ড. বদরুল হুদা খান। একজন মেধাবী মানুষ। ই–লার্নিং বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশ্বে খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। ই–লার্নিংয়ে তাঁর বিভিন্ন বই প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বের ২০টি ভাষায়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রকাশ করেছে ‘ই–লার্নিং’ বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ। তাঁর জীবনী থেকে জানা যায়, ১৯৯৫ সালে তিনিই প্রথম শিক্ষার জন্য ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের সম্ভাবনা চিহ্নিত করেন। ১৯৯৭ সালে তাঁর বই ‘ওয়েব–বেসড ইন্সট্রাকশন’ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি ‘ওয়েববেসড ইনস্ট্রাকশন’ ধারণাটি বিশ্বে প্রথম নিয়ে আসেন। এই বইটি বেস্ট সেলার হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং বিশ্বের প্রায় ৫ শত বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক ও রেফারেন্স গাইড হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ড. বদরুল খান এই বইটিতে শিক্ষা ক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব তুলে ধরেন যার ফলে লেখাপড়ায় ওয়েবের জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে যা পরবর্তীতে মডার্ন ই–লার্নিংয়ের পথ সুগম করে দেয়।
তিনি আমাদের চট্টগ্রামের সন্তান। চট্টগ্রাম বললে তিনি আবেগ–আপ্লুত হয়ে পড়েন। চট্টগ্রামের ভাষা–সাহিত্য–সংস্কৃতির সঙ্গে রয়েছে তাঁর অন্তরের যোগ। দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেও চট্টগ্রামকে বুকে ধরে রেখেছেন তিনি। সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধে পরিবেশকর্মীরা আন্দোলন করছিলেন, আমেরিকায় বসে তিনি সেই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন। এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী সকলেই। দৈনিক আজাদী নিয়মিত ক্রোড়পত্রের আয়োজন করে পাঠকের সমস্ত অভিমত সরকারের কাছে পৌঁছে দেয়। ড. বদরুল হুদা খান আমেরিকায় অবস্থান করে একটি অসামান্য সংকলন সম্পাদনা করেন। নাম : ‘সিআরবি–চট্টগ্রামের ফুসফুস’।
ড. খানের জন্ম চট্টগ্রামের পাঠানটুলী খান বাড়িতে। বাবা লোকমান খান শেরওয়ানী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা, একজন কবি, সাংবাদিক। তিনি ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের ভাইস প্রেসিডেন্ট। মা শবনম খানম শেরওয়ানী ছিলেন একজন শিক্ষক, লেখক ও সংগীতশিল্পী। চট্টগ্রামের বিখ্যাত পরিবারের সন্তান হিসেবে ড. বদরুল হুদা খানের আন্তরিকতা, আতিথেয়তা, উদারতা ও মানবিকতার কোনো তুলনা হয় না। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে, যখন দেখি এই মহান মানুষটির জীবনী বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা পাঠ করার সুযোগ পায়। বলা জরুরি যে, বিশ্বে ই–লার্নিংয়ের প্রণেতা হিসেবে এবং বিশেষজ্ঞ হিসেবে ড. বদরুল হুদা খানের জীবনী নবম–দশম শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত। আমরা সাধারণত পাঠ্যবইতে দেখি প্রয়াত মনীষীদের জীবনী। সেক্ষেত্রে এটা ব্যতিক্রম। এটা শুধু আনন্দের নয়, গৌরবেরও।
জানা যায়, ড. বদরুল হুদা খান যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি থেকে রসায়নে স্নাতক ও ইনসট্রাকশনাল সিস্টেমস টেকনোলজিতে (শিক্ষাপ্রযুক্তি) ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন ১৯৯৪ সালে। ১৯৯৪ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের এডুকেশনাল টেকনোলজি গ্রাজুয়েট প্রোগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। এর আগে তিনি ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলে শিক্ষামূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৭ সালে অধ্যাপক খান জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির এডুকেশনাল টেকনোলজি লিডারশিপ গ্রাজুয়েট প্রোগ্রাম এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ই–লার্নিং ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বব্যাংক, ন্যাটো, এডিবি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও বহু দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন বহুজাতিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন।
সম্প্রতি তিনি প্রকাশ করেছেন ‘স্মার্ট শিক্ষায় স্মার্ট বাংলাদেশ’ শীর্ষক আরেক অসামান্য গ্রন্থ। শেরওয়ানী ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় শৈলী থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থ নিয়ে তিনি বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছেন দেশ–বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা–অন্বেষা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে।
২০০৪ সালে দৈনিক প্রথম আলো’তে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে ড. বদরুল হুদা খান বলেছিলেন, ‘প্রযুক্তি গ্রহণে দ্বিধা করলে দেশ পিছিয়ে যাবে’। আজ সমগ্র বিশ্ব প্রযুক্তি–নির্ভর। বাংলাদেশ সরকার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কনসেপ্টের পর এখন কাজ করছে স্মার্ট বাংলাদেশ নিয়ে। এই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রয়োজন স্মার্ট শিক্ষা। স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য বাংলাদেশ সরকার চারটি স্তম্ভ নির্ধারণ করেছেন, সেগুলো হলো– স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট। বাংলাদেশের ক্রমাগত উন্নতির জন্য এই চার স্তম্ভের প্রতিটি স্তম্ভই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের সঙ্গে সমান গতিতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এই নতুন দিগন্তের সব ধরনের প্রযুক্তির সহযোগিতা প্রয়োজন। ড. বদরুল হুদা খান বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে এই স্মার্ট বিশ্বের স্মার্ট সমাজ গঠনে আমাদের দরকার প্রতিটি নাগরিক যেন দেশ প্রেমিক ও স্মার্ট সিটিজেন হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলে। কারণ স্মার্ট সমাজ, স্মার্ট অর্থনীতি ও স্মার্ট সরকার গঠনে দরকার দেশপ্রেমিক ও আদর্শবান স্মার্ট নাগরিক। আমাদের নাগরিকরা সত্যিকারভাবে তখনই স্মার্ট হবে যখন তারা তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করবে এবং নৈতিক শিক্ষা, আচার–আচরণে নীতি ও মানবিক মূল্যবোধে অধিষ্ঠিত হবে। আমাদের নাগরিকদের এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে যেন তারা স্মার্ট সরকারের তত্ত্বাবধানে স্মার্ট অর্থনীতিতে সব কার্যক্রমে সফলভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। যাতে স্মার্ট সমাজে স্মার্ট নাগরিক হিসেবে বসবাস করে নিজেদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে সফলকাম হয়। এটাই তো স্মার্ট জনসাধারণের সম্মিলিত ও আনন্দময় অভিযাত্রা। তাতেই তো দেশ এগিয়ে যাবে।’
‘স্মার্ট শিক্ষায় স্মার্ট বাংলাদেশ’ গ্রন্থ নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন দেশের বেশ কয়েকজন গুণী ব্যক্তিত্ব। তাঁদের দুয়েকজনের কিছু অভিমত এখানে তুলে ধরার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।
সাবেক শিক্ষা সচিব এন আই খান বলেছেন, ‘যারা স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির কারিগর তাদের জন্য এই বইটি অবশ্যপাঠ্য। এই বিষয়ে এটি প্রথম প্রচেষ্টা এবং দিকনির্দেশনামূলক সুখপাঠ্য। ডিজিটাল বাংলাদেশ করার সময় বদরুল খান আমাকে পরামর্শ দিয়ে সমৃদ্ধ করেছিলেন। আপনারা স্মার্ট বাংলাদেশ করার সময় তার পরামর্শ নিতে পারেন।’ অন্যদিকে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোঃ আবু তাহের বলেছেন, শিক্ষায় রূপান্তর এখন সময়ের দাবি। এই লক্ষ্যে ড. বদরুল খানের ‘স্মার্ট শিক্ষায় স্মার্ট বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রণীত বইটি সময়োপযোগী। আমার বিশ্বাস শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও তথ্য–প্রযুক্তি নির্ভর দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে বইটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। উপরন্তু টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ ও ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে উন্নত–সমৃদ্ধ–স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বইটি বেশ সহায়ক হবে।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক মোস্তফা আজাদ কামাল বলেছেন, ড. বদরুল খানের রচিত ‘স্মার্ট শিক্ষায় স্মার্ট বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইটি বাংলা ভাষায় অন্যতম একটি প্রকাশনা। আমি বিশ্বাস করি সূদুর আমেরিকায় বসে বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের জন্য ড. খানের লেখা এই বইটি নিঃসন্দেহে স্মার্ট বাংলাদেশের উপযোগী শিক্ষাক্রম, পঠন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিরূপণ ও বাস্তবায়নে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখবে।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. ফরিদ আহমদ সোবহানী বলেছেন, ‘স্মার্ট শিক্ষায় স্মার্ট বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইটি একটি পরিবর্তনশীল দৃষ্টিভঙ্গির চমৎকার উপস্থাপনা। সময়োপযোগী এ বই লেখার জন্য আমি ড. বদরুল হুদা খানকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। প্রযুক্তিগত আধুনিক শিক্ষাই স্মার্ট বাংলাদেশের পূর্বশর্ত। স্মার্ট শিক্ষা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। স্মার্ট ক্লাসরুম, অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম, লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এবং সর্বোপরি কারিকুলামে প্রযুক্তিগত বিষয়াদির অন্তর্ভুক্তি বর্তমান সময়ের দাবি। স্মার্ট শিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞান অর্জন, দক্ষতা বৃদ্ধি, সক্ষমতা তৈরি ও ফলাফল প্রাপ্তিতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। আমার বিশ্বাস, স্মার্ট শিক্ষার সফল বাস্তবায়ন ২০৪১ এ বাংলাদেশকে একটি গতিশীল এবং উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করবে।
আসলে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট শিক্ষার বিকল্প নেই। এ বিষয়ে ড. বদরুল হুদা খান নিজেই স্মার্ট–এর নানারকম ব্যাখ্যা তৈরি করেন এবং বলেন, ‘আমি SMART শব্দটিকে এর অর্থপূর্ণ রূপ দিতে পাঁচটি অক্ষরকে সুসংজ্ঞায়িতভাবে চিহ্নিত করেছি। যেমন– (S for Sustainable) স্মার্টের ‘এস’ মানে সাসটেইনেবল বা টেকসই। অর্থাৎ যা শিখে সারাজীবন কাজে লাগাতে পারবে কিনা। (M for Motivating) ‘এম’ মানে মোটিভেটিং– অনুপ্রেরণামূলক শিক্ষাব্যবস্থা, (A for Adaptable) ‘এ’ মানে অ্যাডাপ্টেবল– নতুনত্বে মানিয়ে নেওয়া বা খাপ খেয়ে নেওয়া, (R for Results-oriented) ‘আর’ অর্থ রেজাল্ট ওরিয়েন্টেড বা ফলভিত্তিক এবং (T for Technology-enabled) ‘টি’ মানে টেকনোলজি এনাবল্ড বা প্রযুক্তিসক্ষম। তাই বাংলাদেশকে স্মার্ট করতে হলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে স্মার্ট করতে হবে। আর শিক্ষাব্যবস্থাকে স্মার্ট করতে হলে দেখতে হবে সেটা টেকসই কিনা, অনুপ্রেরণামূলক কিনা, গ্রহণযোগ্য কিনা, ফল সন্তোষজনক কিনা, এতে প্রযুক্তির ব্যবহার আছে কিনা। স্মার্ট লার্নিংয়ে যখন সবাই শিক্ষা গ্রহণ করবে তখন স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনও সহজতর হবে।’
আমি গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী এ গ্রন্থ প্রণয়নের জন্য ড. বদরুল হুদা খানকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট কার্যালয়, প্রতিষ্ঠান ও অধিকর্তাবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যেন গ্রন্থে প্রদত্ত পরামর্শ গ্রহণ করে দেশকে স্মার্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হতে পারেন।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর–৪২২), বাংলা একাডেমি।