১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করার পর শেখ হাসিনাকে সাড়ে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় দিল্লীতে ভারত সরকারের ‘শরণার্থী’ হিসেবে জীবন কাটাতে হয়েছে। ঐ সময়টায় বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু–বিরোধী সরকারগুলো ক্ষমতাসীন থাকায় শেখ হাসিনার সংসার চালানোর জন্য কোন আর্থিক সহায়তা পাওয়া যেতো না, ডঃ ওয়াজেদ মিয়াকে ভারত সরকার যে চাকুরি দিয়েছিল সেটার বেতন দিয়েই কায়ক্লেশে খরচ চালাতে হতো। আমার এক প্রয়াত সহকর্মীও নাকি কয়েকবার তাঁদেরকে বাজার করে দিয়েছিলেন। শেখ রেহানা ইংল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছিলেন, বিয়ের পর ওখানেই ছিলেন ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। ১৯৮১ সালের ১৭ এপ্রিল শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশে ফেরত আসার পর তাঁর কায়ক্লেশে জীবন ধারণের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল শুনেছি। ডঃ ওয়াজেদকে এটমিক এনার্জি কমিশনে একটা ভাল চাকুরি দেওয়া হয়েছিল, আওয়ামী লীগের পার্টি–ফান্ড থেকেও একটা মাসোহারা দেওয়া হতো। তবে, স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার থেকে গোপনে কয়েকবার তাঁকে অর্থ–উপঢৌকন দেওয়া হয়েছিল বলে জনশ্রুতিকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। ১৯৯৬ সালে যখন নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ সরকারে আসীন হয়েছিল তখন হাসিনার জন্য অর্থ–বিত্তের সিংহদ্বার খুলে যায়। জনগণের আশা ছিল, বঙ্গবন্ধু–কন্যা তাঁর জীবনের করুণ অধ্যায়টা স্মরণে রেখে দুর্নীতি ও পুঁজি–লুন্ঠনের ঘৃণ্য পথে পা বাড়াবেন না। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি, ১৯৯৬–২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতির কাহিনীগুলো শাসন–মেয়াদের শেষের দিকে জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে সমর্থ হয়েছিল। বিশেষত, প্রয়াত ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর টেলিভিশন প্রোগ্রামে ঐ কাহিনীগুলো ফলাও করে প্রচারিত হওয়ায় ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ চরম–বিপর্যয়ে পড়ে ক্ষমতা হারায়। তবে, ঐ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা এবং বিএনপি–জামায়াতপন্থী আমলাদের ‘সংগঠিত তৎপরতা’ নির্বাচনের ফলাফলকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত করার বিষয়টি এখন সপ্রমাণিত। যাক্, ২০০১–২০০৮ পর্যায়ে শেখ হাসিনা নানাভাবে হত্যা–প্রচেষ্টা ও সরকারী নির্যাতন–নিপীড়নের শিকার হওয়ার বিষয়টিও এখন সবার জানা হয়ে গেছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তাঁকে হত্যা করার জন্য ন্যক্কারজনক গ্রেনেড–হামলার বিষয়টি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা–প্রয়াসের অবিশ্বাস্য ঐতিহাসিক নজির হয়ে থাকবে চিরকাল, যে হামলায় বেগম আইভী রহমানসহ ২৪ জন মানুষ প্রাণ হারান এবং ৪০০জনের বেশি গুরুতর আহত হন। ২০০১–২০০৬ মেয়াদের বিএনপি–জামায়াত জোট–সরকারের অভূতপূর্ব দুঃশাসন, হাওয়া ভবনের দুর্নীতি, পুঁজি–লুন্ঠন, দশ ট্রাক অস্ত্র–চোরাচালান আটক, জামায়াতের জঙ্গি–পৃষ্ঠপোষকতা এবং বাংলাভাইসহ জঙ্গিবাদের উত্থান বিএনপি–জামায়াত সরকারের পায়ের নিচ থেকে দ্রুতই মাটি সরিয়ে নিয়েছিল। সর্বোপরি, ২০০৬–৭ পর্যায়ে অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বেগম জিয়ার একাধিক গোপন–খেলা ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে সামরিক অভ্যুত্থানকে অপরিহার্য করে তুলেছিল। সামরিক বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে বিতাড়নের ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলাটি ব্যর্থ হওয়ায় ঐ সরকার ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আবার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। অভিযোগ রয়েছে যে ঐ সময়ের সেনা–প্রধান মঈন–ইউ আহমদ ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে হাসিনা নির্বাচনের অব্যবহিত–পূর্বে একটি গোপন সমঝোতায় উপনীত হয়েছিলেন যে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হলে সামরিক বাহিনী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ‘সেইফ এক্জিট’ দেওয়া হবে। ঘটনা যা–ই হোক, মোটামুটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ–নেতৃত্বাধীন মহাজোট ভূমিধস বিজয় অর্জন করে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন হয়। এই ভূমিধস বিজয় হাসিনাকে আজীবন রাষ্ট্র–ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার সর্বনাশা পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রবলভাবে প্রলুব্ধ করে, শুরু হয় স্বৈরশাসক হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের একনায়কতন্ত্রের। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি একতরফা নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে হাসিনা তাঁর খায়েশ পূরণের পথে এগিয়ে যান।
সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের পুত্র সোহেল তাজ অভিযোগ করেছেন, ২০০৯ সালেই হাসিনা বলেছিলেন ‘বিএনপি অনেক টাকা কামিয়েছে। এখন আমাদেরকে দু’হাতে টাকা বানাতে হবে’। গত সাড়ে পনেরো বছর ছিল দেশে দুর্নীতি, পুঁজি–লুন্ঠন ও পুঁজি–পাচারের মহোৎসব–কাল। এই পুঁজি–লুন্ঠনের কেন্দ্রে ছিল হাসিনার পরিবার ও আত্মীয়–স্বজন, এস আলম, সালমান রহমান, সামিটের আজিজ খান, বসুন্ধরার আকবর সোবহান, ওরিয়ন গ্রুপের ওবাইদুল করিম ও নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদারের মত লুটেরা অলিগার্ক ব্যবসায়ী এবং হাজার হাজার লুটেরা রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিবাজ আমলা। শুধু হাসিনার পরিবার, আত্মীয়–স্বজন এবং অলিগার্ক ব্যবসায়ীরাই নয়, আওয়ামী লীগের প্রায় সকল মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও উচ্চ–স্তরের নেতা–কর্মী কোন না কোনভাবে দুর্নীতি, পুঁজি–লুন্ঠন ও পুঁজি–পাচারে জড়িয়ে গিয়েছিল। হাসিনা আমলের ‘এক নম্বর সমস্যায়’ পরিণত হয়েছিল অর্থনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, পুঁজি–লুন্ঠন ও পুঁজি–পাচার।
ভাসানীর আওয়ামী লীগকে হাসিনা দুর্নীতি, পুঁজি–লুন্ঠন ও পুঁজি–পাচারের লীলাক্ষেত্রে কীভাবে পর্যবসিত করলেন? ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে ১৫৩জন সংসদ–সদস্য বিনা–প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের রাতের ব্যালট–বাঙ ভরানোর প্রহসনের মাধ্যমে সংসদে আসা সদস্যদের ৬১.৭ শতাংশ ছিল ব্যবসায়ী, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একতরফা আমি–ডামি নির্বাচনী প্রহসনে এর কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। ২০১৯ সালে দেশের অর্থমন্ত্রীর চেয়ারে বসানো হয়েছিল একজন লুটেরা আদম বেপারিকে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে দেশের অর্থনৈতিক নীতি–নির্ধারণে সবচেয়ে শক্তিধর ব্যক্তিতে পরিণত করা হয়েছিল দেশের সবচেয়ে বড় পুঁজি–লুটেরা ঋণখেলাপি সালমান রহমানকে, তাকে বানানো হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী বিনিয়োগ ও শিল্প উপদেষ্টা। তার মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের খেলাপি ব্যাংক ঋণ পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকারও বেশি। চট্টগ্রামের কুখ্যাত এস আলমকে দেশের সাতটি ব্যাংকের ওপর একক নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যার দ্বিতীয় নজির বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এস আলম ঐ ব্যাংকগুলো থেকে কমপক্ষে দেড় লক্ষ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ডঃ দেবপ্রিয় ভট্টচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের যে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছিল তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, স্বৈরশাসক হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের লুটপাটতন্ত্রের মাধ্যমে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার হিসেবে আনুমানিক ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুন্ঠিত হয়ে দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি লুন্ঠনের শিকার হয়েছে ব্যাংকিং ও ফাইনেন্সিয়াল খাত, তারপর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত, তারপর ভৌত অবকাঠামো খাত এবং এরপর তথ্য প্রযুক্তি খাত। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, ভারত এবং কয়েকটি ‘ট্যাক্স হেভেন’ সবচেয়ে বেশি অর্থ–পাচারের সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
হাসিনা কীভাবে জনগণের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে এরকম একটি ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের লুটপাটের লীলাক্ষেত্রে পরিণত করতে পারলেন? আসলে, ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ক্রমেই হাসিনা নিজেকে একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী একনায়কের আসনে অধিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন। যেন তিনিই সবজান্তা, সব সিদ্ধান্ত তাঁরই, অন্য কারো প্রশ্ন করার কিংবা ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার নেই! আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদেরকে একে একে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। কোন মন্ত্রী, সংসদ–সদস্য কিংবা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের একজনও দলের নীতি–নির্ধারণী অবস্থানে ছিলেন না,তাঁর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানালেই ক্যারিয়ার শেষ। প্রয়াত মতিয়া চৌধুরী, আসাদুজ্জামান নুর, সাবের হোসেন চৌধুরী, সিমিন হোসেন রিমি, ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভী, এম,এ,মান্নান—তাঁদের কারো গায়ে দুর্নীতির আঁচড় না লাগা সত্ত্বেও হাসিনার পতনের পর ঐ লেবাস তো এখন সবার গায়ে লেগে গেলো! আমার মনে হচ্ছে, সাধারণ জনগণের মত তাঁরাও ধরে নিয়েছিলেন যে পরপর তিনটি নির্বাচনী প্রহসন সফলভাবে মঞ্চস্থ করা সত্ত্বেও ভারতের সমর্থনে যেহেতু হাসিনা ক্ষমতাসীন থেকে গেছেন তাই তাঁর জীবদ্দশায় এদেশে সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। একটি গণ–অভ্যুত্থানে হাসিনার পতন হতে পারে—এটা ২০২৪ সালের জুলাই মাসেও ছিল অচিন্তনীয়। হাসিনা ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের মত মহীরুহকে ১৯৯১ সালেই আওয়ামী লীগ থেকে উৎপাটিত করা সত্ত্বেও তাঁরা কোন রাজনৈতিক ঝড় তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, তোফায়েল আহমদ ২০১৪ সালেই কোনঠাসা অবস্থানে চলে গেছেন, ২০১৮ সালের পর অন্যান্য সিনিয়র নেতৃবৃন্দকেও ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন হাসিনা। এই ধারাবাহিকতায় জনগণের দল, মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ হাসিনার স্বৈরশাসনে রূপান্তরিত হয়ে গেলো ক্রোনি ক্যাপিটালিজম, ক্লেপ্টোক্রেসি (চৌর্যতন্ত্র) এবং গণ–ধিকৃত অলিগার্কিতে, দলটির পতন হলো গণধিকৃত ও ঘৃণিত একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য।
১৯৭৫–১৯৮১ পর্বে যে শেখ হাসিনা তাঁর জীবনের চরম দুঃসময়ে অভাব–অনটনের মধ্যে দিন কাটিয়েছিলেন তিনি কীভাবে ভুলে গেলেন যে এহেন একনায়কতন্ত্র বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘদিন মেনে নেবে না। বঙ্গবন্ধুর মত এত জনপ্রিয়তা বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক নেতার কপালে জোটেনি, কিন্তু বাকশাল গঠনের পথে এগিয়ে যাওয়ায় ১৯৭৫ সালে সে জনপ্রিয়তা তিনি অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার অপপ্রয়াসের অভিযোগ জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হওয়ায়। তাঁর হত্যাকান্ডের পর দেশের কোথাও একটা মিছিল পর্যন্ত হয়নি, সমর–প্রভুদের ভয়ের পাশাপাশি এর জন্য দায়ী ছিল তাঁর জনপ্রিয়তার ব্যাপক পতন। পরবর্তী পনেরো বছরে বঙ্গবন্ধুর সে জনপ্রিয়তা আবার ফিরে আসায় আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র–ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু, হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের স্বৈরশাসন, পরিবারতন্ত্র, দুর্নীতি, পুঁজি–লুন্ঠন, পুঁজি–পাচার ও ‘অলিগার্কিক তান্ডবের’ অবিশ্বাস্য যে ইতিহাস গত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তাঁকে দেশ থেকে জনগণের ‘ঐতিহাসিক প্রত্যাখ্যানের’ সম্মুখীন করে প্রাণভয়ে ভারতে পালাতে বাধ্য করলো এরকম ‘টোটাল গণ–অভ্যুত্থানের’ দ্বিতীয় নজির এদেশে অতীতে একটিও ছিল না। ঐদিন ঢাকাসহ সারা দেশে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষের মত মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল হাসিনাকে উৎখাতের মিছিলে। পালাতে দেরি করলে গণভবনে হাসিনাকে জনগণ ধরতে পারলে তাঁকে হয়তো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতো!
পতিত স্বৈরশাসক হাসিনা এদেশের রাজনীতি থেকে নিজেকে তো চিরদিনের জন্য অপাঙক্তেয় করে ফেললেনই, এর পাশাপাশি তিনি সাময়িকভাবে হলেও নির্বাসনে পাঠিয়েছেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকেও। এমনকি, এই গণ–অভ্যুত্থানে সুচতুরভাবে নেতৃত্ব দিয়ে রাষ্ট্র–ক্ষমতায় এসে গেছে জামায়াত–শিবিরের স্বাধীনতা–বিরোধী মহল, যাদের সুপরিকল্পিত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকেও জনগণের কাছে হেয়–প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে। হাসিনার পতনের পর গত আট মাসে সারা দেশে শেখ পরিবারের সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প–কারখানাগুলো হয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নয়তো লুটতরাজ ও ভাঙচুরের কবলে পড়ে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। অনেক আওয়ামী কোটিপতি এর মধ্যেই পথের ভিখারী হয়ে পড়েছে বলে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে। হাসিনা ও তাঁর পরিবার–আত্মীয়স্বজন হয়তো বিদেশে পাচার করা অর্থে আরাম–আয়েশে দিন–গুজরান করতে পারবে, কিন্তু লক্ষ লক্ষ আওয়ামী নেতা–কর্মীদের জীবন আরো বহুদিন ধরে দুর্বিষহ দারিদ্র্যপীড়িত হয়ে থাকবে নিশ্চিতভাবে। এহেন পরিণতি আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগকে বরণ করতে হবে সেটা কি কেউ স্বপ্নেও ভেবেছিল? স্বৈরশাসক হাসিনাকে সর্বপ্রথম বিচারের সম্মুখীন হতে হবে আট’শ এর বেশি মানুষকে হত্যার মামলায়। এর সাথে থাকবে দু’হাজারেরও বেশি মানুষকে আহত, অন্ধ ও পঙ্গু করার মামলাগুলো। এরপর আসবে গুমের মামলা এবং কয়েক লক্ষ কোটি টাকা অর্থ–লুটপাট ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলাগুলোর বিচারপর্ব। তাঁর পরিবার ও আত্মীয়–স্বজন, তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীরা এবং আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতা–কর্মী যারা এই লুটপাটে অংশগ্রহণকারী তাদেরকেও আগামী কয়েক বছর হয় দেশে–বিদেশে পালিয়ে থাকতে হবে নয়তো জেল–হাজতে বন্দী থেকে মামলাগুলো সামলাতে গলদঘর্ম হতে হবে। যে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার হাসিনা–গং লুটপাটের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে ঐ অর্থ কি হাসিনা ও তাঁর পরিবার–আত্মীয়–স্বজন কিংবা লুটেরা–অলিগার্কদের বাকি জীবনে শান্তি ও স্বস্তি এনে দিতে পারবে? একটা বিষয় খুবই লক্ষণীয় যে হাসিনার একজন আত্মীয়েরও নাম বলা যাবে না যিনি নিজের যোগ্যতায় উচ্চপদ অর্জন করতে পেরেছেন কিংবা এহেন ধন–সম্পদের মালিক হতে পেরেছেন, সবাই লুটপাটের অর্থেই কোটিপতি বনে গেছেন। হাসিনার একনায়কত্ব উৎখাতের পর দেশের অর্থনীতি বর্তমানে সাময়িক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেও ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থান যে জাতিকে এই লুটেরা শাসক পরিবারের বেলাগাম লুটপাটতন্ত্র থেকে মুক্তি দিয়েছে সেজন্য মহান আল্লাহতাআলাহকে হাজারো শোকরিয়া।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়