পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডের মাইজপাড়া। ওই এলাকার সাবেক কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেনের বাড়ির পাশে ৮ থেকে ১০ ফুট প্রশস্ত একটি ড্রেন আছে। ড্রেনের মুখে বাঁধ দিয়ে করা হয়েছে একটি কলা বাগান। আবার ড্রেনটির সাথে সামনের ড্রেনের কোনো সংযোগ নাই। এতে পানি চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে ওই এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। নগরে জলাবদ্ধতার কারণ খুঁজতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও সিডিএর সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটির প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। শুধু মাইজপাড়া নয়, নগরের বিভিন্ন খাল-নালায় বিদ্যমান এ ধরনের ২৪টি সমস্যা তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। তবে একই ধরনের সমস্যাগুলোকে একত্রিত করে মোটাদাগে জলাবদ্ধতার পাঁচটি কারণ উল্লেখ করা হয়।
কারণগুলো হচ্ছে- নিয়মিত খাল ও নর্দমা হতে মাটি উত্তোলন না করা, খালের যে অংশে মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে সেখানে মাটি থাকার ফলে খালের প্রশস্ততা কমে যাওয়া, অতি বর্ষণ ও কর্ণফুলী নদীতে পূর্ণিমার অতিরিক্ত জোয়ার একসাথে হওয়া, খাল ও নর্দমার জায়গা বেদখল এবং নাগরিকদের অসচেতনতার কারণে খাল-নর্দমায় বর্জ্য নিক্ষেপ।
প্রতিবেদনে জলাবদ্ধতা দূরীকরণে বর্ষা মৌসুমেও খাল-নালার বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম চালু রাখাসহ ১৭টি সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে স্বল্প মেয়াদী ৬টি এবং দীর্ঘ মেয়াদী সুপারিশ রয়েছে ১১টি। কমিটির সদস্যরা তিনদিনে নগরের ১৮টি খাল ও ১৪টি শাখা খাল সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনের সঙ্গে তিন পৃষ্ঠার খাল পরিদর্শন রিপোর্টও সংযুক্ত করা হয়। এতে প্রতিটি খালে কোন সমস্যার কারণে জলাবদ্ধতা হচ্ছে তা আলাদাভাবে তুলে ধরা হয়। এসব সমস্যা সমাধানে চসিক, সিডিএ, ওয়াসা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং রেলওয়ের জন্য স্বল্প মেয়াদের পৃথক সুপারিশ ও করণীয় ঠিক করা হয়। এর মধ্যে দশটি খালে সিডিএ, তিনটি খালে চসিক, একটি খালে রেলওয়ে এবং একটি খালে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের জন্য করণীয় নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া দুইটি খালে চসিক ও সিডিএ যৌথভাবে এবং একটি খালে সিডিএ, চসিক ও ওয়াসার জন্য যৌথ করণীয় নির্ধারণ করা হয়। যেমন, মাইজপাড়া আনোয়ার হোসেনের বাড়ির পাশের বাঁধটি দ্রুত অপসারণ করে ড্রেনের সংযোগ ব্যবস্থা করা এবং ড্রেন থেকে সম্পূর্ণ ময়লা অপসারণ করে পানি চলাচলের ব্যবস্থা করার জন্য চসিকের কাছে সুপারিশ করা হয়।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭, ১৮ ও ১৯ জুন ভারী ও মাঝারি বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় নগরের বহু এলাকা। এসময় সড়কে ছিল কোমর সমান পানি। বাসা-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও পানি ঢুকে যায়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। বাসায় পানি ঢুকে গেলে বিদ্যুতায়িত হয়ে দুইজনের মৃত্যুও হয়। এ অবস্থায় ২২ জুন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর সভাপতিত্বে সিডিএসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার সমন্বয়ে ‘জলাবদ্ধতার প্রকোপ নিরসনে’ টাইগারপাসস্থ নগর ভবনে একটি সভা হয়। এতে চলতি মৌসুমে জলাবদ্ধতার কারণ এবং স্বল্প মেয়াদে সমাধানের লক্ষ্যে সমস্যা চিহ্নিতকরণে চার সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়। তাদের ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশনা দেন মেয়র। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন জমা দেন তারা।
সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস কমিটির আহ্বায়ক এবং চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম সদস্য সচিব। দুই সদস্য হচ্ছেন চসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোবারক আলী ও জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী।
কমিটির সদস্যরা জানান, বেশি জলাবদ্ধতাপূর্ণ স্থানগুলোকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করে ২৫ ও ২৬ জুন এবং ২ জুলাই পরিদর্শন করেন। অঞ্চলগুলো হচ্ছে ৬, ১৬, ১৭, ১৮ ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত বাকলিয়া অঞ্চল; ১১, ১২, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত হালিশহর অঞ্চল এবং ৩, ৪, ৫, ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত চান্দগাঁও মোহরা অঞ্চল। বিষয়টি নিশ্চিত করে কমিটির সদস্য কাউন্সিলর মোবারক আলী দৈনিক আজাদীকে বলেন, সরেজমিন পরিদর্শনকালে খালের কোথায় কী সমস্যা আছে তা চিহ্নিত করেছি। এ সমস্যা কোন সংস্থা সমাধান করবে সেটারও সুপারিশ করি।
কমিটির সুপারিশ : স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী দুই ধরনের সুপারিশ করে কমিটি। স্বল্প মেয়াদী সুপারিশগুলো হচ্ছে- প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা কর্তৃক বর্ষা মৌসুমেও খাল-নালার বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম চালু রাখা, পানি চলাচলে বাধাগ্রস্ত বিভিন্ন সংস্থার পাইপসমূহ স্ব স্ব বিভাগ কর্তৃক সুবিধাজনক স্থানে অপসারণ করা, খালে বর্জ্য না ফেলার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করা, অবৈধভাবে খাল-নালা দখলকারীর বিরুদ্ধে উচ্ছেদসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এছাড়া পরিদর্শন রিপোর্ট অনুযায়ী স্ব স্ব সংস্থার উদ্যোগে চিহ্নিত সমস্যা দ্রুত সমাধান করার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া চসিকের মাধ্যমে মেগা প্রকল্পের আওতা বহির্ভূত প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি নালাসমূহ নিয়মিত পরিষ্কার রাখাসহ দীর্ঘ মেয়াদী সুপারিশ করা হয়। দীর্ঘ মেয়াদী অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, মেগা প্রকল্প এবং চসিকের নতুন খাল খনন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করা, মেগা প্রকল্পের আওতাধীন খালে লম্বালম্বি ও আড়াআড়িভাবে দেয়া বাঁধ কাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে অপসারণ করা। গৃহস্থালী কিংবা বাজারের বর্জ্য কোনো অবস্থাতেই যেন খালে ফেলা না হয় সে লক্ষে জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনে জরিমানার ব্যবস্থা করা, আগ্রাবাদ শেখ মুজিব রোড বঙ কালভার্টের মাটি উত্তোলন করা, মেগা প্রকল্পের আওতায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিলট্র্যাপ স্থাপন করা এবং গার্ভেজ ট্র্যাপ স্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ। এছাড়া নগরের ড্রেনেজ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাজ সুষ্ঠু বাস্তবায়নের স্বার্থে চসিক কর্তৃক ড্রেনেজ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সার্কেল গঠন, মেগা প্রকল্প বহির্ভূত ২১টি খালসহ তৎসংলগ্ন সেকেন্ডারি নালাসমূহ সংস্কার ও উন্নয়ন বিষয়ে দ্রুত প্রকল্প গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।
১৯৯৫ সালের ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানের সুপারিশের আলোকে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অধীনে থাকা তিনটি জলাধারের বাইরেও নগরীতে নতুন জলাধার সৃষ্টির জন্য প্রকল্প গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। সিডিএর ১৭টি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২৩টি সহ মোট ৪০টি রেগুলেটর কাজ শেষে অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট সংস্থাকে নিতে হবে বলেও সুপারিশ করা হয়। এক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ড যেহেতু নগরের বিদ্যমান রেগুলেটরগুলো রক্ষণাবেক্ষণ কাজে নিয়োজিত আছে তাই নতুন রেগুলেটর রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্বও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দেয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়।
এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল এলাকায় বালি ভরাটের জন্য বিদ্যমান তিনটি স্লুইচ গেটের মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাট্টলী ও হালিশহর এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে উল্লেখ করে স্লুইচ গেট বরাবর সোজাসুজি পূর্বের ন্যায় খাল খনন কিংবা বন্ধ কালভার্ট নির্মাণ কাজ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সম্পন্ন করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়।
এদিকে পরিদর্শন রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, বামনশাহী খালের ডেন্টাল কলেজ হাসপাতাল হতে চাঁন্দমিয়া সড়ক হয়ে হাজীরপুল পর্যন্ত এলাকা পরিদর্শনকালে কমিটির সদস্যরা হাজীপাডা সংলগ্ন বাইন্যার পুলের নিকট আড়াআড়ি বাঁধ দেখতে পায়। মোস্তফা পোল্ট্রির নিকট মাদ্রাসার পাশেও বাঁধ রয়েছে। হাজীর পুল চালিপাড়া রোডের পাশে উত্তরা খালে আড়াআড়িভাবে বন্ধ রয়েছে।
উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত পৃথক দুটি প্রতিবেদনে কমিটির খাল পরিদর্শনে পাওয়া চিত্র তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে ৪ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদনে চান্দগাঁও ও মোহরা অঞ্চল এবং ২৮ জুন বাকলিয়া ও হালিশহর অঞ্চলের তথ্য রয়েছে।