দুই বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে কয়েকটি বড় সংকটে রয়েছে সেগুলো হলো: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিপজ্জনক পতনের ধারা, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বেলাগাম মূল্যস্ফীতির প্রকোপ, প্রবাসী বাংলাদেশীদের রেমিট্যান্স প্রেরণে গেড়ে বসা হুন্ডি ব্যবসার ক্রমবর্ধমান প্রভাবে ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহে স্থবিরতা, ডলার সংকটের কারণে আমদানি এল/সি খুলতে জটিলতা, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে হু হু করে ডলারের দাম বেড়ে ২০২১ সালের ৮৭ টাকা থেকে ২০২৪ সালের মে মাসে ১২৭ টাকায় উল্লম্ফন, বাংলাদেশী টাকার বৈদেশিক মানের প্রায় ৪৭ শতাংশ অবচয়ন, আমদানিতে ওভারইনভয়েসিং ও রফতানিতে আন্ডারইনভয়েসিং পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ব্যাপক পুঁজি পাচার, হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ক্রমবর্ধমান ব্যাংকঋণ পাচার, খেলাপি ব্যাংকঋণ সমস্যার বিপজ্জনক অবনতি, রফতানি আয় দেশে ফেরত না এনে সেগুলো দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি–ব্যবসাপাতি ক্রয়, দুর্নীতি, পুঁজি লুন্ঠন ও পুঁজি পাচার সম্পর্কে সরকারের অব্যাহত নিষ্ক্রিয়তা, দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট একাউন্টে ঘাটতি পরিস্থিতি, ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের ফাইনেন্সিয়াল একাউন্টে ঘাটতি পরিস্থিতি এবং ২০২৩–২৪ অর্থ–বছরে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া। আরেকটু বিস্তৃতভাবে কয়েকটি সংকটের বর্তমান ভয়াবহতা দেখুন:
১) আইএমএফ এর নিয়ম অনুযায়ী ২০২৪ সালের মে মাসের শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ‘গ্রস রিজার্ভ’ ১৯ বিলিয়ন ডলারে এবং নিট রিজার্ভ (ব্যয়যোগ্য) ১৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অথচ, ২০২১ সালের আগস্টে সরকারের দাবি অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভ বেড়ে ৪৮.০৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল। (আইএমএফ সরকারের এই দাবি মানেনি)। দৈনিক বণিক বার্তা গত ১৯ মে ২০২৪ তারিখে হেডলাইন করেছে যে দুই বছরে আমদানি ব্যয় ৪০ বিলিয়ন ডলার কমিয়েও রিজার্ভের পতন থামানো যায়নি।
২) ২০২১ সালের আগস্টে দেশে এক ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা। গত দু’বছরে ডলারের দাম হু হু করে বেড়ে ২০২৪ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি ঘোষণার পর দাঁড়িয়েছে ১২৭ টাকায়। এর মানে, এই দুই বছরে টাকার বৈদেশিক মান কমপক্ষে ৪৭ শতাংশ অবচয়নের শিকার হয়েছে। টাকার এহেন অবচয়নের কারণে ২০২৩–২৪ অর্থ–বছরে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিএনআই ডলারের অংকে গত বছরের ২৭৬৫ ডলার থেকে সামান্য বেড়ে ২৭৮৪ ডলারে পৌঁছেছে, অথচ টাকার অংকে মাথাপিছু জিএনআই বেড়েছে ১২ শতাংশ।
৩) কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পতনকে থামাতে চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি, কারণ হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হওয়ায় ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো যাচ্ছে না। প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স গত ২০২০–২১ অর্থ–বছরের ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২–২৩ অর্থ–বছরে ২১.৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। বর্তমান অর্থ–বছরের শেষে ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স হয়তো আবার ২৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।
৪) কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে আমদানিকারকরা এল/সি খুলতে গিয়ে এখনো হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক আমদানিকারক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে ১৩০ টাকায় ডলার কিনে এলসি খুলছেন বলে পত্র–পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, যা দেশের মূল্যস্ফীতিতে ঘৃতাহুতির শামিল। অবশ্য, রফতানি আয়ের প্রবাহে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় কিছুটা স্বস্তি মিলছে।
৫) আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রফতানির আন্ডারইনভয়েসিং, রফতানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং হুন্ডি পদ্ধতিতে ব্যাংকঋণ বিদেশে পাচার—এই চারটি প্রধান অর্থ–পাচার প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ১৫–১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সংখ্যায় এসব পুঁজিপাচারকারী কয়েক হাজারের বেশি হবে না। দুর্নীতিবাজ সিভিল আমলা, প্রকৌশলী, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক, বিত্তবান ব্যবসায়ী কিংবা মার্জিনখোর রাজনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশের সমাজের উচ্চ–মধ্যবিত্ত, উচ্চ–বিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে তাদের অবস্থান। তারা দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমকে অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছে। তারা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ–লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছে। তারা রাজনীতিক পরিচয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুন্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী। তারা ৫৩ বছরের স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’ দুর্নীতি ও পুঁজিলুন্ঠনের মাধ্যমে অর্থ–বিত্তের মালিক হয়ে তাদের অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করে কানাডার টরোন্টোর ‘বেগম পাড়া’ এবং মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে।
৬) আমাদের মূল্যস্ফীতির হার সরকারের দাবি মোতাবেকই এখনো ৯.৬ শতাংশে রয়ে গেছে! সাধারণ ক্রেতাদের অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেবে যে প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্ফীতির হার আরো অনেক বেশি। ভারত ও শ্রীলংকা মূল্যস্ফীতিকে ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে সফল হলেও আমাদের ব্যর্থতা এক্ষেত্রে ন্যক্কারজনক।
উপরে উল্লিখিত সমস্যাগুলো বর্তমান শাসক মহলের ভুলের কারণেই সৃষ্ট। বিশেষত সাবেক অর্থমন্ত্রীর অদক্ষতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে বেশিরভাগ সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করেছে। অবশ্য, আমাদের বর্তমান শাসনব্যবস্থাকে আমার মতে ‘প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্ব’ বলাই সমীচীন। আবার এটাকে প্রধানমন্ত্রী ও জনাকয়েক ধনকুবের ব্যবসায়ীর ‘অলিগার্কি’ অভিহিত করলেও ভুল হবে না। উল্লিখিত সমস্যাগুলো সমাধানের অযোগ্য কোন বিষয় নয়, কিন্তু সমস্যাগুলো অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ভোগাচ্ছে। বিগত দিনগুলোতে সরকার খেলাপি ব্যাংকঋণ, পুঁজি পাচার, হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স প্রেরণ, দুর্নীতি দমন এবং স্বল্প–প্রয়োজনীয় মেগা–প্রকল্প গ্রহণের হিড়িকের ব্যাপারে যে ভুল অবস্থান গ্রহণ করে চলেছিল সেখান থেকে অবিলম্বে সরে আসতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলছি, ব্যাংকের প্রায় সাড়ে আঠার লক্ষ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ইতোমধ্যেই পাঁচ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি খেলাপিঋণে পরিণত হলেও রাঘব বোয়াল ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের’ বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে নানারকম অযৌক্তিক ছাড় দিয়ে খেলাপিঋণ লুকিয়ে ফেলার সুবন্দোবস্ত করে চলেছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী, যার ফলে দেশের সুপরিচিত বড় বড় ঋণখেলাপি প্রায় সবাই এখন ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নিজেদের নাম লুকিয়ে ফেলতে সমর্থ হয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি এখন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। গত পাঁচ বছরে খেলাপিঋণ পুনরুদ্ধারে বিন্দুমাত্র কোন সফলতা অর্জিত হয়নি। বরং, এই সমস্যা মোকাবেলার পরিবর্তে ব্যাংক মার্জার চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে খেলাপিঋণের কারণে নিমজ্জমান ব্যাংকগুলোকে উদ্ধারের প্রয়াস নেয়া হয়েছে।
২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল নির্ধারিত ‘স্বল্পোন্নত দেশের’ ক্যাটেগরি থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশের’ ক্যাটেগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ঐ প্রক্রিয়ার সফল পরিসমাপ্তির পর ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। গত দু’দশক ধরে বাংলাদেশের জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির হার ৫.৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮–১৯ অর্থ–বছরে ৮.১৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনা ভাইরাস মহামারির আঘাতে ২০১৯–২০ অর্থ–বছরে প্রবৃদ্ধির হার ৩.৮ শতাংশে নেমে গেলেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৯ অর্থ–বছরের ১৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন তারিখে ২৭৬৫ ডলারে এবং ২০২৪ সালের মে মাসে ২৭৮৪ ডলারে পৌঁছেছে বলে সরকার দাবি করছে।
এহেন সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে অর্থনীতি যে স্বস্তিকর অবস্থানে থাকার কথা তার পরিবর্তে অর্থনীতিতে সংকট জটিল আকার ধারণ করা অস্বাভাবিক হলেও এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার জো নেই। জিডিপি প্রবৃদ্ধি বর্তমান ২০২৩–২৪ অর্থ–বছরে ৫.৮ শতাংশে নেমে যাবে বলে বিশ্ব ব্যাংক প্রক্ষেপণ ঘোষণা করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালের দুর্নীতির র্যাংকিং অনুযায়ী বাংলাদেশ আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের র্যাংকিং অনুসারে ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল খারাপের দিক্ থেকে ১০ নম্বরে। ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করলেও সরকার এই অঙ্গীকার পূরণকে ‘বাত্ কা বাতে’ পর্যবসিত করেছে। হুন্ডি ডলারের চাহিদার দিক্ বিবেচনা করলে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় বিদেশে পুঁজি পাচারের সাথে দুর্নীতির ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারভাবে কঠোর না হলে পুঁজি পাচার দমন অসম্ভব। পুঁজি পাচার দমন না করলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামানো যাবে না।
অর্থনীতি বিপদে পড়ার আরেকটি বড় কারণ প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে একের পর এক মেগা–প্রজেক্ট গ্রহণের খামখেয়ালি বাতিক্ ও হিড়িক। বাংলাদেশে গত এক দশকে অনেকগুলো মেগা–প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হয়েছে কিংবা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে যেগুলোর কয়েকটিকে স্বল্প–প্রয়োজনীয় অথবা অপ্রয়োজনীয় বলা চলে। ভাল ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ ছাড়াই এসব প্রকল্প গৃহীত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। চলমান প্রকল্পের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে যশোর এবং পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প, ঢাকা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস্তবায়নাধীন বিআরটি প্রকল্প এবং চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প ‘সাদা হাতি’ প্রকল্পের নিকৃষ্ট উদাহরণ। এখন আবার রূপপুরে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প গ্রহণের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের পরিবর্তে যদি এহেন চটকদার ও স্বল্প–প্রয়োজনীয় প্রকল্প গৃহীত হতে থাকে তাহলে কয়েক বছরের মধ্যে শ্রীলংকার মত ঋণগ্রস্ততার ফাঁদে বাংলাদেশও পড়তে পারে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এহেন ‘সাদা হাতি’ প্রকল্পগুলো যে ইতোমধ্যেই দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধকে বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে গেছে সেটা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নয়। ২০২৩–২৪ অর্থ–বছরের বাজেটে বৈদেশিক ঋণের সুদাসল পরিশোধ খাতে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার চাইতে এ–বছর প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বেশি খরচ হবে এই খাতে। মেগা–প্রজেক্টগুলোর ঋণ পরিশোধের ‘গ্রেস–পিরিয়ড’ শেষ হলে আগামী অর্থ–বছরগুলোতে এই খাতে বরাদ্দ আরো অনেক দ্রুতগতিতে বাড়বে ২০৩০ সাল পর্যন্ত। সরকারের কর–জিডিপি’র অনুপাত যেখানে ৮ শতাংশে নেমে গেছে সেখানে ঋণ পরিশোধের জন্য দ্রুতবর্ধমান বাজেট–বরাদ্দ অশনি সংকেতের শামিল।
বাজেটকে সামনে রেখে আরেকটি বিষয়কে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করতেই হবে, সেটা হলো ক্রমহ্রাসমান কর–জিডিপি অনুপাত। কর–জিডিপি অনুপাত কমতে কমতে ৮ শতাংশের কাছাকাছি এসে গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। কর–জিডিপি’র অনুপাত কমতে থাকায় বাজেটের ব্যয়–সংকুলানের জন্য সরকারী ঋণের বোঝা বাড়ছে। প্রত্যক্ষ করের অবদান কর–রাজস্বের এক–তৃতীয়াংশ, বাকি দুই–তৃতীয়াংশ আসে পরোক্ষ কর থেকে। এর মানে, দেশে করের মূল বোঝা বহন করে চলেছে সাধারণ জনগণ। সমাজের উচ্চবিত্ত গোষ্ঠি এদেশে দুর্নীতির মাধ্যমে কর ফাঁকি দেওয়ায় এতখানি পারঙ্গম রয়ে গেছে যে তারা ‘ন্যায্য করের বোঝা’ থেকে রেহাই পেয়েই চলেছে।
সবশেষে বর্তমান মারাত্মক রাজনৈতিক সংকটের কথা বলতেই হবে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোটের গণতন্ত্র পুরোপুরি লাইনচ্যুত হয়ে গেছে। ঐ নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালট জবরদখলের মোটেও প্রয়োজন ছিল না, মহাজোট এমনিতেই সুষ্ঠু নির্বাচনে জিতে আসত। কিন্তু, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব জনগণের নাড়িস্পন্দন বুঝতে পারেননি। বিএনপিও বিলেতে পলাতক তারেক রহমানের নির্দেশে চাণক্য–চাল চালছে প্রতিটি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। এদেশে অদূর ভবিষ্যতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরত আসবে না। দেশে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আরেকটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবারের নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৪টি আসনে জয়ী হয়েছে। কিন্তু, ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী যাঁরা জয়ী হয়েছেন তাঁদের মধ্যে ৬ জন ছাড়া ৫৬ জন আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী হওয়ায় ২৮০টি আসনে আওয়ামী লীগই বিজয়ী হয়েছে বলা চলে। (জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ এবং কল্যাণ পার্টির বিজয়ী প্রার্থীরাও আওয়ামী লীগ–সমর্থিত)। নির্বাচনের দিন বিকেল তিনটায় নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছিল তখন পর্যন্ত ২৭.১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে, যেটাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। ভোটের পর এখন তারা বলছে, নির্বাচনে ৪১.৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। শেষের এক ঘন্টায় ১৪.৮৪ শতাংশ বৈধ ভোট পড়ার বিষয়টি একেবারেই অবিশ্বাস্য! গণতন্ত্রের এই সংকট অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে বড়সড় বাধা হিসেবেই থেকে যাচ্ছে।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।