ড. মইনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ৬ জুন, ২০২৪ at ৮:১২ পূর্বাহ্ণ

জিডিপি ও জিএনআই প্রবৃদ্ধি সহ নানাবিধ অর্থনৈতিক সূচক গত তিন দশক ধরে সন্দেহাতীতভাবে জানান্‌ দিয়ে চলেছে যে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনুন্নয়ন ও পরনির্ভরতার ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়ে টেকসই উন্নয়নের পথে যাত্রা করেছে। কিন্তু, মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে যদি দেশে আয়বন্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীর কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে, যার ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। অতএব, আয়বৈষম্য ক্রমে বাড়তে থাকার প্রবণতাকে দেশের জন্য মহাবিপদ সংকেত বললে অত্যুক্তি হবে না। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আশির দশক থেকেই এদেশে আয় ও সম্পদ বৈষম্য ক্রমশ বাড়তে বাড়তে এখন বাংলাদেশ একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করার জন্য নানা পরিমাপক ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে লরেঞ্জ কার্ভ এবং জিনি (বা গিনি) সহগ অন্যতম। কোন অর্থনীতির জিনি সহগ যখন দ্রুত বাড়তে থাকে এবং ০.৫ এর কাছাকাছি পৌঁছে যায় বা ০.৫ অতিক্রম করে তখন নীতিনির্ধারকদের বোঝার কথা যে আয়বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের খানা আয়ব্যয় জরিপে জিনি সহগ নির্ধারিত হয়েছে ০.৪৮৩। ২০২২ সালের খানা আয়ব্যয় জরিপে জিনি সহগ পৌঁছে গেছে ০.৪৯৯ এ।

এই ধনাঢ্য সৃষ্টিকারী ও ধনাঢ্য গোষ্ঠীগুলোর দখলে জিডিপি’র ক্রমবর্ধমান অংশ পুঞ্জীভূত হতে দেওয়ার বিপদ সৃষ্টিকারী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর কৌশল কী ফল প্রসব করতে পারে তা আরো নাটকীয়ভাবে ধরা পড়েছে ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হেডলাইন সংবাদ ‘বিশ্বে ধনকুবেরের সংখ্যার প্রবৃদ্ধির হারের শীর্ষে বাংলাদেশ’ এর মাধ্যমে । ঐ খবরে জানানো হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’ এর প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আল্‌ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট২০১৮ মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ এই পাঁচ বছরে অতি ধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে সারা বিশ্বে এক নম্বর স্থানটি দখল করেছে বাংলাদেশ। ঐ পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭.৩ শতাংশ হারে। ঐ গবেষণা প্রতিবেদনে ত্রিশ মিলিয়ন বা তিন কোটি ডলারের (৩৫০ কোটি টাকা) বেশি নীটসম্পদের অধিকারী ব্যক্তিদেরকে ‘আল্‌ট্রাহাই নেটওয়ার্থ’ (ইউ এইচ এন ডব্লিউ’) ইন্ডিভিজুয়াল হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সাধারণ জনগণের কাছে বোধগম্য যেসব বিষয় এই বিপদটার জানান দিচ্ছে সেগুলো হলো: ) দেশে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে মাতাপিতার বিত্তের নিক্তিতে সন্তানের স্কুলের এবং শিক্ষার মানে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে; ) দেশে চার ধরনের মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে; ) দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুরোপুরি বাজারিকরণ হয়ে গেছে; ) ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে ্‌এবং ঋণখেলাপি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; ) দেশের জায়গাজমি, এপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট, মানে রিয়াল এস্টেটের দাম প্রচন্ডভাবে বেড়েছে; ) বিদেশে পুঁজি পাচার মারাত্মক ভাবে বাড়ছে; ) ঢাকা নগরীতে জনসংখ্যা দুই কোটি ত্রিশ লাখে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবার ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তীবাসী; ) দেশে গাড়ী, বিশেষত বিলাসবহুল গাড়ী আমদানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে; ) বিদেশে বাড়ীঘর, ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক পড়েছে; ১০) ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে; ১১) উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবাহ বাড়ছে; ১২) উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘনঘন বিদেশে যাওয়ার খাসলত বাড়ছে; ১৩) প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; ১৪) প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে; ১৫) দেশে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ও লেভেল/এ লেভেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মোচ্ছব চলছে; ১৬) প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে; এবং ১৭) দেশে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি বেড়ে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে পদে পদে। দুর্নীতিলব্ধ অর্থের সিংহভাগ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য সমস্যা মোকাবেলা করা দুরূহ, কিন্তু অসম্ভব নয়। রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্বের সদিচ্ছা এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন, কারণ আয় ও সম্পদ পুনর্বন্টন খুবই কঠিন রাজনৈতিক নীতিপরিবর্তন ছাড়া অর্জন করা যায় না। সমাজের শক্তিধর ধনাঢ্য গোষ্ঠীগুলোর কায়েমী স্বার্থ আয়পুনর্বন্টন নীতিমালাকে ভন্ডুল করার জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করবেই। এক্ষেত্রে কেরালা মডেল বাংলাদেশের জন্য অনুসরণীয় মডেল হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে। রাজনৈতিক অর্থনীতির উন্নয়নঅনুন্নয়ন ডিসকোর্সে কেরালা বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ দশক থেকেই একটি বহুল আলোচিত নাম। সত্তর দশক থেকেই কেরালা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে চলেছে উন্নয়নের ‘কেরালা মডেলের’ জন্যে। সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর অনন্য নজির ‘কেরালা মডেলের’ প্রধান ডাইমেনশানগুলো নিচে উল্লিখিত হলো: ক্রয়ক্ষমতার সাম্য (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি) ভিত্তিতে মাথাপিছু জিডিপি, সাক্ষরতার হার, শিক্ষার সব পর্যায়ে অভিগম্যতার হার এবং জনগণের গড় প্রত্যাশিত আয়ুর ভিত্তিতে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) কর্তৃক প্রকাশিত মানব উন্নয়ন সূচকের (human development index-HDI) স্কোরে কেরালা ভারতের সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে এইচডিআই প্রথম প্রকাশিত হওয়ার বছর ১৯৯০ সাল থেকেই, এবং প্রথম থেকেই অনেক উন্নত দেশের চাইতে কেরালার র‌্যাংকিং ছিল উঁচুতে। শিশুমৃত্যুর হার, মাতৃমৃত্যুর হার, জন্মহার, মৃত্যুহার, মোট প্রজনন হার (total fertility rate), জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার, সকল পর্যায়ের শিক্ষিতের হার, মৌল স্বাস্থ্যসেবায় অভিগম্যতা, ভর্তুকি দামে খাদ্যরেশন ও ফিডিং ব্যবস্থা, চিকিৎসকজনসংখ্যা অনুপাত্তএধরনের তাবৎ সামাজিক সূচকেও কেরালা অনেক উন্নত দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। আড়াই দশক আগেই কেরালার জনসংখ্যা প্রতিস্থাপন (রিপ্লেসমেন্ট) লেভেলে পৌঁছে গেছে। কেরালার জনগণ প্রায় শতভাগ মৌল স্বাস্থ্যসুবিধা ও চিকিৎসা সুবিধার আওতায় চলে এসেছে, রাজ্যে ২৭০০ এর বেশি সরকারী ক্লিনিক/হাসপাতাল রয়েছে। এক লাখ জনসংখ্যার জন্যে কেরালায় ৩০০ হাসপাতাল বেড রয়েছে, যা ভারতে সর্বোচ্চ। কেরালার নিম্নআয়ের মানুষ বিপুল ভর্তুকিদামে রেশনের চাল কিনছেন। কেরালার সকল প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষার্থী স্কুল ফিডিংএর আওতায় চলে এসেছে। কেরালার সকল প্রবীণ কৃষক মাসিক পেনশন পান। কেরালার গ্রামীণ পরিবারের ৮৫ শতাংশ পাইপলাইনের পানি সরবরাহের আওতায় এসেছে। আরো চমকপ্রদ হলো, মধ্যপ্রাচ্যে উচ্চশিক্ষিত ও দক্ষ মানবপুঁজি রফতানির ক্ষেত্রে কেরালা ভারতে চ্যাম্পিয়ন। কেরালার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রবাসীদের ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শাসন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ এবং জবাবদিহিমূলক স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাও কেরালার আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতার দিক্‌ থেকেও কেরালাই ভারতের পথিকৃৎ।

জনগণের মাথাপিছু জিডিপি কম হলেই যে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার মান দারিদ্র্যপীড়িত হবে, বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের প্রতীচ্যের উন্নয়নতাত্ত্বিকদের এই মাথাপিছু আয়কেন্দ্রিক ধারণাকে যে দুটো উন্নয়নমডেল সবার আগে ভ্রান্ত প্রমাণিত করেছিল তার একটি হলো সমাজতান্ত্রিক কিউবা, অপরটি কেরালা। মাথাপিছু জিডিপি বিভিন্ন দেশের মানবকল্যাণ তুলনার জন্যে উপযুক্ত নয়, এই ধারণার ক্ল্যাসিক উদাহরণ কেরালা। মাথাপিছু জিডিপি বেশি না হলেও যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতের মত একটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশেও ঈর্ষণীয় জীবনযাপন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়্ত কেরালার জনগণ তৃতীয় বিশ্বে তার সফলতম নজির সৃষ্টি করেছে। ন্যায়বিচার সমুন্নতকারী প্রবৃদ্ধি (equitable growth) মডেলের এক অনন্য নজির কেরালা। আয় ও সম্পদবৈষম্যকে নিয়ন্ত্রণে রেখে জনগণের মাথাপিছু জিডিপি’র প্রবৃদ্ধিকে দ্রুত বাড়িয়ে চলেছে রাজ্যটি। কেরালায় পরমতসহিষ্ণু রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউডিএফ)। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়পরাজয়ের মাধ্যমে এই দুটো জোট পালাক্রমে ক্ষমতায় আসলেও কোন সরকারই পূর্ববর্তী সরকারের গণমুখী পরিবর্তনগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে না, নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। কেরালার জনগণ সেজন্যে তাদের রাজ্যকে ‘গড’স ওন কান্ট্রি’ অভিহিত করে সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানায়।

১৯৫৭ সালে ভারতে অবাধ নির্বাচনে জিতে বাম রাজনৈতিক শক্তি সর্বপ্রথম কেরালায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। ক্ষমতায় এসে ১৯৫৯ সালেই কেরালার কম্যুনিস্টনেতৃত্বাধীন সরকার ভারতে প্রথম ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ জারি করে, যেটাকে তখনকার ভারতের কংগ্রেসনেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার ভন্ডুল করতে কেরালায় কেন্দ্রীয় শাসন চাপিয়ে দেয়। কিন্তু, বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট আবার নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় ফিরে আসে। ১৯৬৯ সালে আরেকটি কম্যুনিস্টনেতৃত্বাধীন সরকার ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ নীতির ভিত্তিতে ভূমি মালিকানার ব্যাপক পুনর্বন্টনের লক্ষ্যাভিমুখী কৃষি সংস্কার আইন পাস করে, যার প্রধান পাঁচটি বৈশিষ্ট্য ছিল: ) কোন পরিবারকে আট হেক্টরের বেশি জমির মালিকানা রাখতে না দেওয়া, ) ভাগচাষি (tenant farmar) ও বর্গাদার কৃষকদেরকে তাদের চাষকৃত জমির কার্যকর মালিকে (virtual owners) পরিণত করা, ) মধ্যস্বত্বভোগীদেরকে উৎখাত, ) কৃষিজোতের একত্রিকরণ, এবং ৫) তৃণমূল জনগণের সামাজিক ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের কৃষি সংস্কারের কর্মসূচিতে সম্পৃক্তকরণের ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ (mass mobilization)। কেরালার কৃষি সংস্কারের ওপর বিশ্বখ্যাত গবেষক হেরিক্স সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগণের এই সামাজিকগণতান্ত্রিক সম্পৃক্তকরণকে কৃষি সংস্কার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক শক্তি সমাবেশের প্রধান নির্ধারক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কেরালার ভূমির মালিকানা পুনর্বন্টন কর্মসূচি থেকে পনের লক্ষ কৃষক পরিবার সরাসরি উপকৃত হয়েছে, যেটা পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গে বাস্তবায়িত ভূমি সংস্কার আইনমালা ‘অপারেশন বর্গা’ এর তুলনায় অনেক কমসংখ্যক। কিন্তু, কেরালার কৃষি সংস্কারমালা খেতমজুরদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতায়নে এবং গ্রামীণ শ্রমজীবী জনগণের সংগঠন জোরদারকরণে অনেক বেশি শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পেরেছে, যার ফলে তৃণমূল গণতন্ত্র ও ‘কল্যাণ অর্থনীতি’ প্রতিষ্ঠায় কেরালা মডেল অনেক বেশি সাফল্য অর্জন করেছে।

২০১০ সালে লন্ডনের খ্যাতিমান প্রকাশনা সংস্থা পিয়ারসন থেকে প্রকাশিত আমার ও নিতাই নাগের রচিত গবেষণাগ্রন্থ ইকনমিক ইন্টিগ্রেশন ইন সাউথ এশিয়া: ইস্যুজ এন্ড পাথওয়েজে আমি নিচের পরিবর্তনগুলোকে কেরালা মডেলের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে প্রশংসা করেছি: ) কার্যকর রেশন ব্যবস্থা ও ফিডিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে ভর্তুকিদামে নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর মধ্যে চালবিতরণ. ) খেতমজুরদের কর্মসংস্থানের নিরাপত্তাবিধান এবং নিম্নতম মজুরি আইন বাস্তবায়ন, ) অবসরপ্রাপ্ত ও বর্ষীয়ান কৃষিশ্রমিকদের জন্যে পেনশন চালু, ) দলিতশ্রেণীর জনগোষ্ঠিসমূহের জন্যে বর্ধিত সরকারী চাকুরি, ) বর্গাদারদের ভূমিস্বত্বের নিরাপত্তা (security of tenure) জোরদারকরণ এবং জবরদস্তিমূলক উচ্ছেদের আশংকা নিরসন, ) গ্রামীণ ভিটেমাটিতে বসবাসরতদেরকে দখলিস্বত্ব প্রদান, ) ভূমিহীন পরিবারগুলোকে বসতবাটির জন্যে প্লট প্রদান, ) কৃষিশ্রমিকদের দৈনিক সর্বোচ্চ কর্মঘন্টা নির্ধারণ এবং তাদের জন্যে সামাজিক নিরাপত্তা স্কিম চালু, ) গ্রামীণ জনগণের জন্যে সরকারী ক্লিনিক ও হাসপাতাল নেটওয়ার্কের ব্যাপক সম্প্রসারণ, এবং ১০) অনুপস্থিত ভূমি মালিকানা উৎসাদন। যেহেতু কেরালার জনগণ প্রায় শতভাগ শিক্ষিত ও রাজনীতিসচেতন তাই তারা সংগঠিতভাবে রাজনীতিবিদ ও আমলাদেরকে সার্বক্ষণিক সজাগ ভূমিকা পালনে বাধ্য করে চলেছে। নির্বাচনে মাঝে মাঝে বামপন্থীরা হেরে গেলেও জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও সার্বক্ষণিক মনিটরিং কয়েকবার নির্বাচনে জয়ী কংগ্রেসনেতৃত্বাধীন ইউডিএফ সরকারগুলোকেও সংস্কার কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে বাধ্য করেছে।

২০১০ সালে বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র আবার রাষ্ট্রের চারটি মূল নীতি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা ২০১১ সালের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু, দুঃখজনকভাবে এখনো ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ অহিফেনের মৌতাতে ডুবে রয়েছে সরকার। অনেকেই এখন বর্তমান সরকারকে প্রধানমন্ত্রী ও জনাকয়েক ধনকুবের ব্যবসায়ীর ‘অলিগার্কি’ বলে অভিহিত করছেন। একটি উচ্চআয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য এই রাষ্ট্রচরিত্রই দায়ী। অথচ, সমাজতন্ত্রকে ‘বাত্‌ কা বাত্‌’ বানিয়ে না রেখে কেরালা মডেলকে অনুসরণ করলে বাংলাদেশ ক্রমেই আয়বৈষম্য নিরসনের পথে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবে।

লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের পুরাকীর্তি সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধরাউজান আবদুস সালাম উচ্চ বিদ্যালয়ে মতবিনিময়