসোঁটা বা রড সদৃশ কোনো বস্তু ব্যবহার করা যাবে না। ১৮. আইন–শৃক্সখলার অবনতি ও কোনো বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে আয়োজনকারী কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবেন। ১৯. উল্লিখিত শর্তাবলী যথাযথভাবে পালন না করলে তাৎক্ষণিকভাবে এই অনুমতির আদেশ বাতিল বলে গণ্য হবে। ২০. জনস্বার্থে কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই এ অনুমতি আদেশ বাতিল করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করে।