ভূমিকা
ডেঙ্গু জ্বর (সমার্থক ভিন্ন উচ্চারণ ডেঙ্গি জ্বর), মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস জীবাণু দ্বারা সংঘটিত রোগ। এই রোগের সর্বপ্রথম অনুমিত ধারণা মেলে জিন বংশের (২৬৫–৪২০ খৃষ্টাব্দ) এক চীনা মেডিক্যাল বিশ্বকোষে। ট্রপিকাল রোগ হিসাবে ম্যালেরিয়ার পরই ডেঙ্গুর স্থান। বৈশ্বিকভাবে ডেঙ্গুর সংখ্যা ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে ২০০১–২০০২ সালে প্রথমবার বিস্তৃতভাবে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ দেখা যায়। ডেঙ্গু জ্বর সংক্রমণের উচ্চহার লক্ষ্য করা যায় বর্ষাকালে ও আরবান–সাব আরবান এলাকার জনগোষ্ঠীতে।
ডেঙ্গু ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য
এটা এক সূত্রক বিশিষ্ট আরএনএ ভাইরাস। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ভাগ বা সেরোটাইপ শনাক্ত হয়েছে, যারা প্রত্যেকে রোগের পূর্ণচিত্র তৈরিতে সক্ষম। এগুলোর নাম হলো– ডেন–১, ডেন–২, ডেন–৩, ডেন–৪। একবার এক টাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা কেউ আক্রান্ত হলে, তাঁর অন্যবার অন্য প্রকারের টাইপ দ্বারা আবারো আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে এরসাথে একাধিক টাইপে বা দ্বিতীয়বার আক্রান্তের ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা থাকে অনেক বেশি।
ডেঙ্গু ভাইরাস এর বাহক এডিস মশা
কয়েক প্রজাতির স্ত্রী এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক, যেগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি প্রধান। এই মশকী যখন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তপান করে, তখন ডেঙ্গু ভাইরাস ওই মশার দেহে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে লালাগ্রন্থিতে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে এই মশা যখন সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন সেই ব্যক্তির শরীরের ত্বকে ডেঙ্গু ভাইরাস জীবাণু প্রবেশ করে। এডিস মশার শরীরে ডোরাকাটা দাগ থাকে বলে এর অন্য নাম ‘টাইগার মশা’।
এই মশা ৪ থেকে ৫ দিনের স্বচ্ছ জমানো জলে দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটায় এবং কৃত্রিম জলাধারে ডিম পাড়তে, মানুষের কাছে থাকা ও রক্তপান করতে বেশি পছন্দ করে। এডিস মশা মূলত কামড়ায় দিনের বেলায়, বিশেষত সূর্যোদয়ের কয়েক ঘণ্টা ও সূর্যাস্তের ঘণ্টা খানের আগে। একই মশা ইয়োলো ফিভার, জিকা ভাইরাস, চিকুনগুনিয়া ভাইরাসেরও বাহক।
ডেঙ্গু জ্বরের ক্লিনিক্যাল কোর্স
ভাইরাস শরীরে প্রবেশের সাধারণত ৪ থেকে ৭ দিনের মধ্যে (৩ থেকে ১৪ দিন) রোরেগ উপসর্গ দেখা যায়। এই সময়কালকে বলা হয় ‘ইনকুবেশন পিরিয়ড’। উপসর্গাদি ১০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্তরা থাকে উপসর্গবিহীন, কিংবা থাকে সাধারণ জ্বরের মতো সামান্য উপসর্গ নিয়ে।
রোগের ধরন
১. ডেঙ্গু জ্বর, প্রথম ১–৫ দিন : হঠাৎ উঁচু মাত্রার জ্বর, যা প্রায় ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) পর্যন্ত উঠতে পারে। জ্বর বাড়ার সময় শরীরে কাঁপুনি থাকে। থাকে তীব্র শিরঃপীড়া, অক্ষি কোটরের পেছনে ব্যথা। হাড়ের জোড়ায় গাঁটে ও মাংসপেশিতে প্রবল ব্যথার কারণে এই রোগের আরেক নাম ‘হাড় ভাঙা জ্বর’ বা ‘ব্রেক বোন ফিভার’। অন্যান্য উপসর্গাদি হলো– ক্লান্তি, বমিভাব, বমি। উপসর্গের প্রথম বা দ্বিতীয় দিনে গাত্রচর্মে লাল ফুসকুড়ি অথবা অসুখের ৪–৭ দিনের মধ্যে হামের মতো ‘লাল বিন্দু ত্বকের রেশ’ দেখা যায়।
২. ৫–৭ দিন : রক্তক্ষয়ী ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম, (যা ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়)- নাক, মাড়ি থেকে আপনা–আপনি সামান্য ধরনের রক্তপাত। শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়। রোগের তীব্রতা অনুযায়ী এটা ৪টা উপ–পর্বে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে।
ক. গ্রেড–১ : কোনো রক্তপাত চিহ্ন নেই, কেবল পজিটিভ টুর্নিকোয়েট টেস্ট।
খ. গ্রেড–২ : রক্তপাত লক্ষণাদি।
গ. গ্রেড–৩ : নাড়ি দুর্বল ও দ্রুত। রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কম। পালস প্রেসার লো।
ঘ. গ্রেড–৪ : রক্তচাপ ও নাড়ি স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে না।
উল্লেখ্য, গ্রেড–১ ও গ্রেড–২ ‘ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার’ বা ‘ডিএইচএফ’ এবং গ্রেড–৩ ও গ্রেড–৪ ‘ডেঙ্গু শক্্ সিনড্রোমের’ আওতাভুক্ত।
ডেঙ্গু জ্বরের ল্যাবরেটরি পরীক্ষা
১. প্রথম ৭ দিনে পিসিআর, ভাইরাল এন্টিজেন ডিটেকশন প্রায় নির্ভুল। অসুখের ৫–৭ দিন পর থেকে আই.জি এন্টিবডি উৎপন্ন হয় এবং উপসর্গসহ সেরোলজি টেস্টে এই এন্টিবডির শনাক্তকরণ রোগনিরুপক বলে গণ্য করা হয়।
২. রক্তে অণুচক্রিকার স্বাভাবিক মান ১,৫০,০০০ থেকে ২,৫০,০০০/- প্রতি মিলি.। ডেঙ্গু জ্বরে তা দ্রুত কমে যায়। তা যদি ২০,০০০/ প্রতি মিলি. এর নিচে থাকে, তবে রোগী মারাত্মক রোগ জটিলতায় পড়ার ঝুঁকিতে পড়ে। কিন্তু রোগীর অবস্থার উন্নতি হতে থাকলে ২–৪ দিনের মধ্যে অণুচক্রিকার কাউন্ট বেড়ে যেতে থাকে।
৩. রক্তে হিমাটোক্রিট এর বাড়তি মান– রক্তের প্লাজমা, কেপিলারি লিকেজ হয়ে টিস্যুতে নিঃসররিত হওয়ায় এটা ঘটে। রক্তের শ্বেতকণিকা কমে যাওয়া, এলবুমিন মান কমে যাওয়া ল্যাব–টেস্টে ধরা পড়ে।
৪. বুকে ও পেটে পানি জমা নির্ণয়ে যথাক্রমে বুকের এঙরে ও পেটের আলট্রাসাউন্ড।
৫. যেসব জায়গায় রক্তের অণুচক্রিকা পরীক্ষার সুযোগ নেই, সেখানে ‘টুর্নিকোয়েট টেস্ট’ করে দেখা। এই পরীক্ষাতে রক্তচাপ বাঁধার কাপ ৫ মিনিট ধরে বাহুতে বেঁধে রেখে ত্বকে রক্তবিন্দু দানার সংখ্যা গুনে দেখা যায়।
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা প্রণালী
১. ডেঙ্গু জ্বরের সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। ২ থেকে ৭ দিনের মাঝে সাধারণ ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে। প্রায় ৮৫ শতাংশ ডেঙ্গু জ্বর থাকে সাধারণ মাত্রার, বাড়িতে যা চিকিৎসা করানো সম্ভব। যেমন–
ক. জ্বর লাঘবে প্যারাসিটামল। এসপিরিন বা এই জাতীয় ওষুধ কখনোই জ্বর নিবারণে ব্যবহার না করা।
খ. পরিপূর্ণ বিশ্রাম। বেশি বেশি তরল খাবার ও পানীয় পান।
২. ‘ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার’ মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চিকিৎসা গ্রহণ। বিশেষত জ্বর সম্পূর্ণ চলে যাবার ২৪ ঘণ্টার পরে যদি রোগী বেশি অসুস্থতা অনুভব করে, তবে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া।
৩. মারাত্মক রুপ ধারণ করলে প্রয়োজনে রক্ত, বা প্লাজমা সঞ্চালন।
৪. সাধারণভাবে এন্টিবায়োটিক, স্টেরয়েডের কোনো ভূমিকা নেই।
৫. ডেঙ্গু শক্্ সিনড্রোমের বিশেষ চিকিৎসা ব্যবস্থাদি।
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে করণীয়
কয়েকটি দেশে ডেঙ্গু জ্বর প্রতিষেধক টিকা ব্যবহার করে দেখা হচ্ছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়– ট্রপিকাল অঞ্চলে বসবাসরত বা ভ্রমণরত ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর ডেঙ্গু সংক্রমিত মশার কামড় থেকে সুরক্ষা দেওয়া। যেমন– মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করা। এজন্য ফুলের টব, ডাবের খোসা, ক্যান, গাড়ির টায়ার, এয়ার কুলার, গর্ত, ছাদ ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি যেন জমা না থাকে, সেইরকম ব্যবস্থা অবলম্বন। মশক বৃদ্ধির স্থানে কীটনাশক ও ঘরে মশা তাড়ানোর রিপেলেন্টস এর ব্যবহার। ঘরের বাইরে বেরুলে মশার কামড় এড়াতে হাত–পা ঢেকে থাকার মতো পোশাক পরিধান করা। শিশুকে ফুল শার্ট, ফুল প্যান্ট ও মোজা পরানো। দিনের বেলায়ও মশারি খাটিয়ে ঘুমানো। পরিবারের কেউ একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে, অন্যদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য মশারির ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ, যাতে করে অসুস্থ ব্যক্তিকে মশা কামড়িয়ে আবার সুস্থ কাউকে না কামড়াতে পারে। ডেঙ্গু ছোঁয়াচে রোগ নয়, বা এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তিকে সংক্রমিত করে না। তবে ডেঙ্গু রক্ত–সম্বন্ধী সামগ্রী ও অঙ্গদানের মাধ্যমেও পরিবাহিত হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের পরিণতি
বেশিরভাগ ডেঙ্গু জ্বর উপসর্গহীন থাকে, বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো সাধারণ জ্বর, সর্দি–কাশ নিয়ে প্রকাশ পায় ও কয়েকদিনের মধ্যে আপনা আপনি সেরে যায়। পর্যাপ্ত চিকিৎসায় ডেঙ্গু আক্রান্তে মৃত্যুহার ১ শতাংশ। কিন্তু ‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে’ মৃত্যুর শংকা বেড়ে ৫ শতাংশের মতো হতে পারে। শিশু ও অল্পবয়সীদের মধ্যে এ রোগের প্রাবল্য বেশি। ডায়াবেটিস ও অ্যাজমার মতো দীর্ঘমেয়াদি অসুখে ভোগা ব্যক্তির জন্য ডেঙ্গু প্রাণঘাতী হতে পারে।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।