ড. মঈনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ১৭ জুন, ২০২১ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

পুঁজি-পাচার দমনের চাবিকাঠি ধারণ করছে দুর্নীতি দমনে আন্তরিকতা

৮ জুন ২০২১ তারিখের দৈনিক প্রথম আলোয় সংসদের বিরোধী দলের সদস্যদের কাছে অর্থমন্ত্রীর একটি অনুরোধ দেখতে পেলাম,‘কারা অর্থ পাচার করে, সেই তালিকা আমার কাছে নেই। নামগুলো যদি আপনারা জানেন যে এঁরা এঁরা অর্থ পাচার করেন, আমাদের দিন’। ৯ জুন তারিখের প্রথম আলোর সম্পাদকীয় এর জবাবে বলছে,‘চোখ-কান বন্ধ করে কেউ যদি কিছু খুঁজতে চায়, তবে কোন দিনই তার সন্ধান মিলবে না। অর্থমন্ত্রী যাঁদের ‘খুঁজে’ বেড়াচ্ছেন তাঁদের নাম-ধাম পেতে হলে শুধু চোখ-কান খুলতে হবে, আর সেই অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে তাঁর সরকারের সদিচ্ছা লাগবে’। এই সম্পাদকীয়ের সাথে সুর মিলিয়ে আমিও বলি, অর্থমন্ত্রীর উক্তি দায়িত্বজ্ঞানহীন। তালিকা প্রণয়ন তাঁর দায়িত্ব, বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা কেন তাঁকে নাম দিবেন? যে জেগে ঘুমায় তাকে ঘুম থেকে জাগানো যায় না। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বহু আগেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ওপর রুল জারি করে পাচারকারীদের নাম জানতে চেয়েছেন। রুল মোতাবেক দুদকের আইনজীবী দায়সারাভাবে একটি তালিকা বেঞ্চে পেশ করার কারণে মাননীয় বিচারপতিদের তিরস্কারের সম্মুখীন হয়েছিলেন। আদালত তাঁকে ঐ তালিকা ফেরত দিয়ে আন্তরিকভাবে তদন্ত করে আরো পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করার রায় ঘোষণা করেছেন। আদালত মন্তব্য করেছেন, পুঁজি-পাচারকারীরা জাতির দুশমন। এর কিছুদিন পর গত ১৮ নভেম্বর ২০২০ তারিখে ঢাকায় ‘মিট দি প্রেস’ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন জানিয়েছেন, তিনি স্ব-উদ্যোগে কানাডার টরোন্টোর ‘বেগমপাড়া’ সম্পর্কে একটি গোপন জরিপ চালিয়ে ২৮টি নমুনা থেকে দেখেছেন যে রাজনীতিবিদরা নন বেগমপাড়ার বাসিন্দাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছে সরকারি চাকুরিজীবীরা। এই ২৮ পরিবারের মধ্যে ৪টি পরিবার রাজনীতিবিদদের, বাকীগুলো সরকারি কর্মকর্তাদের এবং গার্মেন্টস মালিকদের। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় থেকে ঐ তালিকা সংগ্রহ করা কি অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের জন্য খুব কঠিন? বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইনেন্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট থেকে কয়েক দফায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সিআইডি’র কাছে পুঁজি-পাচারকারীদের নাম-ধাম সরবরাহ করা হলেও কোন সাড়া মেলেনি। সাম্প্রতিক সাড়া জাগানো পুঁজি-পাচারকারী পি কে হালদারের কাহিনী কিংবা পাপুলের কাহিনী সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী খোঁজখবর নেননি কেন? ২০১৮ সালে পানামা পেপার্স এবং প্যারাডাইস পেপার্সে ৮২ জন বাংলাদেশী পুঁজি-পাচারকারীদের নাম প্রকাশিত হয়েছিল, অর্থমন্ত্রীর কাছে তাদের নাম নেই কেন? অর্থমন্ত্রী কি জানেন না ব্যাংকের খেলাপিঋণ সমস্যার সাথে পুঁজি-পাচার সমস্যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত? তিনি অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর একের পর এক অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদেরকে অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চলেছেন এবং খেলাপিঋণ সংকটকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলেছেন। যেখানে খেলাপিঋণের প্রকৃত পরিমাণ ইতোমধ্যেই চার লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে সেখানে তিনি সংসদের চলমান বাজেট অধিবেশনেই ঘোষণা দিয়েছেন যে সমস্যাটি গুরুতর নয়! ব্যাংকের ঋণ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে এটা কি তিনি জানেন না? জানেন, কিন্তু মানেন না!
আসল সমস্যা হলো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী কারো কথায় এবং কাজে আশ্বস্ত হওয়ার মত কোন আলামত মিলছে না যে তাঁরা দুর্নীতি দমন, খেলাপিঋণের মারাত্মক বিস্তার এবং তদ্‌উদ্ভূত পুঁজি-পাচার দমনে সত্যিই আন্তরিক। দুর্নীতির প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ শুধুই রাজনৈতিক বাত্‌-কা-বাত্‌। পুঁজি-পাচারের মূল রয়ে গেছে দুর্নীতি ও খেলাপিঋণের বেলাগাম বিস্তারের মধ্যে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার পথ ধরে সমরপ্রভু জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলের পর তিনি তাঁর কেনাবেচার রাজনীতির স্বার্থে এবং সামরিক-সিভিল আমলাদের আনুগত্য ও সমর্থন বজায় রাখার প্রয়োজনে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতিকে বুঝেশুনে আশকারা দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণের যথেচ্ছ বাটোয়ারা, ব্যক্তিখাতের শিল্প- কারখানার লাইসেন্স-পারমিট বিতরণ, পরিত্যক্ত ও রাষ্ট্রায়ত্ত কল-কারখানা-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকানা বিতরণ, দেদারসে আমদানি পারমিট বিতরণ, দুর্লভ বৈদেশিক মুদ্রার বন্টনে অগ্রাধিকার প্রদান, বৈদেশিক ঋণ-অনুদানে অর্থায়িত প্রকল্পের ঠিকাদারি বিতরণ–রাজনেতিক নেতা-কর্মী, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, সিভিল আমলা ও ব্যবসায়ীদেরকে বিএনপি এবং এর পূর্বসূরি জাগদলে ভিড়াতে জিয়াউর রহমান এ-ধরনের সব মহাজনী পন্থাই যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭৩ সাল থেকে তাঁর সরকারের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি ও পুঁজি লুন্ঠনের অভিযোগ উঠেছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি ঐসব অভিযোগের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর এই অনীহা বা অনাগ্রহের ব্যাপারে বেশ কয়েকবার প্রকাশ্যে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন বলে প্রমাণ রয়েছে, তবুও বঙ্গবন্ধুকে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সক্রিয় করা যায়নি। অবশ্য, ১৯৭৩ সাল থেকে দুর্নীতি ক্রমেই বিস্তার লাভ করলেও ঐ সময়ে দুর্নীতি ছিল ব্যতিক্রমী আচরণ, রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে তখনো ওটা নিয়মে পরিণত হতে পারেনি। কিন্তু জিয়া নিজেকে সততার পরাকাষ্ঠা হিসেবে জাহির করলেও তাঁর সচেতন আশকারা পেয়েই তাঁর শাসনামলে দুর্নীতি ও পুঁজি-লুন্ঠন ক্রমশ প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিল। মার্কাস ফ্রান্ডাকে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে জিয়া বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মত অনুন্নত দেশে আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতি অনিবার্য (inevitable)’। জিয়ার আমলেই বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পুঁজি-পাচার শুরু হয়েছিল। ঐ সময় পিএইচডি করার জন্য আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসী স্টেটের ন্যাশভিল শহরে অবস্থিত ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলাম। ঐ ন্যাশভিলে ১৯৭৮-৮০ এই তিন বছরে ১১টি বাংলাদেশী পরিবার ইমিগ্রেশন নিয়ে বসবাস শুরু করেছিল তখনকার ন্যূনতম ৪০,০০০ ডলার পুঁজি নিয়ে যাওয়ার শর্ত পূরণ করে। যাওয়ার পর ঐ ১১ পরিবারের মধ্যে ৫টি মোটেল কিনে ব্যবসা শুরু করেছিল ন্যাশভিলেই।
ঔপনিবেশিক আমলের পুঁজি-পাচারকারীদের মত বাংলাদেশের এই পুঁজি-লুটেরা ও পুঁজি-পাচারকারীরা জাতির ‘এক নম্বর দুশমন’। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে পরাজয়ের পূর্বে তদানীন্তন বাংলা ছিল সারা ভারতবর্ষে সবচেয়ে সমৃদ্ধ কৃষি অর্থনীতি এবং কুটির শিল্পজাত পণ্য রপ্তানির বিশ্বখ্যাত অঞ্চল। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেধড়ক্‌ পুঁজি-লুন্ঠন, পুঁজি-পাচার এবং ঔপনিবেশিক লুটেরা শাসন-শোষণের শিকার হয়ে পরবর্তী ১০০ বছরে ঐ সমৃদ্ধ অর্থনীতি অবিশ্বাস্য বরবাদির অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছিল। মার্কিন ইতিহাসবিদ ব্রুক এডামস জানাচ্ছেন, ১৭৫৭ সালের পর বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে কাঠের জাহাজে পুঁজি-পাচার এত বিপুলভাবে বেড়ে গিয়েছিল যে ঐ জাহাজগুলো লন্ডন বন্দরে মাল খালাস করার জন্যে প্রায় তিন মাস অপেক্ষা করতে হত। এই লুন্ঠন-পর্বকে ইতিহাসবিদরা এখন ‘দি বেঙ্গল লুট’ নামে অভিহিত করে থাকেন। বলা হচ্ছে যে ঐ লুন্ঠিত পুঁজি ইংল্যান্ডের ‘প্রথম শিল্প বিপ্লবে’ তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছিল। ১৮৫৮ সালে সরাসরি বৃটিশ শাসন চালু হওয়া সত্ত্বেও ঔপনিবেশিক লুন্ঠন ও পুঁজি-পাচার থেকে মুক্তি মেলেনি বাংলার। উপরন্তু, মরার ওপর খাঁড়ার ঘা নেমে এসেছিল ১৯৪৭ সালে, যখন পূর্ব বাংলা বৃটিশ প্রভুদের ভারত-বিভাগের শিকার হয়ে আরেকবার অভ্যন্তরীণ-উপনিবেশ হিসেবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পরের ২৪ বছর মেকী স্বাধীনতার আড়ালে আবারো চলেছিল বেধড়ক্‌ শোষণ, লুন্ঠন, পুঁজি-পাচার এবং সীমাহীন বঞ্চনা ও বৈষম্য। এই ২১৪ বছরের লুন্ঠন, পুঁজি-পাচার ও শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়ে রিক্ত-নিঃস্ব হওয়ার কারণেই ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশকে অভিহিত করা হয়েছিল ‘ আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি’। বর্তমানে এই ‘ঘৃণ্য জাতীয় দুশমন’ পুঁজি-পাচারকারীরা প্রতি বছর গড়ে ৭০০-৯০০ কোটি ডলার পুঁজি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে বলে নিউইয়র্ক-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইনেন্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) গবেষণায় উদঘাটিত হচ্ছে। এর মানে, ঔপনিবেশিক বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পাকিস্তানী পুঁজি-পাচারকারীদের প্রেতাত্মাবাহী ভাবশিষ্য এই নব্য পুঁজি-পাচারকারীদের বিপুল পুঁজি-পাচারের কারণে বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় এক শতাংশের কাছাকাছি জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রতি বছর কম হচ্ছে। যাঁরা এসব পুঁজি-পাচারকারীদেরকে জেনেশুনে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে চলেছেন তাঁরাও কী ভূমিকা পালন করছেন ভেবে দেখবেন। বহুদিন আগে থেকেই আমাদের নীতি-প্রণেতাদেরকে আমি পুঁজি-পাচার প্রতিরোধে কঠোর নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের অনুরোধ জানিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু ঐ আহ্বান বিফলে গেছে।
পুঁজি-পাচারের প্রধান মিকানিজমগুলো ব্যাখ্যা করছি: বৈদেশিক বাণিজ্যের আমদানি-রপ্তানির সাথে জড়িত ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা পুঁজি-পাচারের প্রধান কুশীলব হিসেবে বহুল-পরিচিত হলেও ড. মোমেনের বক্তব্য থেকে আভাস মিলছে বর্তমানে দেশের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক-সিভিল আমলা-সামরিক অফিসার-প্রকৌশলী-পেশাজীবীরা প্রধান পুঁজি-পাচারকারীর ভূমিকা পালন করছে। সপরিবার বিদেশে হিজরত করে কোন উন্নত পুঁজিবাদী দেশে পরবর্তীতে দিন গুজরানের খায়েসে মত্ত হয়ে এই নব্য-পাচারকারীরা এখন অহর্নিশ পুঁজি-পাচারে মেতে উঠেছে। বৈদেশিক বাণিজ্যে আমদানির ক্ষেত্রে ওভার-ইনভয়েসিং পুঁজি-পাচারের সবচেয়ে বহুল-ব্যবহৃত পদ্ধতি, আর রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্ডার-ইনভয়েসিং এবং রপ্তানি-আয় জমা না দিয়ে বিদেশে রেখে দেওয়া পুঁজি-পাচারের সবচেয়ে ‘পপুলার মেথড’। কিন্তু, এই পুরানো পদ্ধতিগুলোর পাশাপাশি এখন প্রবাসী বাংলাদেশীদের বহুল-ব্যবহ্নত হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স প্রেরণের অভ্যাস পুঁজি-পাচারকারীদেরকে একটি সহজ বিকল্প উপহার দিয়েছে পলাতক পুঁজির পলায়নকে একেবারে নিরাপদ, নির্বিঘ্ন ও সুলভ করে দেওয়ার মাধ্যমে। হুন্ডি পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ যেহেতু বিদেশেই থেকে যায় তাই ঠিক কত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রতি বছর হুন্ডিচক্রে প্রবেশ করছে তার হদিশ পাওয়া প্রায় অসম্ভব বলা চলে। কিন্তু, এই ‘হুন্ডি ডলারের’ সমপরিমাণ টাকা রেমিট্যান্স-প্রেরকের পরিবারের সদস্যবৃন্দ ও আত্মীয়স্বজনরা যেহেতু পেয়ে যাচ্ছেন তাই এই অর্থ প্রবাসীদের পরিবার ও স্বজনদের ভোগ এবং বিনিয়োগে ব্যাপক অবদান রাখছে। ফর্মাল চ্যানেল বা ইনফর্মাল চ্যানেল–যেভাবেই রেমিট্যান্সের অর্থ অর্থনীতিতে প্রবাহিত হোক্‌ না কেন তার অর্থনৈতিক সুফল পুরো অর্থনীতিতে ছড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, যে হুন্ডি ডলার বিদেশেই রয়ে যাচ্ছে সেগুলো হুন্ডিচক্রগুলোর কাছ থেকে কিনছে দেশে দুর্নীতিজাত কালোটাকার মালিকরা এবং ব্যাংকের ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার ‘কালচার’ সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ীরা। মার্জিনখোর রাজনীতিক বলুন, দুর্নীতিবাজ সিভিল আমলা-সামরিক অফিসার-প্রকৌশলী বলুন, রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি বলুন, ডাকসাইটে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি বলুন–হুন্ডি ডলারের সহায়তায় বিদেশে পুঁজি-পাচারে মশগুল হয়ে রয়েছেন বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। প্রায় সব উন্নত দেশেই ন্যূনতম পরিমাণ পুঁজি নিয়ে গেলে ইমিগ্রেশন প্রদানের নিয়ম চালু রয়েছে। আর, এভাবেই ক্রমশ গড়ে উঠছে টরোন্টোর বেগমপাড়া কিংবা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম। ব্যাংকঋণ পাচারকারী এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে পুঁজি-পাচারকারীদেরকে সেজন্যেই আমি ‘ঘৃণ্য জাতীয় দুশমন’ আখ্যায়িত করছি। এত বিপুল পরিমাণ খেলাপিঋণ সত্ত্বেও বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত যে বড়সড় সংকটে পড়ছে না তার পেছনেও রেমিট্যান্স থেকে উদ্ভূত বিশাল আমানত প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এক অর্থে এই বিপুল অর্থ বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট) একটা তাৎপর্যপূর্ণ বিকল্পের ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের চমকপ্রদ উল্লম্ফনও ঘটাচ্ছে প্রবাসীদের ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স। বিশেষত, করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে গত পনেরো মাসে হুন্ডি পদ্ধতি বিপর্যস্ত হওয়ায় দেশের ফর্মাল চ্যানেলের রেমিট্যান্স প্রবাহে যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে সেটা আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারকে সতেজ রাখছে। মহামারির কারণে পুঁজি-পাচারও অনেকখানি শ্লথ হয়ে যাওয়ায় বর্তমান অর্থ-বছরে কালো টাকা সাদা করায় বিরাট উল্লম্ফন ঘটেছে। মহামারির মরণ ছোবল নিয়ন্ত্রণে আসার পর আবারো পুঁজি-পাচার পুরোদমে শুরু হয়ে যাবে। অতএব, পুঁজি-পাচার দমন করতে হলে দুর্নীতি ও পুঁজি-লুন্ঠনকে সত্যিকার সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার সাথে দমন করতেই হবে। নয়তো শুধু পুঁজি-পাচারকারীদের তালিকা পেলেই সরকার পুঁজি-পাচার শ্লথ করতে পারবে না।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক,
অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজকাল
পরবর্তী নিবন্ধশেখ হাসিনার কারামুক্তি দিবসে দোয়া মাহফিল