ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে হুমকি দিয়েছেন যদি ভারত রাশিয়ার তেল আমদানি বন্ধ না করে তাহলে ২৭ আগস্ট ২০২৫ তারিখ থেকে শুল্কের হার ৫০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। তিনি আরো নানা রকম জরিমানা আরোপেরও হুমকি দিয়ে রেখেছেন। তাঁর যুক্তি হলো, ভারত সস্তায় রাশিয়ান ক্রুড–অয়েল আমদানি করে সেগুলো ভারতীয় রিফাইনারিগুলোতে পরিশোধিত করে অনেক বেশি দামে ইউরোপের দেশগুলোতে রফতানির মাধ্যমে বিশাল মুনাফাবাজি করছে। এর ফলে ভারত প্রকৃত প্রস্তাবে রাশিয়াকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সফলভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থের যোগান দিয়ে চলেছে। রাশিয়া ভারতকে তেলের দামে বিশাল ছাড় দিচ্ছে, কারণ ইউরোপের দেশগুলো ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের পর নিষেধাজ্ঞার অধীনে আসায় রাশিয়ার তেল আমদানি করতে পারছে না। (অতি–সম্প্রতি রাশিয়া ভারতকে তেলের দামে আরো ৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট দিয়েছে)। এখন তারা ভারতের মধ্যস্থতায় পরোক্ষভাবে রাশিয়ার পরিশোধিত তেল আমদানি করে অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ভারত নিজেদের তেল আমদানির মাত্র ১ শতাংশ রাশিয়া থেকে আমদানি করত, কিন্তু গত তিন বছরে রাশিয়া থেকে ভারতের ক্রুড–অয়েল আমদানি ভারতের মোট ক্রুড–অয়েল আমদানির ৩৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে। এই মুনাফাদায়ক তেল বাণিজ্যের মাধ্যমে ভারত গত তিন বছরে ১৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ট্রাম্পের ঘোষিত শুল্ক–যুদ্ধ চালু থাকলে ভারতের অর্থনীতি আগামী দিনগুলোতে বড় ধরনের ধাক্কা খাবে, ভারতের বস্ত্র শিল্প ও তৈরি–পোশাক শিল্পের রফতানি মার্কিন বাজার থেকে উৎখাত হওয়ার আশংকাকেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
ভারতের দাবি হচ্ছে, তারা রাশিয়া থেকে তেল আমদানির সবচেয়ে বড় ক্রেতা নয়। চীন ভারতের চাইতেও অনেক বেশি ক্রুড–অয়েল রাশিয়া থেকে আমদানি করে থাকে, অথচ ট্রাম্প চীনের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করেনি। তারা বলছে, শুল্ক–বৃদ্ধির প্রধান কারণ লুকিয়ে আছে অন্যত্র। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় বার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে দায়িত্ব গ্রহণের পর বিশ্বের অধিকাংশ দেশের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব শুল্ক–যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন, যা নিয়ে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষত, ব্রিকস দেশগুলো তাঁর এই শুল্ক–যুদ্ধের প্রত্যক্ষ শিকার। ব্রাজিলের ওপর ৫০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপিত হয়েছে। ভারতের ওপর ২৭ আগস্ট ২০২৫ তারিখে শুল্কের হার ৫০ শতাংশে বৃদ্ধির হুমকি দিয়ে রেখেছেন ট্রাম্প। চীনের ওপর শুল্কের হার ৯০ দিনের জন্য ৩০ শতাংশে স্থগিত করা হলেও সেটা যে আবার বাড়ানো হবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে, রাশিয়ার ৩০০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ জব্দ করা হয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অভিযোগে ইরানের ওপরও নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা ২০১০ সাল থেকে জারি রেখে ইরানের অর্থনীতিকে ধসিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ডিঙিয়ে চীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি হয়ে যাচ্ছে এই বাস্তবতা আসলে ট্রাম্প কোনমতেই মেনে নিতে পারছেন না। ‘মেক অ্যামেরিকা গ্রেট এগেন’ স্লোগান দিয়ে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অতএব, যেভাবেই হোক্ তিনি ব্রিকসের উত্থানকে নস্যাৎ করতে বদ্ধপরিকর। ভারতকে ব্রিকসের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করার জন্য হয়তো উচ্চ–শুল্কের জালে জড়িয়েছেন ট্রাম্প। শুল্ক–বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে, অন্যদিকে চীনের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে, বুমেরাং হয়ে ট্রাম্পর শুল্ক–যুদ্ধ ব্রিকসের অগ্রগতিকে আরো জোরদার করবে।
সম্প্রতি ব্রাজিলের রিও–ডি–জেনেরোতে ব্রিকসের সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে। ব্রিকসের ১১ সদস্য দেশসহ মোট ৩৫টি দেশের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনে ব্রিকসের সদস্য দেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের পরিবর্তে ব্রিকসের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত রাশিয়ার কাজান সম্মেলনে গৃহীত হয়েছিল তা ত্বরান্বিত করার প্রয়োজনীয়তাকে আবারো অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই ব্রিকস কারেন্সি বিশ্ব–বাণিজ্যে ডলারের আধিপত্য অনেকখানি খর্ব করবে বলে দাবি করা হচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির মালিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নাগপাশের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ার হলো মার্কিন ডলার, যে নাগপাশ থেকে তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশই নিজেদেরকে মুক্ত রাখার অবকাশ বা সুযোগ এখনো সৃষ্টি হয়নি। ১৯৪৪ সালের ব্রেটন উডস্ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯৪৭ সালে সৃষ্ট ইন্টারন্যাশনাল মোনেটারি ফান্ড (আইএমএফ) বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মাধ্যমে এই হাতিয়ারের জাল–বিস্তার শুরু হয়েছিল এর পূর্ববর্তী বৃটিশ পাউন্ড স্টার্লিং এর পরিবর্তে মার্কিন ডলারকে বিশ্বের যাবতীয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মুদ্রা–বিনিময় ও অর্থ–লেনদেনের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও বহুল–ব্যবহৃত মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে। আইএমএফ এর সিস্টেমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক গ্যারান্টির ভিত্তিতে ৩৫ ডলারে এক আউন্স সোনার দাম নির্ধারণ ও স্থিতিশীল রাখার মাধ্যমে এই ‘ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ চালু হয়েছিল। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আইএমএফ এর ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম কাজ করলেও বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষের দিকে ‘ডলার ক্রাইসিস বা গোল্ড ক্রাইসিসের’ সময় সিস্টেমটা ভেঙে পড়ে। স্বর্ণের দাম ঐ সময় হু হু করে বাড়তে বাড়তে এক আউন্স তিন’শ ডলার ছাড়িয়ে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করে, যার ফলে আইএমএফ এর ‘ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ ভেস্তে যায়। এর পরিবর্তে চালু করা হয় ‘ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’, যেখানে স্বর্ণের দাম এবং বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বৈদেশিক দাম নির্ধারণ আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। (২০২৫ সালের আগস্টে এক আউন্স স্বর্ণের দাম ৩,৭০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে)। ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেমের কারণে ক্রমে ক্রমে সারা বিশ্বে পরম শক্তিশালী হয়ে উঠে মুদ্রা বেচাকেনার বাজার। ২০২৫ সালে এই ‘কারেন্সি কেনাবেচার বাজারে’ মুদ্রা লেনদেন প্রতিদিন চার ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে, যেখানে এক বছরে ‘ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট‘ (এফডিআই) হয় ৮০০ বিলিয়ন ডলারের মত। চলমান তথ্য–প্রযুক্তি–বিপ্লবের কারণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারের দক্ষতা আকাশচুম্বী হয়ে পড়ছে ক্রমশ। বিশ্ব–মুদ্রা–বাজারের একাধিপত্য ৫৩ বছর ধরে বহাল রেখেছে মার্কিন ডলার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বের জনগণ প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণহানি সহ যে ভয়াবহ ধ্বংসলীলার সম্মুখীন হয়েছিল তার ফলে ঔপনিবেশিক কাঠামো পরিত্যাগ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল মনে করা হলেও প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্ব–যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ শুধু রূপ ও কৌশল পরিবর্তন করেছে, সাম্রাজ্যবাদ এখনো বিশ্ব–রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রধান নিয়ামক হিসেবে অটুট রয়ে গেছে। তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ ১৯৪৫–৭৫ পর্বে সরাসরি ঔপনিবেশিক দখলদারি থেকে ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও সাম্রাজ্যবাদী–রাজনৈতিক আধিপত্য ও অর্থনৈতিক পরনির্ভরতার এক অবিচ্ছেদ্য জালে প্রায় সব দেশ গত ৮০ বছর ধরে আটকা রয়েছে। বিশ্ব–সাম্রাজ্যবাদের এই ‘আধিপত্য–পরনির্ভরতার’ জটাজালে সবচেয়ে ক্ষমতাধর অধিপতির ভূমিকা পালন করে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যাদের বিশ্ব–আধিপত্য (হেজিমনি) এখনো বহাল রয়েছে।
মার্কিনীদের রফতানি আয় আমদানি ব্যয়ের চাইতে প্রতি বছর অনেক কম হওয়ায় তাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট একাউন্টে নিয়মিতভাবে ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট বাণিজ্য–ঘাটতি ইতোমধ্যে ৩৭ ট্রিলিয়ন (৩৭ লক্ষ কোটি) ডলার অতিক্রম করেছে। অন্য কোন দেশ এরকম ঘাটতিতে পড়লে ঐ দেশের মুদ্রার বৈদেশিক মানে ধস নামতো, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে একেবারেই ব্যতিক্রম। তাদের মুদ্রা ডলার যেহেতু বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের বৈদেশিক–মুদ্রা–রিজার্ভের প্রধান অংশ তাই কোন দেশই চায় না ডলারের বৈদেশিক মানে ধস নামুক্। উদাহরণ হিসেবে চীনের ব্যাপারটা উল্লেখ করা যেতে পারে: চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক–মুদ্রা–রিজার্ভের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদের মুদ্রাকে ডলারের সাথে একটা স্থিতিশীল সম্পর্কে বহাল রাখতে চায়। নয়তো একদিকে তাদের কাছে ডলারের যে বিশাল মজুত রয়েছে তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে তাদের রফতানী পণ্যের প্রতিযোগিতা–সক্ষমতা ক্ষুণ্ন হবে। বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ হয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক আধিপত্য অক্ষুণ্ন রাখতে সমর্থ হচ্ছে মার্কিন ডলারের এই ‘আনচ্যালেঞ্জড হেজিমনি’র কারণে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বৈদেশিক মান ডলার–প্রতি অফিশিয়ালি ৪.৭৬ টাকা হলেও আনঅফিশিয়ালি ছিল পনেরো টাকা। এখন এক ডলারের বাজার দাম ১২১–১২২ টাকা। গত তিন বছরে টাকার বৈদেশিক মান ৪২ শতাংশেরও বেশি অবচয়ন হলেও গত ৯ মাস ধরে ডলারের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। এর ফলে স্বৈরাচারী হাসিনার সরকারের আমলে আমাদের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গিয়েছিল এবং আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বড়সড় ধস নেমেছিল। অথচ আমরা এখনো ‘ ফ্রিলি–ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ চালু করিনি, ক্যাপিটাল একাউন্টে টাকা এখনো অবাধে বিনিময়যোগ্য করা হয়নি। (অবশ্য, গত কয়েক মাস ধরে রিজার্ভের এই পতন থামানো গেছে)। শুধু আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি না, ডলারের দামকে স্থিতিশীল রাখার জন্য সব উন্নয়নশীল দেশের সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়াস জারি রাখা সত্ত্বেও দিনদিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াকে থামাতে অসমর্থ হচ্ছে এসব দেশ। (পাকিস্তানে এক ডলারের দাম এখন ২৮০ রুপির আশেপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, যার ফলে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৩০ শতাংশে পৌঁছে গেছে)। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ এজেন্ট আইএমএফ তৃতীয় বিশ্বের সব দেশের ওপর সার্বক্ষণিক চাপ অব্যাহত রেখে চলেছে ক্রমশ ডলারের দাম দেশীয় মুদ্রায় বাড়ানোর ব্যাপারে। তাদের মতে সকল তৃতীয় বিশ্বের দেশে ডলারের তুলনায় মুদ্রাগুলো ‘অতিমূল্যায়িত’ রয়ে যাচ্ছে, তাই মুদ্রার অবচয়ন (ডেপ্রিসিয়েশন) আইএমএফ এর প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে সব সময় অন্তর্ভুক্ত থাকে। মনে রাখা প্রয়োজন, আইএমএফ সার্বক্ষণিকভাবে এই দাবি করে চলেছে মার্কিন ডলারকে মদদ দেওয়ার জন্য। ব্রিকস নিজস্ব কারেন্সি চালু করার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মার্কিন ডলারের বিশ্ব–অধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে তুলেছে। ক্রয়ক্ষমতা সাম্য নীতির ভিত্তিতে ব্রিকস দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি এখন বিশ্বের মোট জিডিপি’র ৩৭ শতাংশে পৌঁছে গেছে, এবং এই অনুপাত ক্রমবর্ধমান। বিশ্বের জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশ ব্রিকসের ১১টি সদস্য দেশের অধিবাসী। রাশিয়ার কাজান সম্মেলনে আরো ১৩টি দেশকে ব্রিকসের ‘পার্টনার কান্ট্রি’ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। মনে হচ্ছে, আগামী এক দশকে ডলারের বিশ্ব–আধিপত্য খর্ব হয়ে যাবে।
আমরা অনেকেই খেয়াল করি না যে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পুঁজি পাচার হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্বের সকল দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে অভিবাসনের স্বর্গরাজ্য বিবেচিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। হাসিনার স্বৈরশাসনের সময় বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর যে ১৫–১৬ বিলিয়ন ডলার চারটি প্রধান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছিল বলে ধারণা করা হয় সেগুলোরও প্রধান গন্তব্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই চারটি প্রক্রিয়া হলো: ১) আমদানিতে ওভারইনভয়েসিং, ২) রফতানিতে আন্ডারইনভয়েসিং, ৩) রফতানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং ৪) হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে রেখে দিয়ে তার বিনিময়ে দেশের পুঁজি পাচারকারীরা হুন্ডিওয়ালাদের কাছে সমপরিমাণ টাকা পরিশোধ করে সহজেই অর্থ–পাচার সম্পন্ন করা। সাবেক হাসিনা সরকারের আমলে এই হুন্ডি প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ব্যাংকের ঋণ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছিল, এবং প্রথমোক্ত তিনটি প্রক্রিয়ার তুলনায় ঐ সময় হুন্ডি পদ্ধতিতে অর্থ–পাচার সবচেয়ে বহুল–ব্যবহৃত প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছিল। এর মানে, পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ ঐ সময় ডলার–সাম্রাজ্যবাদের অনেক বড় শিকারে পরিণত হয়েছিল। পতিত স্বৈরশাসক হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য আগ্রহী হলেও সফল হয়নি। এখন ডঃ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেহেতু মার্কিনপন্থী সরকার তাই এখন বাংলাদেশ ব্রিকসের ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কিন্তু, এটা বলতেই হবে যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব–আধিপত্য খর্ব করে ভবিষ্যতে যদি ব্রিকস একটি ‘মাল্টি–পোলার ওয়ার্লড’ গড়ে তুলতে পারে তাহলে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশও ডলার সাম্রাজ্যবাদের একটি বিকল্প খুঁজে পাবে।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়