ড. মঈনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ৩ জুলাই, ২০২৫ at ৫:১২ পূর্বাহ্ণ

স্বৈরশাসক হাসিনা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অবিশ্বাস্যভাবে ফাঁপিয়ে দেখিয়েছেন

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা নিরবচ্ছিন্নভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই সাড়ে পনেরো বছরের শাসনামলের প্রথম পাঁচ বছর তিনি ক্ষমতায় ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। কিন্তু, নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়েও তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের ৪৩ বিভাজিত ঐতিহাসিক রায়ের সুযোগ নিয়ে হাসিনা ২০১১ সালের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করে দিয়েছিলেন, যাতে তাঁর আজীবন ক্ষমতায় অধিষ্টিত থাকার খায়েস পূরণে ভবিষ্যত নির্বাচনগুলোকে একতরফা প্রহসনে পরিণত করা যায়। ফলে, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়েছিল বাংলাদেশে, হাসিনা পরিণত হয়েছিলেন জনগণ কর্তৃক প্রবলভাবে ঘৃণিত অনির্বাচিত স্বৈরশাসকে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘বিএনপি তাদের শাসনামলে অনেক টাকা বানিয়েছে। এখন আমাদেরকে দু’হাতে টাকা বানাতে হবে’। শুরু হয়েছিল এক অবিশ্বাস্য লুটপাটতন্ত্র, যা গত সাড়ে পনেরো বছরে বেলাগামভাবে লুটে নিয়েছে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা। এই পুঁজিলুন্ঠনের কেন্দ্রে ছিল হাসিনাপুত্র জয়, রেহানাকন্যা টিউলিপ ও রেহানাপুত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী ববি, শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও তার পুত্র শেখ ফাহিম, শেখ হেলাল, তাঁর ভাই শেখ জুয়েল ও তাঁর পুত্র শেখ তন্ময়, সেরনিয়াবাত হাসনাত আবদুল্লাহ ও তাঁর পুত্র সাদিক আবদুল্লাহ, শেখ তাপস, শেখ পরশ, লিটন চৌধুরী ও নিঙন চৌধুরী এবং হাসিনার অন্যান্য আত্মীয়স্বজন। আর ছিল এস আলম, সালমান রহমান, সামিটের আজিজ খান, বসুন্ধরার আকবর সোবহান, ওরিয়ন গ্রুপের ওবাইদুল করিম ও নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদারের মত লুটেরা অলিগার্ক ব্যবসায়ী এবং হাজার হাজার লুটেরা রাজনীতিবিদ ও দুর্নীতিবাজ আমলা।.

এই অবিশ্বাস্য লুটপাটতন্ত্রকে আড়াল করার জন্য হাসিনা অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক মিথ্যা বয়ান রচনা করে চলেছিলেন। বলা হচ্ছিল যে বাংলাদেশ বিশ্বের একটি দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু, হাসিনার কথিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের খেসারত হলো আঠারো লক্ষ কোটি টাকা ঋণের সাগরে জাতিকে ডুবিয়ে দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভুয়া বয়ান সৃষ্টির পাশাপাশি বেলাগাম পুঁজিলুন্ঠন ও বিদেশে পুঁজি পাচারের এক অবিশ্বাস্য রেকর্ড সৃষ্টি। ঋণের সাগরে জাতিকে ডুবিয়ে দিয়ে হাসিনা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারকে কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। এর জন্য তিনি চালু করেছিলেন অর্থনীতির প্রায় সকল সামষ্টিক পরিসংখ্যানকে (সধপৎড় ংঃধঃরংঃরপং) ‘অবিশ্বাস্য ডক্টরিং’ করার একটি সর্বনাশা ব্যবস্থা। এই সাড়ে পনেরো বছরের একটিও গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যানের নাম করা যাবে না যেটা তাঁর সরকার কর্তৃক বিকৃত করা হয়নি। আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংক, জাতিসংঘ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এদেশের অনেক পরিসংখ্যানকে গ্রহণযোগ্য মনে না করলেও বিকল্প তথ্যউপাত্তের সূত্রের অভাবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিক্স) পরিসংখ্যানকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। ফলে, দেশেবিদেশে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ে একটা কৃত্রিমউচ্চাশা সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক হাসিনার পতনের পর গত সাড়ে দশ মাস ধরে ক্রমশ অর্থনীতির প্রকৃত চিত্রটা ফুটে উঠতে শুরু করেছে, যেগুলোর মাধ্যমে হাসিনা সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত মিথ্যা বয়ান উন্মোচিত হয়ে চলেছে।

২০২৫ সালের ২ জুন তারিখে সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ডঃ সালেহউদ্দিন ২০২৫২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন, যা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে। আমি তাঁকে সাধুবাদ জানাচ্ছি স্বৈরশাসক হাসিনা সরকার ভুয়া পরিসংখ্যান উপস্থাপনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে যে ফুলানোফাঁপানো চিত্র উপস্থাপন করার দুঃখজনক ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিল সেটাকে সংশোধনের সাহসী প্রয়াসের জন্য। ২০০৯১০ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০২৪২৫ অর্থবছর পর্যন্ত উপস্থাপিত প্রতিটি বাজেটে প্রায় প্রত্যেকটি সামষ্টিক পরিসংখ্যানকে (সধপৎড় ংঃধঃরংঃরপং) ‘অবিশ্বাস্য ডক্টরিং’ এর লীলাক্ষেত্রে পরিণত করেছিলেন হাসিনার ২০০৯১৮ মেয়াদের পরিকল্পনা মন্ত্রী ও ২০১৯২৪ মেয়াদের অর্থমন্ত্রী লোটাস কামাল। ঐসব ভুয়াপরিসংখ্যানের ভিত্তিতে পরবর্তী অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলীর উপস্থাপিত ২০২৪২৫ অর্থবছরের বাজেটও যেহেতু নির্মীত হয়েছে তাই ভুয়াপরিসংখ্যানের দৌরাত্ম্য থেকে এই বাজেটও পরিত্রাণ পায়নি। সেজন্য ২০২৫২৬ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করতে গিয়ে ডঃ সালেহউদ্দিনকে অনেকগুলো তিক্ত বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয়েছে:

) ২০২৪২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের সময় দেশের মোট জিডিপি’র পরিমাণ যা বলা হয়েছিল তার চাইতে ২০২৫২৬ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি’র পরিমাণকে কমিয়ে দেখাতে হয়েছে। এই নূতন হিসাব অনুযায়ী ২০২৫ সালের জুনে দেশের মোট জিডিপি প্রাক্কলিত হয়েছে ৪৬২ বিলিয়ন ডলার।

) দেশের জনগণের মাথাপিছু জিএনআই নির্ধারিত হয়েছে ২৮২০ ডলার, অথচ হাসিনা সরকারের উপস্থাপিত ২০২৪২৫ অর্থবছরের বাজেটে তা বেশি দেখানো হয়েছিল। হাসিনা সরকার মাথাপিছু জিএনআই বাড়িয়ে দেখানোর জন্য মোট জিডিপির পরিমাণকে মারাত্মকভাবে ফাঁপিয়ে দেখাতো এবং জনসংখ্যাকে কমিয়ে দেখাতো। এই দুটো গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান ন্যক্কারজনক ‘ডক্টরিং’ এর শিকার হওয়ায় অর্থনীতির প্রকৃত স্বাস্থ্য সম্পর্কে দেশেবিদেশে মারাত্মক ভুলধারণার সৃষ্টি হয়েছিল। বলা হচ্ছিল যে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম উচ্চপ্রবৃদ্ধির দেশে পরিণত হয়েছে। এই কল্পকাহিনীর মাধ্যমে স্বৈরশাসক হাসিনা অর্থনৈতিক উন্নয়নের সফলতার মিথ্যাবয়ান সৃষ্টি করে গেছেন তাঁর সাড়ে পনেরো বছরের শাসনামলে। কিন্তু, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান প্রমাণ করে দিয়েছে এই প্রতারণা শেষ পর্যন্ত হাসিনার কাজে আসেনি।

) গত ২০২৪২৫ অর্থবছরে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির হার প্রাক্কলিত হয়েছে ৩.৯৭ শতাংশ, অথচ ২০২৪২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের সময় বলা হয়েছিল ২০২৪২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬ শতাংশ। বলা বাহুল্য, ঐ উচ্চাশা বাস্তবসম্মত ছিল না। অবশ্য, ২০২৪ সালের জুলাইআগস্টের গণঅভ্যুত্থানের টালমাটাল দিনগুলোতে এবং পরবর্তী সাড়ে দশ মাসের বিপর্যস্ত অর্থনীতির পালাপরিবর্তনের ধকলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। সেদিক্‌ থেকে বিবেচনা করলে ৩.৯৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি একেবারে ফেল্‌না বলা যাবে না। এই প্রবৃদ্ধির হারকে আগামী ২০২৫২৬ অর্থবছরে ৫.৫ শতাংশে উন্নীত করার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়। আগামী অর্থবছরের এই ঘোষিত প্রবৃদ্ধির হারকে অনেক বিশ্লেষক অতিউচ্চাভিলাষী আখ্যা দিলেও আমি এর পক্ষেবিপক্ষে কোন মন্তব্য করতে চাই না, আমি এই প্রস্তাবিত হার অর্জনে সরকারের সাফল্য কামনা করছি।

) বিগত স্বৈরশাসকের শাসনের শেষের দু’বছর ধরে সরকারের ভাষ্য মোতাবেক দেশের মূল্যস্ফীতির হার মারাত্মকভাবে বেড়ে ১১ শতাংশ অতিক্রম করেছিল। প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১৪ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল বলে বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ মতপ্রকাশ করেছিলেন। সেখান থেকে ২০২৫ সালের জুনে মূল্যস্ফীতির হারকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ৯.১৭ শতাংশে নামিয়ে ফেলেছে, যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। আগামী বছরের জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হারকে ৬.৫ শতাংশে টেনে নামানোর লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়েছে বাজেট বক্তৃতায়। অনেক বিশ্লেষক এই লক্ষ্যকেও উচ্চাভিলাষী আখ্যা দিয়েছেন। আমি এটাকে অর্জনযোগ্য বিবেচনা করছি।

) স্বৈরশাসক হাসিনা সরকারঘোষিত ২০২৪২৫ অর্থবছরের প্রাক্কলিত বাজেটবরাদ্দ ধরা হয়েছিল ৭,৯৭,০০০ কোটি টাকা। প্রকৃতপক্ষে ঐ প্রস্তাবিত বাজেটবরাদ্দ অর্জিত হবে না বলে বাজেট ঘোষণার পর থেকেই ধারণা করা হয়েছিল। এবারের বাজেট বক্তৃতায় ঘোষিত ২০২৪২৫ অর্থবছরের সংশোধিত ও সম্পুরক বাজেটে ব্যয়বরাদ্দ প্রাক্কলিত হয়েছে ৭,৪৪,০০০ কোটি টাকা। আর, ২০২৫২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বাজেটবরাদ্দ প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭,৯০,০০০ কোটি টাকা। অনেক বিশ্লেষক বলতে চান, এটা গত বছরের ঘোষিত বাজেটবরাদ্দ থেকে ৭,০০০ কোটি টাকা কম। এমনকি বলা হচ্ছে, পরবর্তী বছরের বাজেটকে আগের বছরের চাইতে কমিয়ে ফেলা সংকোচনমূলক বাজেটের পরিচায়ক। আমি তা মনে করি না। বরং, অমি মনে করি পরিসংখ্যানের ‘ইচ্ছাকৃত ডক্টরিং’ পরিহার করার সাহসী দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে এই পরিসংখ্যানগত সংশোধন প্রকাশের মাধ্যমে। ২০২৪২৫ অর্থবছরের সম্পুরক বাজেটের চাইতে ৪৬,০০০ কোটি টাকা বেশি প্রস্তাব করা হয়েছে ২০২৫২৬ সালের বাজেটে, যা অর্থনীতির বর্তমান স্থবিরতা ও বাস্তবতার প্রশংসনীয় স্বীকারোক্তি। আমি খুবই খুশি হবো যদি ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে সত্যিসত্যিই ঘোষিত বাজেটবরাদ্দ বাস্তবায়িত হয়। ভুয়া বাজেটবরাদ্দ ঘোষণার দীর্ঘদিনের ‘কালচার’ থেকে জাতি মুক্তি পেতে চলেছে এবার!

) আগামী ২০২৫২৬ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার প্রাক্কলিত হয়েছে ২,৩০,০০০ কোটি টাকা। মনে হতে পারে যে এখানেও সংকোচনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ব্যাপকভাবে অপব্যবহৃত হতো ক্ষমতাসীন দল বা জোটের নেতাকর্মীদের লুটপাটের খাই মেটানোর জন্য। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় প্রাতিষ্ঠানিক লুটপাট খানিকটা কম হবে বলে আশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, প্রফেসর ইউনূসের অবিরাম প্রয়াসের ফলশ্রুতিতে দেশে বৈদেশিক ঋণ এবং বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার আলামত সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে আগামী অর্থবছরে দেশের উন্নয়নক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য গতিসঞ্চার হবে বলে আশা করা যায়, যার মানে ঘোষিত অর্থবরাদ্দের চাইতে প্রকৃত উন্নয়নব্যয় বেশি হওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

) বাজেটে ঘোষিত রাজস্বআয়ের টার্গেটকে বরং আমার কাছে উচ্চাভিলাষী মনে হচ্ছে, বর্তমান বাস্তবতায় ৫,৬৪,০০০ কোটি টাকা রাজস্বআয় আহরণ সত্যিকারভাবে অর্জনযোগ্য মনে হয়নি আমার কাছে। বিশেষত, এনবিআরকে যে ৪,৯৯,০০০ কোটি টাকার টার্গেট দেওয়া হয়েছে সে টার্গেটপূরণ দুঃসাধ্য হবে। এর মানে, যদি প্রকৃত রাজস্বআয় অনেক কম হয়ে যায় তাহলে বাজেটের ঘাটতি ঘোষিত ২,২৬,০০০ কোটি টাকাকে মারাত্মকভাবে ছাড়িয়ে যাবে। অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, বাজেটঘাটতি আগামী অর্থবছর জিডিপি’র ৩.৬ শতাংশের বেশি হবে না। কিন্তু, রাজস্বআয়ের টার্গেট পূরণ না হলে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ বাড়ানো ছাড়া সরকারের গত্যন্তর থাকবে না। এটাই বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে বোধ করি।

) এবারের বাজেটে শিক্ষাখাত ও স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দকে বাজেটের শতাংশ হিসেবে কমিয়ে ফেলা হয়েছে। আমি এটাকে সমর্থনযোগ্য মনে করি না। এটাকে আমি গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গির দুঃখজনক অনুসরণ আখ্যা দিতে চাই। এই দুটো গুরুত্বপূর্ণ খাতের বাজেটবরাদ্দে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উল্লেখযোগ্য চারিত্রিক দিক্‌পরিবর্তন যে প্রতিফলিত হলো না সেটাকে আমি হতাশাজনক বিবেচনা করছি।

) এবারের বাজেটের সবচেয়ে বড় খাত ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য ১,২২,০০০ কোটি টাকার বরাদ্দ। হাসিনা সরকারের সাড়ে পনেরো বছরে সরকারের ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে আঠারো লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকায়। বৈদেশিক ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৩ বিলিয়ন ডলারে। এর ফলে,আগামী বেশ কয়েক বছর সরকারকে বিপর্যস্ত করতেই থাকবে এই বিপুল ঋণ পরিশোধের দায়ভার। পরিকল্পনা উপদেষ্টা প্রফেসর ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছেন, নূতন নূতন ঋণ নিয়ে পুরানো ঋণ পরিশোধের দুষ্টচক্র থেকে বেরোনো খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু, বাংলাদেশ এই দুষ্টচক্রে প্রবেশ করেছে। হাসিনার সবচেয়ে বড় অপরাধ জাতিকে বিশাল ঋণের এই দুষ্টচক্রে বন্দী করা, উন্নয়নের মিথ্যা বয়ান সৃষ্টির পাশাপাশি তাঁর আত্মীয়স্বজন, পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ী এবং লুটেরাঅলিগার্কদের লুটপাটতন্ত্রকে জারি রাখার জন্য তিনি ঋণের সাগরে ডুবিয়ে গেছেন জাতিকে।

১০) এবারের বাজেটে ২০২৫২৬ অর্থবছরে আয়করঅব্যাহতির কোন পরিবর্তন করা হয়নি। কিন্তু, বাজেটবক্তৃতায় আগামী ২০২৬২৭ অর্থবছর অব্যাহতিপ্রাপ্ত আয়ের সীমা ৩,৭৫,০০০ টাকায় উন্নীত করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এটা অর্থমন্ত্রীর ২০২৫২৬ বাজেটবক্তৃতার এখতিয়ারে পড়ে না, এটা স্রেফ প্রতারণার শামিল। ১ জুলাই ২০২৫

লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধমোহনা
পরবর্তী নিবন্ধনাসিম আলী খান : গানে, সুরে নিবিষ্ট এক সংগীতশিল্পী