বিশ্বের নানা দেশে প্রায় এক কোটি উনপঞ্চাশ লাখ বাংলাদেশী অভিবাসী বসবাস করছেন বলে সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে বক্তব্য রেখেছেন। তাঁদের কতজন কর্মরত রয়েছেন সেটা জানা খুবই কঠিন। তাঁদের মধ্যে মাত্র কয়েক লাখ ‘সপরিবার অভিবাসী’ হিসেবে বিদেশে বসবাস করছেন, যাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইতালী, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে এবং মালয়েশিয়ায় বসবাস করছেন বলে ধারণা করা হয়। কিছু সংখ্যক অভিবাসী সাম্প্রতিক কয়েক বছর ধরে সৌদী আরব, দুবাই, ওমান, কাতার ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশকেও অভিবাসনের জন্য বেছে নিচ্ছেন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু, বিদেশে বাংলাদেশী অভিবাসীদের প্রায় ৯০ শতাংশই এখনো ‘অর্থনৈতিক অভিবাসী’, যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে নিজেরা অভিবাসী হলেও পরিবারের অন্য সদস্য–সদস্যাদেরকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার অবস্থানে পৌঁছাতে পারেননি। তাঁরাই বাংলাদেশী বৈদেশিক অভিবাসীদের মধ্যে অল্প–শিক্ষিত ও কম দক্ষ অভিবাসী, যাঁরা প্রধানত বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজগুলো থেকে বিদেশে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে অভিবাসন গ্রহণে উৎসাহী হয়েছেন কিংবা বাধ্য হয়েছেন। কারণ, তাঁদের জন্য স্বাধীনতার ৫২ বছরেও বাংলাদেশের শাসকরা অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে কোন উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেনি। অথবা, নিজের দেশে তাঁরা যে আয়–রোজগার করতে সক্ষম বলে হিসাব করছেন তার চাইতে অনেক বেশি আয় তাঁরা বিদেশে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্জন করবেন বলে তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে। এদেশে তাঁদের পরিবারের মালিকানাধীন জমি–জমা–সম্পত্তি বিক্রয় করে কিংবা ধার–দেনা করে তাঁদের বিপুল অংশ বিরাট ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এই ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসনের সিদ্ধান্ত অনেক সময় ফলপ্রসূ হয় না, পরিবারের বিনিয়োজিত অর্থ মার যায়। তারপরও এহেন ঝুঁকি নেয়ার প্রবণতা দিনদিন বাড়ছে। অর্থনীতির একজন গবেষক হিসেবে ‘বৈদেশিক অভিবাসন’ যেহেতু আমার মূল গবেষণা ক্ষেত্রের অন্যতম, তাই আমার এ–সম্পর্কিত প্রকাশিত গবেষণা–পুস্তক ও গবেষণা–প্রবন্ধগুলোতে আমি বিষয়টি গভীরভাবে বিশ্লেষণের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি গত ৪২ বছর ধরে। কিন্তু, আমি যখন আমার গবেষণায় ‘পুঁজি পাচার’কে বেছে নেই তখন এই আনুমানিক দেড় কোটি বাংলাদেশী অভিবাসীদের মধ্যে একটি অতি ক্ষুদ্র অংশকে টার্গেট করে আমার অনুসন্ধান পরিচালিত হয়। সংখ্যায় এসব পুঁজিপাচারকারী কয়েক হাজারের বেশি হবে না। বাংলাদেশী সমাজের উচ্চ–মধ্যবিত্ত, উচ্চ–বিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে তাঁদের বেশিরভাগের অবস্থান। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে তাঁরা দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার করতে বাধ্য হচ্ছেন বলা যাবে না। এদেশে তাঁরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ‘এলিট’ গোষ্ঠির মধ্যে অবস্থান করা সত্ত্বেও আরো বেশি সুখ–শান্তির (কল্পনার স্বর্গীয় সুখের) আশায় দেশের সহায়–সম্পত্তি বিক্রয় করে দেশত্যাগে উদ্যোগী হচ্ছেন। তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠই দুর্নীতিবাজ আমলা, ব্যবসায়ী–শিল্পপতি (উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গার্মেন্টস মালিক), প্রকৌশলী ও রাজনৈতিক নেতা। তাঁদের বেশিরভাগের বৈশিষ্ট্যগত ‘কমন ফ্যাক্টর’ হলো তাঁদের সিংহভাগ ‘কালো টাকার মালিক’, ভাল মানের শহুরে সম্পত্তির মালিক কিংবা শিল্প–কারখানা–ব্যবসায়ের মালিক হওয়ায় দেশের ব্যাংকঋণ পাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। আমার সংবাদপত্রের কলামগুলোতে আমি তাদেরকে ‘জাতির এক নম্বর দুশমন’ আখ্যায়িত করে চলেছি। তাঁরা যদি নিজেদের বাপ–দাদার সূত্রে প্রাপ্ত এদেশীয় সম্পদ–সম্পত্তি বিক্রয় করে বিদেশী নাগরিকত্বের আশায় অভিবাসন প্রক্রিয়ায় শামিল হন তাহলে তাঁদেরকে ‘জাতির দুশমন’ আখ্যায়িত করা যৌক্তিক হতো না। অথবা, নিজেদের সারা জীবনের বৈধ উপার্জনের মাধ্যমে প্রাপ্ত আয় থেকে উদ্ভূত সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সূত্রে প্রাপ্ত অর্থ–সম্পদ বা সম্পত্তি বিক্রয় করে যদি কেউ অভিবাসনের মাধ্যমে পরবর্তীতে বিদেশে সপরিবার বসবাসের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করেন তাঁকেও গালমন্দ করা সঠিক হবে না। কিন্তু, আমার গবেষণার টার্গেট তাঁরা নন। আমি যাদেরকে ‘জাতীয় দুশমন’ অভিহিত করছি তারা দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমকে অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছে। তারা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ–লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছে। তারা রাজনীতিক পরিচয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুন্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী। তারা ৫২ বছরের স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’ দুর্নীতি ও পুঁজিলুন্ঠনের মাধ্যমে কালো টাকার মালিক হয়ে তাদের দুর্নীতি–লব্ধ ও লুন্ঠনকৃত অর্থ বিদেশে পাচার করে কানাডার টরোন্টোর বেগমপাড়া, অস্ট্রেলিয়ার সিডনীর ফ্রেটারনিটি এবং মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে।
এই পুঁজিপাচারকারীদের প্রধান অংশকে আমি আমার আরেকটি কলামে ‘রবার ব্যারন’ আখ্যায়িত করেছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়—১৮৭০ সাল থেকে ১৯১৪ সালের পুঁজিবাদী বিকাশে ‘রবার ব্যারন’দের ভূমিকার বর্ণনা পাওয়া যাবে, যার সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা–উত্তর ৫২ বছরের রাঘববোয়াল পুঁজিলুটেরা ব্যাংকঋণ খেলাপিদের অবিশ্বাস্য ধনসম্পদ আহরণের পদ্ধতির আশ্চর্যজনক মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। এই অভিধাটি যেসব মার্কিন ধনকুবেরদের ধনসম্পদ আহরণের বৈশিষ্ট্য বর্ণনার জন্যে ব্যবহৃত হয়েছে সেসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে তাদের দুর্বৃত্তায়িত ব্যবসা–কৌশল (রবার) এবং তদানীন্তন মার্কিন রাজনীতির ওপর তাদের অপরিসীম প্রভাবের কারণে তাদের সামাজিক প্রতিপত্তিকে (ব্যারন) ফোকাস করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২ বছরে যেসব ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি ধনবান হয়েছেন তাঁদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেও অর্থনীতি ও রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন এবং ক্ষমতাসীন শাসকমহলের পৃষ্ঠপোষকতা বা সম্পর্কের গভীরতার ব্যাপারটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েলথ এক্স’ এর প্রতিবেদনে ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের ধনকুবেরদের সংখ্যার বার্ষিক ১৭.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি (যা ছিল বিশ্বে সর্বোচ্চ) সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ২০০১–২০০৫ ঐ পাঁচ বছরে পাঁচবার বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করেছিল, আবার বাংলাদেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করলো ধনকুবেরের সংখ্যাবৃদ্ধির দৌঁড়ে। ‘ওয়েলথ এক্স’ এর ঐ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ধনকুবের ছিল ২৫৫ জন। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এদেশে যেভাবে নিজেদের আয় এবং ধন–সম্পদ লুকোনোতে বিশেষ পারদর্শিতা প্রদর্শন করে থাকেন তাতে হয়তো দেশে ধনকুবেরের প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে।
আমি বলব, ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের ক্রমবর্ধমান প্রতাপের কারণেই ১৯৭৫ সাল থেকে গত ৪৮ বছর ধরে বাংলাদেশে এই কয়েক’শ রবার ব্যারনের উত্থান ঘটেছে। এই উত্থানের প্রধান প্রধান সিঁড়ির ভূমিকা পালন করেছে নিচের প্রক্রিয়াগুলো:
১) ব্যাংকঋণের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ:
২) বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর পুঁজি লুন্ঠন:
৩) সরকারের গৃহীত ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলোর ব্যয় অযৌক্তিকভাবে অতিমূল্যায়নের মাধ্যমে পুঁজি লুন্ঠন;
৪) অস্বাভাবিকভাবে প্রকল্প বিলম্বিতকরণের মাধ্যমে পুঁজি লুন্ঠন;
৫) ব্যাংকের মালিকানার লাইসেন্স বাগানো এবং ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের মাধ্যমে বাংকঋণ লুন্ঠন;
৬) প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ ও প্রাইভেট টেলিভিশন স্থাপনের ব্যবসা;
৭) শেয়ারবাজার কারচুপি ও জালিয়াতির মাধ্যমে পুঁজি লুন্ঠন;
৮) একচেটিয়ামূলক বিক্রেতার বাজারে (পড়ষষঁংরাব ড়ষরমড়ঢ়ড়ষু) যোগসাজশ ও দাম নিয়ন্ত্রণ;
৯) রিয়াল এস্টেট ব্যবসায়ে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও এপার্টমেন্টের অত্যধিক দামবৃদ্ধি;
১০) ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাংকঋণ খেলাপ;
১১) প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বখরা–ভাগাভাগির মাধ্যমে ব্যাংকঋণ লুন্ঠন;
১২) একের পর এক অযৌক্তিক মেগা–প্রকল্প থেকে রাজনৈতিক মার্জিন আহরণ; এবং
১৩) রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ।
উপরে যে ১৩টি প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে আমার মতে বাংলাদেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ব্যাংকঋণ লুন্ঠন। ১৯৭২ সাল থেকেই ‘ব্রিফকেস ব্যবসায়ীদের’ আদলে ব্যাংকঋণ লুটেরাদের উদ্ভব হলেও ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট–পরিবর্তনের পর সমরপ্রভু জিয়াউর রহমান ব্যাংকঋণ বন্টনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অপব্যবহারের সংস্কৃতি চালু করেছিলেন, যেটাকে স্বৈরাচারী এরশাদও তাঁর রাজনীতির প্রধান হাতিয়ারে পরিণত করেছিলেন। তখন থেকেই ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপের’ মাধ্যমে ব্যাংকঋণ লুন্ঠনের অপসংস্কৃতি এদেশে গেড়ে বসতে শুরু করে। ১৯৯১–৯৬ মেয়াদের বিএনপি সরকারের সময় খেলাপি ব্যাংকঋণের সমস্যা সংকটে পরিণত হয়। এর পরবর্তী ২৭ বছরও আওয়ামী লীগ, বিএনপি–জামায়াত জোট এবং বর্তমানে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার ও আওয়ামী লীগ সরকারগুলো ব্যাংকঋণ লুন্ঠনের এই মহাযজ্ঞে পৌরহিত্য করে চলেছে। ফলে, এদেশের রবার ব্যারনরা প্রধানত ব্যাংকঋণ লুন্ঠনের মাধ্যমেই ধনকুবেরে পরিণত হয়েছেন, এবং এই ব্যাংকঋণের সিংহভাগই তাঁরা বিদেশে পাচার করে চলেছেন। গত কয়েক বছরে উদঘাটিত হলমার্ক কেলেংকারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলিংকারি, ডেসটিনি কেলেংকারি, বেসিক ব্যাংক কেলেংকারি, নুরজাহান গ্রুপ কেলেংকারি, ফার্মার্স ব্যাংক কেলেংকারি, বেক্সিমকোর ব্যাংকঋণ লুন্ঠন, এস আলম ও আজিজ খানের পুঁজি–লুন্ঠন কিংবা শাহাবুদ্দিন আলম কেলেংকারি প্রকৃতপক্ষে হাজার হাজার কোটি টাকার অবিশ্বাস্য অংকের ব্যাংকঋণ লুন্ঠনের ‘টিপ অব দি আইসবার্গ’ মাত্র।
বর্তমানে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন, ডলারের ক্রমাগত দামবৃদ্ধি, বিদেশে পুঁজিপাচার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং প্রবাসীদের রেমিট্যান্সে হুন্ডির বেলাগাম আধিপত্যের মত সমস্যায় জর্জরিত। আমি বারবার বলে চলেছি, যদ্দিন হুন্ডি ডলারের চাহিদা চাঙা থাকবে তদ্দিন বাংলাদেশে ডলারের দাম স্থিতিশীল হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত বাজারে ডলারের দাম যত থাকবে হুন্ডিওয়ালারা তার চাইতে ৭–৮ টাকা বেশি দিয়ে প্রবাসীদের ডলার কিনে নেবে পুঁজিপাচারকারীদের কাছে হুন্ডি ডলারের প্রবল চাহিদার কারণে। এটা অনস্বীকার্য যে ফর্মাল চ্যানেল বা হুন্ডি পদ্ধতি—যেভাবেই রেমিট্যান্সের অর্থ অর্থনীতিতে প্রবাহিত হোক্ তার বহুবিধ সুফল পাচ্ছে অর্থনীতি। হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রেরিত রেমিট্যান্সের বৈদেশিক মুদ্রা (প্রধানত ডলার) যদিও দেশ থেকে বিদেশে অর্থ–পাচারের জন্য পুঁজিপাচারকারীরা অপব্যবহার করে চলেছে তবুও এই ব্যাপারটা অর্থনীতির জন্য পুরোপুরি নেতিবাচক নয়। বিপুল পরিমাণ খেলাপিঋণ সত্ত্বেও বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো যে বড়সড় সংকটে পড়ছে না তার পেছনে ফর্মাল চ্যানেলে এবং হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রেরিত রেমিট্যান্স থেকে উদ্ভূত বিশাল আমানত প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এক অর্থে এই বিপুল রেমিট্যান্সের অর্থ বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের একটা তাৎপর্যপূর্ণ বিকল্পের ভূমিকা পালন করছে। চীন ও ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ যে ভূমিকা পালন করেছে তার অনুরূপ ভূমিকা বাংলাদেশে পালন করছে ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স প্রবাহ। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের চমকপ্রদ উল্লম্ফনও ঘটাচ্ছে প্রবাসীদের ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স। বাংলাদেশের অনেক এলাকার গ্রামীণ ও শহুরে অর্থনীতিতে যে বিপুল গতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে প্রধান অবদান রেখে চলেছে এলাকার প্রবাসী–বাংলাদেশীদের সংখ্যাধিক্য। আমার মতে হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হওয়া রেমিট্যান্স ও অন্যান্য ব্যবস্থায় দেশে নিয়ে আসা বিদেশে উপার্জিত আয়–উপার্জন ২৫–৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাচ্ছে প্রতি বছর। (তার মানে, প্রবাসী বাংলাদেশীদের ফর্মাল–ইনফর্মাল চ্যানেলে মোট রেমিট্যান্স ও দেশে নিয়ে আসা বৈদেশিক মুদ্রার যোগফল প্রায় ৪৫–৫০ বিলিয়ন ডলার)। ৪৫–৫০ বিলিয়ন ডলারের সম–পরিমাণ অর্থ প্রতি বছর অর্থনীতিতে যুক্ত হওয়া কি সামান্য ব্যাপার? কিন্তু, যেহেতু অধিকাংশ প্রবাসীরা রেমিট্যান্স প্রেরণের জন্য হুন্ডি পদ্ধতিকেই বেছে নিচ্ছেন তাই বাংলাদেশ থেকে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় বিদেশে পুঁজিপাচার বর্তমান পর্যায়ে দেশে মহা–সংকটজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। আমি মনে করি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ও ডলার সংকট থামাতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে দুর্নীতি, পুঁজিলুন্ঠন এবং পুঁজিপাচারের বিরুদ্ধে অবিলম্বে কঠোর দমননীতি গ্রহণ করতেই হবে। তার মানে, একদিকে হুন্ডি ব্যবসার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে আর অন্যদিকে দুর্নীতি ও পুঁজিলুন্ঠনের বিরুদ্ধে সত্যিকারভাবে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিকে বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়