সামরিক অভিধান থেকে ‘মার্শাল ল’ মুছে ফেলার আহ্বান
গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে সশস্ত্র বাহিনীর সিলেকশান বোর্ডের একটি ভার্চুয়াল মিটিংয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামরিক বাহিনীর অভিধান থেকে ‘মার্শাল ল’ শব্দটি মুছে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘পাগলকে সাঁকো না নাড়াতে’ বলার মত বিপজ্জনক উক্তি হলেও এই সাহসী বক্তব্যের জন্যে তাঁকে অভিনন্দন। তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্রের একটা দুরারোগ্য ব্যাধির প্রতি আবারো জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যে ব্যাধিটা উত্তরাধিকারসূত্রে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নারকীয়ভাবে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলের যে সূচনা হয়েছিল ৪৫ বছরে চারবার তার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ‘এক-এগারোর’ এপিসোডের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন ড. ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে প্রকৃতপক্ষে একটা ছদ্মবেশী সামরিক সরকার ছিল সেটা এখন সারা বিশ্ব জানে। আমার দুঃখ হলো ড. ফখরুদ্দিনের মত একজন সজ্জন সেটা বোঝার পরও কেন তাদের শিখন্ডী হিসেবে নিজকে ব্যবহৃত হতে দিলেন! এক-এগারোর দিন থেকেই যে এটার পেছনে সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের একটা সুনির্দিষ্ট ‘নীল নকশা’ ছিল তা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা ছিল না। কিন্তু, বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়ার শিখন্ডী রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কবল থেকে মুক্তিলাভের জন্যেই হয়তো শেখ হাসিনা ঐ সরকারকে স্বাগত জানিয়েছিলেন! কিছুদিনের মধ্যেই ঐ সরকারের ব্যাপারে তাঁর হতাশার প্রমাণ আমি পেয়েছিলাম ২০০৭ সালের ৬ মার্চ ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশান মিলনায়তনে একটি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়। অনুষ্ঠানটি ছিল ‘সাতই মার্চ স্মারক বক্তৃতা’ প্রদানের, যে বক্তৃতা প্রদানের জন্যে শেখ হাসিনা বাংলা একাডেমির বর্তমান সভাপতি ড. শামসুজ্জামান খানের মাধ্যমে আমাকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের পর মঞ্চের পেছনের গ্রীনরুমে চা-নাস্তা খাওয়ার সময় শেখ হাসিনা আমার সাথে আলাপে খুবই উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলেছিলেন, ‘এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। আমি ওটা ঠেকানোর চেষ্টা করলেও পেরে উঠছি না, বোধ হয় জাতির ওপর বিপদ নেমে আসছে’। ঐ অনুষ্ঠানটিই ছিল ২০০৭ সালে গ্রেফতার হওয়ার আগে শেখ হাসিনার অংশগ্রহণ করা সর্বশেষ অনুষ্ঠান। তিনি এর কিছুদিন পরই ‘মাইনাস-টু’ ফর্মুলার শিকার হয়ে শেরে বাংলা নগরের সাব-জেলে ‘সলিটারী কনফাইনমেন্টে’ নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। তাঁকে গ্রেফতারের সময় যেভাবে তাঁর বাসভবন ‘সুধা সদনে’ তাঁর স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়াকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল, এবং তাঁকেও টেনে-হিঁচড়ে অপমান করে গাড়িতে তোলা হয়েছিল ও জেলে গাড়ি থেকে নামানো হয়েছিল মুক্তিলাভের পর তার বর্ণনা দিতে গিয়ে শেখ হাসিনা মিডিয়ার সামনে অবরুদ্ধ কান্নায় বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, অনেকের হয়তো ছবিটা আজীবন মনে থাকবে। ঐ অপমানজনক আচরণের সাথে এর কিছুদিন পর বেগম জিয়ার গ্রেফতারের ‘ভদ্র আদব-কায়দা ও তাজিম-পূর্ণ’ চিত্রটা সবার আরেকবার দেখা উচিত মনে করি।
ইতোমধ্যে প্রমাণিত যে আসলে ২০০৭-৮ সালের এপিসোডটা ‘মাইনাস টু’ নয়, ওটা ছিল ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্মুলা, মানে ‘মাইনাস হাসিনা’–বাকিটুকু সাজানো নাটক। ঐ সময়ের ডিজিএফআই এর একজন কুশীলব মেজর জেনারেল রুমীর বয়ানেই পরবর্তীতে খোলাসা হয়েছে যে ’আচরণগত সমতা বিধানের’ জন্যেই নাকি বেগম জিয়াকে গ্রেফতারের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। তারেক জিয়ার হঠকারিতা ও অপমানজনক আচরণের বদলা নেয়ার জন্যেই বিএনপিকে পরবর্তীতে টার্গেট করা হয়েছিল বলে যে কথা বাজারে রয়েছে তারও ভিত্তি রয়েছে। এখন অবশ্য জেনারেল মইন ইউ আহমদ দাবি করছেন, ২০০৭ সালে ক্ষমতা নেয়ার ইচ্ছা থাকলে তাঁকে থামাবার সাধ্য কারোই ছিল না। (তাঁর দম্ভোক্তি স্মর্তব্য: ‘নো ফাদার’স সন কুড হেভ স্টপড্ মি ইফ আই ওয়ান্টেড ইট’–মানে আমি ক্ষমতা নিতে চাইলে কোন বাপের বেটার সাধ্য ছিল না আমাকে রুখতে।) আর, পর্দার আড়াল থেকে ঐ সরকারের আসল হর্তা-কর্তা ছিল ডিজিএফআই-এর ফজলুল বারী এবং আমিন নামের দুই মহারথী, যারা জামাআতে ইসলামীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছে বারবার। ঐ বীরপুঙ্গব দুজন এখন বার বছর ধরে বিদেশে পলাতক। আল্লাহকে হাজার শোকরিয়া যে ২০০৭-৮ সালের সামরিক সরকারের আসল রূপটা ২০০৭ সালের আগস্ট মাসেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাগুলোর মাধ্যমে ধরা পড়ে গিয়েছিল, এবং বিএনপি-জাতীয় পার্টির মত আরেকটি ক্যান্টনমেন্ট-প্রসূত ‘কিংস্ পার্টির’ দুঃশাসনের আশংকা থেকে জাতি পরিত্রাণ পেয়েছিল। ২০১৩-১৫ পর্যায়ে আবারো ‘উত্তর পাড়া’র কাছে ধর্ণা দেওয়া হয়েছিল, শেখ হাসিনা তার প্রতিও ইংগিত করেছেন ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে। রাজধানীর খামারবাড়িতে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি তিনি সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, ‘উত্তরপাড়ার দিকে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই’। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী মোতাবেক ভবিষ্যতে কেউ অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা দখল করলে তার ‘ক্যাপিট্যাল পানিশমেন্ট’ হয়ে যাবে তা-ও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, শাস্তির ভয় দেখিয়ে সামরিক অভ্যুত্থানকারীদেরকে নিবৃত্ত করা যায় কি? নিচের বিশ্লেষণ কী বলছে?
সামরিক শাসনের ব্যাপারে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান রাষ্ট্রটির ওপর এখনো সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের যে প্রবল আধিপত্য বহাল রয়ে গেছে সেটাকে ‘অনুন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতির’ তত্ত্বে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের (ব্যুরোক্রেটিক স্টেট) ক্লাসিক নজির হিসাবে ১৯৭৫ সালেই তুলে ধরেছেন বিশ্বখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী হামজা আলাভী। কার্ল মার্ঙের ‘রিলেটিভ অটোনমি অব দি স্টেট’ ধারণার ভিত্তিতে ঔপনিবেশিক দখলদারি থেকে স্বাধীন হওয়া উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোতে কেন সামরিক একনায়করা কিছুদিন পরপর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে থাকে তার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা হিসাবে হামজা আলাভীর ঐ তত্ত্বে ‘অতিবিকশিত রাষ্ট্রের পাশাপাশি শ্রেণীসমূহের অনুন্নয়নকে’ ফোকাসে নিয়ে আসা হয়েছে। পাকিস্তানের ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার সময় ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের সেনাবাহিনীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পাকিস্তানের ভাগে পড়েছিল। আর, এলিট আইসিএস আমলা যাঁরা পাকিস্তানে যাবার অপশান দিয়েছিলেন তাঁরা অতি দ্রুত জেনারেলদের সাথে গোপন আঁতাত গড়ে তুলে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। ফলে, স্বাধীনতা লাভের কয়েক মাসের মধ্যেই প্রথম কাশ্মীর যুদ্ধের পটভূমিতে এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর যক্ষ্মা রোগ মারাত্মক পর্যায়ে চলে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে তাঁকে বেলুচিস্তানের জেয়ারতের শৈলনিবাসে স্বাস্থ্য উদ্ধারের নামে নির্বাসনে পাঠিয়ে ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে ব্যবহার করে পাকিস্তানের আর্মি এস্টাবলিশমেন্ট এবং সিভিল আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রক্ষমতার নেপথ্য নিয়ন্ত্রণ কব্জা করে নিয়েছিল। ঐ পর্যায়ে নেপথ্য নায়ক ছিলেন দুজন জেনারেল আইউব খান এবং ইসকান্দার মির্জা এবং চীফ সেক্রেটারি মির্জা গুলাম মোহাম্মদ। কিছুদিনের মধ্যেই লিয়াকত আলী খানও ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়েছিলেন, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার আততায়ীর গুলিতে ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর তিনি নিহত হয়েছিলেন। ১৯৪৮ সাল থেকে এক দশক পাকিস্তানের রাজনীতিকে পর্দার আড়াল থেকে এই দুই গোষ্ঠী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুরব্বীয়ানায় কিভাবে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল, এবং পাকিস্তানের বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদদেরকে তাদের ইচ্ছামতোন খেলিয়েছিল সে ইতিহাস এখন সারা বিশ্ব জানে। একইসাথে স্বাধীনতা অর্জনকারী ভারত ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি নিজেদের সংবিধানের অধীনে প্রজাতন্ত্রে পরিণত হলেও ঐ নেপথ্যের কুশীলবদের চাণক্য-চালের শিকার হয়ে পাকিস্তানের সংবিধান চালু হয়েছিল ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ। তা-ও ঐ সংবিধানের অধীনে গঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন জেনারেল ইসকান্দার মির্জা। এরপর যখন সংবিধান মোতাবেক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠছিল তা ভন্ডুল করার জন্য ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর ইসকান্দার মির্জা এবং আইউব খান ‘মার্শাল ল’ জারি করে সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন। ঐ ঘটনার ২০ দিনের মাথায় ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর আইউব খান ইসকান্দার মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেই প্রেসিডেন্টের গদিতে আসীন হয়েছিলেন। দুঃখজনক হলো, এর ফলে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ১১ বছর আড়াই মাসে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের লীলাক্ষেত্র পাকিস্তানে চারজন গভর্নর জেনরেল, সাতজন প্রধানমন্ত্রী এবং দুজন প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্য রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হলেও ১৯৪৮ সালের এপ্রিল থেকে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ কখনোই সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট এবং সিভিল আমলাতন্ত্রের হাতছাড়া হয়নি। এর পরের ১৩ বছরের ইতিহাস আইউব খান এবং ইয়াহিয়া খানের সরাসরি সামরিক একনায়কত্বের ইতিহাস। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ঐ দুই গোষ্ঠীর করতলগত রাখার জন্য সুপরিকল্পিত ছক সাজিয়েছিল, কিন্তু স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতির চেতনার জোয়ার যে কতোখানি প্রবল হয়ে উঠেছিল তা হিসাব করতে তাদের ভুল হয়ে গিয়েছিল। উপরন্তু, নির্বাচনী প্রচারের শেষ পর্যায়ে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং অচিন্তনীয় ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও সরকারের অমানবিক অবহেলা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে ভোটের মাধ্যমে তারা এই অবহেলা ও অপমানের প্রতিশোধ নেবে। এরই প্রতিফলন ছিল আওয়ামী লীগের ভূমিধস নির্বাচনী বিজয়; ইয়াহিয়ার সাজানো ছক তছনছ হয়ে গিয়েছিল ঐ চেতনার প্লাবনের সাথে গণরোষ যুক্ত হওয়ার ফলে উত্থিত আওয়ামী লীগের প্রবল জনসমর্থনের সুনামিতে। এতদ্সত্ত্বেও সামরিক জান্তা পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ’ পূর্ব পাকিস্তানকে দখলে রাখতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করায় মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে এক নদী রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে। অতএব, ১৯৪৮ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের ইতিহাস পুরোটাই ছিল প্রকৃত বিবেচনায় রাষ্ট্রক্ষমতা সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট এবং সিভিল আমলাতন্ত্রের করায়ত্ত থাকারই ইতিহাস।
১৯৭২-৭৫ পর্বে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের মত রাষ্ট্রক্ষমতা-নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করতে পারেনি। বরং, তখনকার যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অর্থনীতির বাস্তবতায় অপ্রতুল ব্যয়-বরাদ্দ সামরিক বাহিনীতে অসন্তোষ সৃষ্টি করছিল। ঐ তুলনামূলক বঞ্চনা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল ভারতের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রক্ষী বাহিনীর মত প্যারা-মিলিশিয়া ফোর্স গড়ে তোলার ভুল সিদ্ধান্ত। ১৫ আগস্টের ঘাতকরা যে সামরিক বাহিনীর ঐ অসন্তোষকে তাদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সফল করার জন্য ব্যবহার করতে পেরেছিল তা এখন আমরা সবাই জানি। অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নেয়া, এটা এখন প্রমাণিত। জিয়াউর রহমান যে ঘাতকদের পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন তা-ও কর্নেল রশীদের বয়ানে সারা বিশ্ব এখন জানতে পেরেছে। তাঁর শাসনামলে শুধু নাম আর মানচিত্র ছাড়া বাংলাদেশে যে সুপরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, সেটাও আর কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রপতি পদে ক্ষমতাসীন থেকে দেশের সামরিক এস্টাবলিশমেন্টকে ব্যবহার করে জিয়াউর রহমান যে বিএনপিকে গড়ে তুলেছেন তার রাজনীতি এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে কট্টর আওয়ামী লীগ-বিরোধিতা, পাকিস্তান-প্রীতি, মার্কিন-প্রীতি, ক্যান্টনমেন্ট-প্রীতি, সাম্প্রদায়িকতা, স্বাধীনতা-বিরোধী ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী-নির্ভরতা এবং সন্ত্রাসী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে চ্ছত্রছায়া প্রদানের মত নেতিবাচক কৌশলের ওপর। এসব নেতিবাচক কারণে বিএনপির একটা বিশাল ভোটব্যাঙ্ক গড়ে উঠলেও তাদের মতাদর্শিক ভিত্তি আগাগোড়াই নড়বড়ে রয়ে গেছে, ক্ষমতাসীন জোটকে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করার মুরোদ নেই তাদের। সেজন্যে ‘উত্তর পাড়ার’ ষড়যন্ত্র চলবেই।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর,
অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়