ড.মাহবুবুল হক ছিলেন বহুতর পরিচয়ে একজন বিশিষ্ট বৌদ্ধিক পুরুষ। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, গবেষক, অনুবাদক ও ভাষা বিজ্ঞানী। সারস্বত চর্চায় যে ঐতিহ্য আমাদের দেশে তৈরি হয়েছে তার অন্যতম উত্তরাধিকার ড.মাহবুবুল হক। তিনি বাঙালির ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতির ইতিবৃত্ত নিয়ে নিরলস অনুসন্ধিৎসা নিয়ে নিবিষ্ট ছিলেন। যা দেখেছিলেন তাই নিয়েই ভেবেছেন ভাবানোর চেষ্টা করেছেন অন্যদের। জ্ঞান অন্বেষণের এক বিরল সাধক ছিলেন তিনি। দিনের প্রতিটি ক্ষণ নিমগ্ন হয়ে থাকতেন বিদ্যাচর্চায়।
ড.মাহবুবুল হক ১৯৪৮ সালের ৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মস্থান ফরিদপুর জেলার মধুখালিতে। তবে শৈশব থেকে বেড়ে ওঠেছেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৭০ সালে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কুমিল্লার কোটবাড়িতে অবস্থিত সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে আসীন ছিলেন তিনি।
শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন মাহবুবুল হক। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকতা করেছেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়া কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যোগদান করেন বাংলা বিভাগে। গৌরবের সাথে শিক্ষকতা পেশার ইতি টানেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রায়োগিক বাংলা ও ফোকলোর চর্চা, গবেষণা, সম্পাদনা, অনুবাদ ও পাঠ্যবই রচনা করে পরিচিতি লাভ করেন ড. মাহবুবুল হক। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ বিশেষজ্ঞ হিসেবে নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছেন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বেশ কয়েকটি বাংলা পাঠ্য বইয়েরও রচয়িতাও তিনি। আহ্বায়ক হিসেবে নতুন শিক্ষানীতি অনুযায়ী ২০১২ ও ২০১৩ শিক্ষাবর্ষের বাংলা শিক্ষাক্রম ও বাংলা পাঠ্যবই প্রণয়নে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে তার।
বাংলাদেশ, ভারত ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তার চল্লিশটির বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে: বাংলা বানানের নিয়ম, রবীন্দ্র সাহিত্য রবীন্দ্র ভাবনা, তিনজন আধুনিক কবি, ইতিহাস ও সাহিত্য, বইয়ের জগৎ: দৃষ্টিপাত ও অলোকপাত, বাংলা কবিতা: রঙে ও রেখায়, ভাষার লড়াই থেকে মুক্তিযুদ্ধ, ফোকলোর ও অন্যান্য,বাংলার লোকসাহিত্য: সমাজ ও সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা: কয়েকটি প্রসঙ্গ, রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, বাংলা সাহিত্যের দিক–বিদিক, কৃতীজন কৃতিকথা, ম্যাক্সিম গোর্কির মা, চট্টগ্রামে শেখ মুজিব। উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে ‘বাংলা বানানের নিয়ম‘ নামক একটা বই লিখে দারুণ সাড়া ফলে দিয়েছিলেন ড.মাহবুবুল হক। বইটি একসঙ্গে ঢাকা এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। ফলে এটি পাঠক ও বোদ্ধা মহলে বেশ আলোড়ন তৈরি করে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে তাঁর কাজ (নজরুল তারিখ অভিধান, বাংলা একাডেমি) জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে তাঁকে স্বীকৃতি এনে দিয়েছিলেন। যে কঠিন শ্রম তিনি এ–কাজে দিয়েছেন তা বাঙালি জাতিকে কৃতজ্ঞ করেছে এই কাজে তিনিই ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ। ড.মাহবুবুল হক বেশ কিছু মৌলিক কাজ করছেন; যার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। যেমন বাংলা সাহিত্য পর্যালোচনামূলক লেখা (বাংলা সাহিত্য: কয়েকটি প্রসঙ্গ, ২০০৪; বাংলা সাহিত্য : নানা নিবন্ধ, ২০১০) বাঙালির সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ক লেখালেখি (লোকসংস্কৃতি : কয়েকটি প্রসঙ্গ, ২০০৮; বাংলার লোকসাহিত্য : সমাজ ও সংস্কৃতি, ২০১০), শিশুপাঠ্য বই (বীরশ্রেষ্ঠদের কথা, ২০০২; ছড়ায় ছড়ায় বাংলা বানান, ২০০১; গল্পে গল্পে নজরুল, ২০০৯, ইত্যাদি); বিদেশি সাহিত্যের বঙ্গানুবাদ (সোভিয়েত রাশিয়ায় গমন এবং রুশ ভাষার পাঠগ্রহণ), জীবনী (আশুতোষ চৌধুরী, ১৯৯৪; লোকমান খান শিরওয়ানি, ২০১৬), বিদ্যালয়স্তরের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা, সংবাদপত্রের জন্য স্টাইলশিট তৈরি, সেই সঙ্গে বিদ্যালয়স্তরের পাঠক্রম তৈরি এবং নিরন্তর পরিমার্জনার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখা– এ সমস্তই তাঁর বিদ্যানিষ্ঠার পরিচয় বহন করে। এছাড়াও সম্পাদনা করেছেন একাধিক রচনাবলি, প্রবন্ধসংগ্রহ (বাঙালি সংস্কৃতির রূপ, গোপাল হালদার, ২০১১), সম্পাদিত পাঠ তৈরি করেছেন চর্যাপদের (চর্যাগীতি পাঠ, ২০০৯/ ২০১১)। সাহিত্য–সংস্কৃতির পাশাপাশি বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ নিয়ে তাঁর ভাবনা বিশিষ্টতা দাবি করে। বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, বানান, প্রয়োগ নিয়ে অসংখ্য রচনা বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতাকেই সপ্রমাণ করে।
ষাট এর দশকে তিনি সাহিত্য–সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭১–এ অংশ নিয়েছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে।
বলাবাহুল্য, চট্টগ্রামের প্রাচীন পত্রিকা দৈনিক আজাদীর সাথে ড. মাহবুবুল হকের কী পরিমাণ হৃদ্যতা ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি লিখেছেন, ‘দৈনিক আজাদীর পঁয়ত্রিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে মালেক ভাই একটি আসাধারণ কাজ করেছেন। সেটি হলো হাজার বছরের চট্টগ্রাম নামের সংকলন প্রকাশ। আমার সৌভাগ্য, সেটির সার্বিক পরিকল্পনা ও সম্পাদনার মূল দায়িত্ব মালেক ভাই ও অধ্যাপক খালেদ আমাকে দিয়েছিলেন। আমি আজাদীর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো দায়িত্বে ছিলাম না। কিন্তু মালেক ভাই ও অধ্যাপক খালেদ পুরোপুরি স্বাধীনভাবে আমাকে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। মাত্র মাস দুয়েকের মধ্যে বিশেষ সংখ্যাটি আমাদের সম্পাদনা করে প্রকাশ করতে হয়েছিল। সে জন্যে একটা পথমানচিত্র তৈরি করে তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে আমরা অগ্রসর হই। এই পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল একাধিক বৈঠকে। অধ্যাপক খালেদকে মধ্যমণি করে মালেক ভাই, অরুণ দা, জহুর ভাই ও আমি সে রূপরেখা চূড়ান্ত করি। তারপর কাজে নেমে যাই। সেই কাজের অভিজ্ঞতা আমার জন্যে অত্যন্ত রোমাঞ্চকর ও আনন্দের। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট লেখক, গবেষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সংগঠকদের অবদানে এবং প্রশাসনের সহায়তায় হাজার বছরের চট্টগ্রামের ভৌগোলিক পরিচিতি, পুরাকীর্তি, ইতিহাস, প্রশাসনিক দিক, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সাহিত্য, খেলাধুলা ইত্যাদি বিষয়ে একটি তথ্যসমৃদ্ধ সংকলন প্রকাশ করা সম্ভব হয়। এটির প্রকাশক ছিলেন মালেক ভাই, সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক খালেদ, অরুণ দা ছিলেন সহযোগী সম্পাদক। আমি দায়িত্ব পালন করি নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে।‘
ড. মাহবুবুল হক ভারতের কলকাতা, যাদবপুর, বিশ্বভারতী, কল্যাণী, পাতিয়ালা, গৌড়বঙ্গ ও আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, ত্রিপুরায় ও কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে ভাষা–সাহিত্য, ইতিহাস ও ফোকলোর বিষয়ে সম্মেলন ও সেমিনারে অংশ নিয়ে গবেষণা–প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন। ২০০৭–এ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রথম সার্ক ফোকলোর উৎসবে তিনি অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধি হিসেবে। প্রবন্ধে অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। গবেষণায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করেন। এছাড়া লেখালেখি ও গবেষণার জন্য তিনি ফিলিপস পুরস্কার, নজরুল পদক, মুক্তিযুদ্ধ পদক, মধুসূদন স্বর্ণপদক, চট্টগ্রাম একাডেমি পুরস্কার, অবসর সাহিত্য পুরস্কার, রশীদ আল ফারুকী সাহিত্য পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। কার্যত ড.মাহবুবুল হক ছিলেন দেশের এক অন্যতম অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব। জীবন–দর্শন ও চিন্তাধারায় তিনি ছিলেন মুক্তবুদ্ধি–অসামপ্রদায়িক–উদার–আধুনিক ও শেকড়সন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গির ধারক। তাঁর সমস্ত গবেষণা সামাজিক দায়বদ্ধতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অভূতপূর্ব নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর মৃত্যুতে দেশ হারালো একজন অসাধারণ প্রতিভাধর গুণীজনকে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, সদালাপী, বন্ধুবৎসল ও পরোপকারী ব্যক্তিত্ব। তিনি আজীবন অগণিত শিক্ষার্থী, পাঠক, লেখক, গবেষক ও অনুরাগীদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার।